ঢাকা ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, সুফল নেই সরকারের নজরদারিতে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০১:৩৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ মে ২০২৩
  • / ৪৪৪ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। নিত্যপণের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বাড়ার এ প্রভাব। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি ব্যবস্থা থাকলেও এর সুফল দেখা যাচ্ছে না বাজারে। বর্তমানে বাজারে দাম কমার থেকে বাড়ার তালিকাই বেশি।

কিছুদিন আগেও ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেপের দাম বেড়ে এখন ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে সবজি কেনাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেপে, লাউ, করোলার মতো সবজি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আমিষের উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি চিনি কিনতেও ক্রেতাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনি বর্তমানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে অপরিশোধিত চিনির দাম। যদিও দেশে চিনি আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। মজুতও রয়েছে পর্যাপ্ত। তবে অজানা কারণে দেশের বাজারেও পরিশোধিত চিনির সরবরাহ কম। অন্যদিকে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম ফের বেড়েছে। আমদানিতে সরকারের ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে প্রতিদিনই বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। সবমিলিয়ে দেশে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য দুটির বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। এক মাস আগেও যা ছিল ৫২০ মার্কিন ডলার। বর্তমান দরে চিনি আমদানি করা হলে এর খরচ পড়বে প্রতি কেজি ১৩১ টাকা করে। এ অবস্থায় চিনি আমদানি করবে কি না সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ২ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে সংগঠনটির মহাসচিব গোলাম রহমানের সই করা এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়।

এদিকে চিনির মতো তেলের বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ভ্যাট কমানোর ঘোষণা বাতিল হওয়াকে অজুহাত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তির দিকে থাকায় দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরের ১৬ মার্চ ভোজ্যতেলের ভ্যাট আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ৩০ এপ্রিলে ভ্যাট মওকুফের মেয়াদ শেষ হয়। এতদিন আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে পাঁচ শতাংশ কার্যকর ছিল। এখন আবার ১৫ শতাংশে ফিরে গেল।

এ কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার সই করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ টাকা; যা ছিল ১৬৭ টাকা। আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯০৬ টাকা থেকে ৫৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৬০ টাকা। এছাড়া খোলা পাম সুপার তেল লিটার প্রতি ১১৭ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মেরাদিয়া হাট, মালিবাগ বাজার, গোড়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার এবং সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দাম বাড়ার এমন চিত্র দেখা গেছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন।

সরকারি তথ্য মতে, আলু, দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, দেশি ও আমদানি আদা, জিরা, দারুচিনি, তেজপাতা, চিনি এবং ডিমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সরু ও মাঝারি চাল, বড় ও ছোট মশুর ডাল, আমদানি করা রসুন, দেশী হলুদ, ধনে এবং ব্রয়লার মুরগির মূল্য হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ, আদা-রসুনের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ দাম বেড়েছে আমদানি করা আদায়, যা বর্তমানে প্রতি কেজি ১৮০-৩২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও আমদানি করা আদার দাম ছিল মাত্র ৭০ থেকে ১২০ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৪৮ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে।

আর গত এক বছরে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করেনিয়েছে আমদানি করা আদা। এর দাম গেল এক বছরে বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাজারে আদার দামে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বর্তমানে প্রতিকেজি আদা ১৮০-৩২০ টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল মাত্র ৭০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। সংস্থাটির গত এক বছরের খুচরা বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের ব্যবধানে বাজারে ৪৮ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ৩৭টির দাম। কমেছে শুধু ১০টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে শুধুমাত্র ১টি পণ্যের দাম।

এর মধ্যে গত এক বছরে দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে আছে মোটা স্বর্ণা চাল। এ চাল গেল এক বছরে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে মোটা স্বর্ণা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৬-৫০ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ৪৫-৪৮ টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে ৪৮ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গেল এক মাসে বেড়েছে ১৫টির দাম। কমেছে ৯ টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ২৪টির।

এর মধ্যে গত এক মাসে টিসিবি’র হিসাব অনুযায়ী, দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে অবস্থান গরুর মাংসের। গেল এক মাসে এর মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংসের দাম ৭৩০-৭৫০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৭০০-৭৫০ টাকা। ঈদের আগে ৭৫০ টাকা কেজিতে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হলেও ঈদের সময় তা হঠাৎ বেড়ে ৮০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। সেই বাড়তি দামেই এখনো বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। বিক্রেতারা বলছেন, গরুর দাম বেশি, সব ধরনের খরচও বেশি। তাই ৮০০ টাকায় বিক্রি না করলে লোকসান হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, ঈদের অজুহাতে গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর পর এখনো বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে।

শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি গরুর মাংস ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে দুই-একটি দোকানে ৭৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়।

আর গেল এক মাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে দেশি নতুন রসুন। গেল এক মাসে এর দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশি নতুন রসুনের দাম কেজিপ্রতি ১৩০-১৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল মাত্র ৮০ থেকে ১২০ টাকা। বাজারে হঠাৎ দেশি রসুনের দাম বেড়ে যাওয়াতে ক্রেতারা একপ্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মূলত কোরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের।

দাম বাড়ার তালিকায় বাদ যায়নি অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ডিম। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে প্রতি হালি (লাল) ডিমের দাম ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সপ্তাহ খানে আগে ১২০-১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিম বর্তমানে এলাকা ভেদে ১৫-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৮ টাকা পর্যন্ত।

ডিমের বাজার কেন বারবার অস্থিরতা বাড়ছে এ বিষয়ে কয়েকজন পল্ট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে ডিমের দাম আরও বাড়বে। মুরগির খাবারে দাম বাড়ায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। যার প্রভাব ডিমের বাজারে দেখা দিচ্ছে। লোকসানের কারণে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী লোকসান কমাতে খামারের আকার ছোট করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়, সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং কক লেয়ার (লাল) প্রতি কেজি ৩৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে, মাছের দামও বাড়তি যাচ্ছে বাজারে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চাষের কই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, শিং মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, পাঙাস মাছ প্রতি কেজি ২২০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, চিংড়ি আকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, পাবদা মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, বড় টেংরা প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, শোল মাছ আকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, কাতল মাছ প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি হিসেবে, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে খোলা আটা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫৫-৫৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাশাপাশি প্যাকেট আটা ২০ টাকা বেড়ে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন তা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। ফলে খেটেখাওয়া মানুষের জীবন চালিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, সুফল নেই সরকারের নজরদারিতে

আপডেট সময় : ০১:৩৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ মে ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। নিত্যপণের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বাড়ার এ প্রভাব। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি ব্যবস্থা থাকলেও এর সুফল দেখা যাচ্ছে না বাজারে। বর্তমানে বাজারে দাম কমার থেকে বাড়ার তালিকাই বেশি।

কিছুদিন আগেও ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেপের দাম বেড়ে এখন ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে সবজি কেনাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেপে, লাউ, করোলার মতো সবজি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আমিষের উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি চিনি কিনতেও ক্রেতাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনি বর্তমানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে অপরিশোধিত চিনির দাম। যদিও দেশে চিনি আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। মজুতও রয়েছে পর্যাপ্ত। তবে অজানা কারণে দেশের বাজারেও পরিশোধিত চিনির সরবরাহ কম। অন্যদিকে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম ফের বেড়েছে। আমদানিতে সরকারের ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে প্রতিদিনই বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। সবমিলিয়ে দেশে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য দুটির বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। এক মাস আগেও যা ছিল ৫২০ মার্কিন ডলার। বর্তমান দরে চিনি আমদানি করা হলে এর খরচ পড়বে প্রতি কেজি ১৩১ টাকা করে। এ অবস্থায় চিনি আমদানি করবে কি না সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ২ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে সংগঠনটির মহাসচিব গোলাম রহমানের সই করা এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়।

এদিকে চিনির মতো তেলের বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ভ্যাট কমানোর ঘোষণা বাতিল হওয়াকে অজুহাত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তির দিকে থাকায় দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরের ১৬ মার্চ ভোজ্যতেলের ভ্যাট আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ৩০ এপ্রিলে ভ্যাট মওকুফের মেয়াদ শেষ হয়। এতদিন আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে পাঁচ শতাংশ কার্যকর ছিল। এখন আবার ১৫ শতাংশে ফিরে গেল।

