ঢাকা ০৪:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট মডেল মসজিদ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৫৪:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ মে ২০২৩
  • / ৪৫৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আবু তাহের আনসারী :

উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। নাগরিকরা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ভোগ করছে, যা দৃশ্যমান। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের নতুন এক মহাপরিকল্পনায় হাঁটতে শুরু করেছি আমরা। ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন রূপে পরিচিতি পাবে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ’।

স্মার্ট বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি ০৪ টি। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট সরকার। জ্ঞানভিত্তিক দক্ষ ও স্বনির্ভর নাগরিক তৈরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাত এবং সরকারি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম আধুনিকীকরণ ও এর উন্নয়নে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলাই হলো তথা স্মার্ট বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসুলে কারীম সা. এর ইসলাম। যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র’। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই, ধর্মপ্রাণ হক্কানী আলেগণের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা এবং ইসলামের প্রচারে ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশবলে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারের একটি বিশেষায়িত সায়ত্ত্বশাসিত দপ্তর হিসেবে ইসলামের খেদমত ও জনকল্যাণে বহুমূখী কাজে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। জ্ঞান ও ধর্মচর্চার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের আলোকে কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেবল দেশেই নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি জননন্দিত ও বহুল প্রশংসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

একশ্রেণির স্বার্থান্বেসী ধর্মব্যবসায়ী শান্তির ধর্ম ইসলামকে অপব্যাখ্যা দিয়ে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে বহুভাবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ধর্মরিপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন। তিনি বুঝিয়েছেন, ধর্মনিরপক্ষেতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ফলে, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারকে সংবিধানে সংরক্ষিত করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসমষ্টির বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল তা জনমানুষের আরও দোর-গোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানামূখী যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একের পর অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছেন। আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ধর্মীয় সেক্টরে ইসলামের খেদমতে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা ১ টি করে মোট ৫৬৪ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেন। যা মুসলিম বিশ্বসহ সারা বিশ্বে বিরল নজির স্থাপিত হয়েছে।

মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের অভিপ্রায়টি ২০১৫ সালে প্রথম ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বঙ্গবন্ধু কন্যার এই অভিপ্রায়কে সফল করার জন্য সাহস যোগান। ঐ বছরই ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ১ টি মডেল মসজিদ নির্মাণের নির্দেশনা প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল ৮৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন শুভ উদ্বোধন করেন তিনি। সুবিধাভোগী দপ্তর হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ন্যস্ত করা হয় মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহকে। ইতোমধ্যে ২০০টি দৃষ্টিনন্দন নবনির্মিত মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়নজুড়ানো আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইনে বিশ্বের আর কোনও দেশে সরকারিভাবে প্রত্যন্ত এলাকায় মসজিদ নির্মাণের এমন নজির নেই। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সমাজ বিনির্মাণে ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নির্মাণকে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রারম্ভিক প্রকাশ ও প্রথম ধাপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট মডেল মসজিদ আমাদের জাতীয় জীবনে ‘উন্নত রুচিবোধেরই বহিঃপ্রকাশ।

২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বহুমূখী সেবাখাত চালুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মডেল এই মসজিদগুলোয়। ‘আমার গ্রাম– আমার শহর’ নামে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহার ছিল, দেশের আলেম সমাজ ও প্রান্তিক শ্রেণির নাগরিক তারই সুফল ভোগ করার সুযোগ পাবে এই মসজিদগুলোর মাধ্যমে। আমাদের দেশে মসজিদগুলো সাধারণত ইবাদতখানা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মডেল মসজিদগুলো কেবল ইবাদতখানা হিসেবে নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ জীবন চর্চার অংশ হিসেবে ইসলামিক সাংস্কৃতিক চর্চার বিপ্লবের মডেল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে। ধর্মীয় সেক্টরে সরকারের এই বৃহত্তর উদ্যোগ এবং কর্মযজ্ঞ দেশ ও দেশের বাইরে নানাভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়সহ সর্বস্তরের নাগরিক নানাভাবে এর সুফল গ্রহণ করে নিজেদেরকে দক্ষ ও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে।

মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোয় যেসব ধর্মীয় এবং নাগরিক সুবিধা রয়েছে তা হলো: নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ওজু এবং নামাজের ব্যবস্থা। প্রতিটি মসজিদে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ জন মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। মৃত ব্যক্তির গোসল ও জানাজা নামাজের ব্যবস্থা। হজ্জগমনেচ্ছুদের জন্য হজ্জ নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের যেন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে সেজন্য কনফারেন্সিং, কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-উগ্রবাদকে প্রতিরোধকল্পে এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সকল ইমাম-মুয়াজ্জিনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাখা হয়েছে ইমাম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও চর্চা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে আলেমগণ দক্ষ জনবলে পরিণত হবে। ক্রমান্বয়ে দেশের সকল মসজিদ কানেক্ট থাকবে এই মডেল মসজিদের সাথে। মডেল মসজিদে রয়েছে ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র। ইসলাম ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও মানবিক ও জনকল্যাণমূখী নানাবিধ বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাবেন আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ। রয়েছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির নাগরিক অধ্যয়ন করার সুযোগ পাবেন এই লাইব্রেরিতে। ধর্মীয় বই-পুস্তক, দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী ছাড়াও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক বই পড়ারও সুবিধা রয়েছে এতে। রয়েছে অটিজম সেন্টার তথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নামাজ আদায়সহ ধর্মীয় নানাবিধ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ। রয়েছে হিফজখানা-এতিমখানা। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও সহজ কুরআন শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা। নিরক্ষর বা বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে গণশিক্ষা কেন্দ্র। দ্বীনি ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ইসলামিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিভিন্ন ধরণের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স বাস্তবায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে এতে। রয়েছে বই বিক্রয় কেন্দ্র। কুরআন-হাদিসের সরল তরজমা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ তাফসির ও ইসলামের মৌলিক গবেষণালব্ধ বই সবমিলে চার হাজারেরও অধিক শিরোনামের পুস্তক রয়েছে এই বই বিক্রয় কেন্দ্রে। সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। যে কোনও শ্রেণি-পেশার মানুষ বই কেনার সুযোগ পাবেন এখানে। পবিত্র রমজান মাসে থাকে বিশেষ মূল্য ছাড়। দেশি-বিদেশি পর্যটক ও মেহমানদের জন্য রয়েছে অতিথিশালা বা মুসাফিরখানা। মুসল্লিদের জন্য নামাজ কক্ষে শীতাতপের ব্যবস্থা। রয়েছে গাড়ি সুবিশাল পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক পোরশনও রয়েছে একাংশে।

স্মার্ট এই মডেল মসজিদগুলো সামাজিক সমস্যা সমাধানে ধর্মীয় নির্দেশনা, খুতবা বা বয়ান এবং অন্যান্য প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূখ্য ভুমিকা পালন করবে। গুজব কিংবা যে কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত-উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে, সমাজে জনগুরুত্বপূর্ণ মেসেজ বা জনসচেতনমূলক বার্তা প্রচারে মডেল মসজিদগুলো কী-পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। অধিকন্তু, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং স্মার্ট নাগরিক ও আলেম তৈরিতে মূখ্য সহায়তায় থাকবে স্মার্ট মডেল মসজিদের বহুমূখী কার্যক্রম। সুখী-সমৃদ্ধ-দক্ষ ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকায় পরিচিতি পাবে মডেল মসজিদগুলো। গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

বা/খ: জই

নিউজটি শেয়ার করুন

স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট মডেল মসজিদ

আপডেট সময় : ০৬:৫৪:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ মে ২০২৩

আবু তাহের আনসারী :

উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। নাগরিকরা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ভোগ করছে, যা দৃশ্যমান। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের নতুন এক মহাপরিকল্পনায় হাঁটতে শুরু করেছি আমরা। ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন রূপে পরিচিতি পাবে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ’।

স্মার্ট বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি ০৪ টি। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট সরকার। জ্ঞানভিত্তিক দক্ষ ও স্বনির্ভর নাগরিক তৈরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাত এবং সরকারি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম আধুনিকীকরণ ও এর উন্নয়নে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলাই হলো তথা স্মার্ট বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসুলে কারীম সা. এর ইসলাম। যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র’। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই, ধর্মপ্রাণ হক্কানী আলেগণের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা এবং ইসলামের প্রচারে ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশবলে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারের একটি বিশেষায়িত সায়ত্ত্বশাসিত দপ্তর হিসেবে ইসলামের খেদমত ও জনকল্যাণে বহুমূখী কাজে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। জ্ঞান ও ধর্মচর্চার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের আলোকে কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেবল দেশেই নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি জননন্দিত ও বহুল প্রশংসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

একশ্রেণির স্বার্থান্বেসী ধর্মব্যবসায়ী শান্তির ধর্ম ইসলামকে অপব্যাখ্যা দিয়ে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে বহুভাবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ধর্মরিপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন। তিনি বুঝিয়েছেন, ধর্মনিরপক্ষেতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ফলে, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারকে সংবিধানে সংরক্ষিত করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসমষ্টির বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল তা জনমানুষের আরও দোর-গোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানামূখী যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একের পর অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছেন। আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ধর্মীয় সেক্টরে ইসলামের খেদমতে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা ১ টি করে মোট ৫৬৪ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেন। যা মুসলিম বিশ্বসহ সারা বিশ্বে বিরল নজির স্থাপিত হয়েছে।

মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের অভিপ্রায়টি ২০১৫ সালে প্রথম ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বঙ্গবন্ধু কন্যার এই অভিপ্রায়কে সফল করার জন্য সাহস যোগান। ঐ বছরই ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ১ টি মডেল মসজিদ নির্মাণের নির্দেশনা প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল ৮৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন শুভ উদ্বোধন করেন তিনি। সুবিধাভোগী দপ্তর হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ন্যস্ত করা হয় মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহকে। ইতোমধ্যে ২০০টি দৃষ্টিনন্দন নবনির্মিত মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়নজুড়ানো আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইনে বিশ্বের আর কোনও দেশে সরকারিভাবে প্রত্যন্ত এলাকায় মসজিদ নির্মাণের এমন নজির নেই। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সমাজ বিনির্মাণে ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নির্মাণকে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রারম্ভিক প্রকাশ ও প্রথম ধাপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট মডেল মসজিদ আমাদের জাতীয় জীবনে ‘উন্নত রুচিবোধেরই বহিঃপ্রকাশ।

২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বহুমূখী সেবাখাত চালুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মডেল এই মসজিদগুলোয়। ‘আমার গ্রাম– আমার শহর’ নামে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহার ছিল, দেশের আলেম সমাজ ও প্রান্তিক শ্রেণির নাগরিক তারই সুফল ভোগ করার সুযোগ পাবে এই মসজিদগুলোর মাধ্যমে। আমাদের দেশে মসজিদগুলো সাধারণত ইবাদতখানা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মডেল মসজিদগুলো কেবল ইবাদতখানা হিসেবে নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ জীবন চর্চার অংশ হিসেবে ইসলামিক সাংস্কৃতিক চর্চার বিপ্লবের মডেল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে। ধর্মীয় সেক্টরে সরকারের এই বৃহত্তর উদ্যোগ এবং কর্মযজ্ঞ দেশ ও দেশের বাইরে নানাভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়সহ সর্বস্তরের নাগরিক নানাভাবে এর সুফল গ্রহণ করে নিজেদেরকে দক্ষ ও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে।

মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোয় যেসব ধর্মীয় এবং নাগরিক সুবিধা রয়েছে তা হলো: নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ওজু এবং নামাজের ব্যবস্থা। প্রতিটি মসজিদে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ জন মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। মৃত ব্যক্তির গোসল ও জানাজা নামাজের ব্যবস্থা। হজ্জগমনেচ্ছুদের জন্য হজ্জ নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের যেন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে সেজন্য কনফারেন্সিং, কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-উগ্রবাদকে প্রতিরোধকল্পে এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সকল ইমাম-মুয়াজ্জিনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাখা হয়েছে ইমাম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও চর্চা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে আলেমগণ দক্ষ জনবলে পরিণত হবে। ক্রমান্বয়ে দেশের সকল মসজিদ কানেক্ট থাকবে এই মডেল মসজিদের সাথে। মডেল মসজিদে রয়েছে ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র। ইসলাম ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও মানবিক ও জনকল্যাণমূখী নানাবিধ বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাবেন আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ। রয়েছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির নাগরিক অধ্যয়ন করার সুযোগ পাবেন এই লাইব্রেরিতে। ধর্মীয় বই-পুস্তক, দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী ছাড়াও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক বই পড়ারও সুবিধা রয়েছে এতে। রয়েছে অটিজম সেন্টার তথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নামাজ আদায়সহ ধর্মীয় নানাবিধ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ। রয়েছে হিফজখানা-এতিমখানা। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও সহজ কুরআন শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা। নিরক্ষর বা বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে গণশিক্ষা কেন্দ্র। দ্বীনি ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ইসলামিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিভিন্ন ধরণের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স বাস্তবায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে এতে। রয়েছে বই বিক্রয় কেন্দ্র। কুরআন-হাদিসের সরল তরজমা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ তাফসির ও ইসলামের মৌলিক গবেষণালব্ধ বই সবমিলে চার হাজারেরও অধিক শিরোনামের পুস্তক রয়েছে এই বই বিক্রয় কেন্দ্রে। সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। যে কোনও শ্রেণি-পেশার মানুষ বই কেনার সুযোগ পাবেন এখানে। পবিত্র রমজান মাসে থাকে বিশেষ মূল্য ছাড়। দেশি-বিদেশি পর্যটক ও মেহমানদের জন্য রয়েছে অতিথিশালা বা মুসাফিরখানা। মুসল্লিদের জন্য নামাজ কক্ষে শীতাতপের ব্যবস্থা। রয়েছে গাড়ি সুবিশাল পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক পোরশনও রয়েছে একাংশে।

স্মার্ট এই মডেল মসজিদগুলো সামাজিক সমস্যা সমাধানে ধর্মীয় নির্দেশনা, খুতবা বা বয়ান এবং অন্যান্য প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূখ্য ভুমিকা পালন করবে। গুজব কিংবা যে কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত-উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে, সমাজে জনগুরুত্বপূর্ণ মেসেজ বা জনসচেতনমূলক বার্তা প্রচারে মডেল মসজিদগুলো কী-পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। অধিকন্তু, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং স্মার্ট নাগরিক ও আলেম তৈরিতে মূখ্য সহায়তায় থাকবে স্মার্ট মডেল মসজিদের বহুমূখী কার্যক্রম। সুখী-সমৃদ্ধ-দক্ষ ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকায় পরিচিতি পাবে মডেল মসজিদগুলো। গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

বা/খ: জই