এ কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার সই করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ টাকা; যা ছিল ১৬৭ টাকা। আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯০৬ টাকা থেকে ৫৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৬০ টাকা। এছাড়া খোলা পাম সুপার তেল লিটার প্রতি ১১৭ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মেরাদিয়া হাট, মালিবাগ বাজার, গোড়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার এবং সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দাম বাড়ার এমন চিত্র দেখা গেছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন।

সরকারি তথ্য মতে, আলু, দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, দেশি ও আমদানি আদা, জিরা, দারুচিনি, তেজপাতা, চিনি এবং ডিমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সরু ও মাঝারি চাল, বড় ও ছোট মশুর ডাল, আমদানি করা রসুন, দেশী হলুদ, ধনে এবং ব্রয়লার মুরগির মূল্য হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ, আদা-রসুনের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ দাম বেড়েছে আমদানি করা আদায়, যা বর্তমানে প্রতি কেজি ১৮০-৩২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও আমদানি করা আদার দাম ছিল মাত্র ৭০ থেকে ১২০ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৪৮ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে।

আর গত এক বছরে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করেনিয়েছে আমদানি করা আদা। এর দাম গেল এক বছরে বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাজারে আদার দামে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বর্তমানে প্রতিকেজি আদা ১৮০-৩২০ টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল মাত্র ৭০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। সংস্থাটির গত এক বছরের খুচরা বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের ব্যবধানে বাজারে ৪৮ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ৩৭টির দাম। কমেছে শুধু ১০টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে শুধুমাত্র ১টি পণ্যের দাম।

এর মধ্যে গত এক বছরে দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে আছে মোটা স্বর্ণা চাল। এ চাল গেল এক বছরে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে মোটা স্বর্ণা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৬-৫০ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ৪৫-৪৮ টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে ৪৮ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গেল এক মাসে বেড়েছে ১৫টির দাম। কমেছে ৯ টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ২৪টির।

এর মধ্যে গত এক মাসে টিসিবি’র হিসাব অনুযায়ী, দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে অবস্থান গরুর মাংসের। গেল এক মাসে এর মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংসের দাম ৭৩০-৭৫০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৭০০-৭৫০ টাকা। ঈদের আগে ৭৫০ টাকা কেজিতে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হলেও ঈদের সময় তা হঠাৎ বেড়ে ৮০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। সেই বাড়তি দামেই এখনো বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। বিক্রেতারা বলছেন, গরুর দাম বেশি, সব ধরনের খরচও বেশি। তাই ৮০০ টাকায় বিক্রি না করলে লোকসান হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, ঈদের অজুহাতে গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর পর এখনো বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে।

শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি গরুর মাংস ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে দুই-একটি দোকানে ৭৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়।

আর গেল এক মাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে দেশি নতুন রসুন। গেল এক মাসে এর দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশি নতুন রসুনের দাম কেজিপ্রতি ১৩০-১৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল মাত্র ৮০ থেকে ১২০ টাকা। বাজারে হঠাৎ দেশি রসুনের দাম বেড়ে যাওয়াতে ক্রেতারা একপ্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মূলত কোরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের।

দাম বাড়ার তালিকায় বাদ যায়নি অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ডিম। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে প্রতি হালি (লাল) ডিমের দাম ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সপ্তাহ খানে আগে ১২০-১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিম বর্তমানে এলাকা ভেদে ১৫-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৮ টাকা পর্যন্ত।

ডিমের বাজার কেন বারবার অস্থিরতা বাড়ছে এ বিষয়ে কয়েকজন পল্ট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে ডিমের দাম আরও বাড়বে। মুরগির খাবারে দাম বাড়ায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। যার প্রভাব ডিমের বাজারে দেখা দিচ্ছে। লোকসানের কারণে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী লোকসান কমাতে খামারের আকার ছোট করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়, সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং কক লেয়ার (লাল) প্রতি কেজি ৩৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে, মাছের দামও বাড়তি যাচ্ছে বাজারে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চাষের কই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, শিং মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, পাঙাস মাছ প্রতি কেজি ২২০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, চিংড়ি আকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, পাবদা মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, বড় টেংরা প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, শোল মাছ আকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, কাতল মাছ প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি হিসেবে, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে খোলা আটা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫৫-৫৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাশাপাশি প্যাকেট আটা ২০ টাকা বেড়ে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন তা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। ফলে খেটেখাওয়া মানুষের জীবন চালিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।