ঢাকা ১১:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ইতিহাসে হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৪৪:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩
  • / ৪৯০ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

// মোঃ হায়দার আলী //

আমাদের এই অঞ্চলের শিক্ষা ও সামাজিক, দাতব্য কর্মকাণ্ডে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি- সেই তালিকার শীর্ষে থাকা একটি নাম হচ্ছে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন। নিজের সকল সম্পত্তি দান করা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে প্রভৃতি কাজে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মুহসীন।

অকৃতদার কিংবা অবৈষয়িক যেকোনো উপমা দিয়েই মহিমাণ্বিত করা যায় এই ব্যাক্তিটিকে। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। একারণে জীবনবোধ সম্পর্কে তার এক আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি বোনের কাছ থেকে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও, কয়েক বছরের মধ্যে সব সম্পত্তির দানপত্র লিখে দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন কোরান শরীফ কপি করে করে।

হাজী মুহাম্মদ মহসিন (৩ জানুয়ারি ১৭৩২ ২৯ নভেম্বর ১৮১২) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার একজন প্রখ্যাত মুসলিম জনহিতৈষী, ধার্মিক, উদার ও জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি তাঁর নিজের দানশীলতার মহৎ গুণাবলীর জন্য দানবীর খেতাব পেয়েছিলেন। যদিও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন, যার ফলস্বরূপ তিনি সে সময়ে বিপুল সম্পত্তি আয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিপুল সম্পত্তির মালিকানা হয়েও তিনি কেবল একটি খুব সহজ ও অযৌক্তিক জীবনযাপন করেননি, বরং তিনি যথাযথ শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা এবং দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তার সম্পত্তির বিশাল আত্মত্যাগ করেছিলেন।

মহসীনের সম্পদ পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে ঐতিহ্যগত ও আধুনিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ছড়িয়ে দিয়েছে
হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত কিছু স্কুল, মাদ্রাসা এবং কলেজে তার অনুদানের অর্থ দিয়ে এখনও অনেক বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের কাঠামো প্রদান করে এবং উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়।

আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ”তবে ওনার অর্থে প্রথম যে কলেজটি শুরু হয়, হুগলি মহসীন কলেজ- সেখানে কিন্তু সবাই পড়তে পারতেন। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গুরুদেব মুখোপাধ্যায়, দিজেন্দ্রনাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এরকম বিখ্যাত বাঙ্গালিরা এই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাদের সবার অবদান সম্পর্কে আমরা জানি।”

নিজের সকল সম্পত্তি দান করা, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মুহসীন। অকৃতদার, অবৈষয়িক মুহসীন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। জীবন সম্পর্কে তার গড়ে উঠেছিল আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মুহম্মদ মহসিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠার পর এই ফান্ডের তহবিল তখনকার সরকার বাঙ্গালির, বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার কাজে ব্যয় করতে শুরু করে। তাতে আমাদের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বড় রকমের শিক্ষার একটি রেনেসাঁ শুরু হয়-বিশেষ করে অবহেলিত মুসলিম সমাজের জন্য।”

”যদিও মুহসীনের নামটা সেভাবে উচ্চারিত হয় না। কিন্তু মূলত তার অবদানেরই মুসলমানদের লেখাপড়ার প্রতি যে আগ্রহটা, সেটার একটা বড় অবদান হচ্ছে মহসিনের সেই তহবিলের,” তিনি বলছেন।

রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি লবণ ব্যবসার মতো নানা খাতে বিনিয়োগ করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন আগা মোতাহার। তার তিনজন স্ত্রী থাকলেও কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আগা মোতাহার যখন মারা যান, তখন তার স্ত্রী জয়নাব খাতুনের গর্ভে জন্ম নেয়া সাতবছর বয়সী একটি মেয়ে ছিল, মরিয়ম খাতুন ওরফে মুন্নুজান। আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পত্তি মেয়ের নামে দিয়ে যান।

আগা মোতাহার মারা যাওয়ার পর জয়নাব খাতুনকে বিয়ে করেন হাজী ফয়জুল্লাহ। সেই ঘরেই জন্ম হয় মুহম্মদ মুহসীনের। তাকে  হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেও ধারণা করা হয়। খুব তাড়াতাড়ি মুন্নুজান মির্জা সালেহ অথবা সালেহ-উদ-দিনকে বিয়ে করেন। তিনিও ছিলেন একজন জমিদার এবং অনেক ধনসম্পত্তির মালিক। এই দম্পতির কোন সন্তান ছিল না। তাদের জমিদারির আয়ের বেশিরভাগ অংশই তারা দাতব্য কাজে ব্যয় করতেন।

১৭৬৩ সালে সালেহ-উদ-দিন মারা যাওয়ার পরে মু্ন্নুজান তার দাতব্য কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দেন। অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, তার যেহেতু কোন সন্তান ছিল না, তিনি প্রজাদেরই সন্তান বলে মনে করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান, মসজিদ তৈরি, কুয়া ও বিশাল পুকুর খনন, রাস্তাঘাট ও বাজার তৈরি করতে শুরু করেন।

তিনি চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও যেন এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। তার বিশ্বাস জন্মে, এজন্য একমাত্র তার ভাই মুহাম্মদ মুহসীনের ওপর নির্ভর করা যায়। হুগলিতে ফিরে এসে বিষয় সম্পত্তির দায়িত্ব নেয়ার জন্য তিনি ভাইকে চিঠি লিখে পাঠান।
সধারণা করা হয়, বোনের এসব দাতব্য কর্মকাণ্ড মুহাম্মদ মুহসীনকে অনুপ্রাণিত করেছিল শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।

পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ মহসিন বলছেন, ”নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ”

শিক্ষায় হাজী মুহসীনের অবদান
মুন্নুজান অথবা হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।

সেই সময় এই তহবিলের আকার ছিল পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আট লাখ আটানব্বই হাজার চারশো রুপি এবং নগদ পাঁচ হাজার দুইশ ৪৩ রুপি। সরকারি বন্ড থেকে বছরের আয় ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৪ রুপি। সেই সময়ের হিসাবে এটি অনেক টাকা।

১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে ‘মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড’ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। হাজী মোহাম্মদ মুহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন শিয়া ধর্মকেন্দ্র ইমামবাড়ার খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।

পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে।

দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের বয়স তখন প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি। তখন তার চিন্তা এসেছিল যে, তার মৃত্যুর পরে এই বিপুল সম্পত্তির কি হবে? তাই ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তির ওয়াকফ বা দানপত্র করে দেন। সেখানে এই সম্পত্তির আয় কীভাবে বিলি বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় স্থাপনা, জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে এসব অর্থ।

১৮১২ সালে এ ধার্মিক দানবীর হুগলিতে ৭৯–৮০ বছর বয়সে (হুগলি, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত) ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।

হাজী মুহাম্মাদ মুহসীন বেঁচেছিলেন একজন আলেমে দ্বীনের মতো। আর মৃত্যুতে তাঁর নামের সঙ্গে ‘দাতা’ বা ‘দানবীর’ কথাটা যুক্ত হয়ে গেছে চিরকালের জন্য। আল্লাহ তার অবদান কবুল করে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।

[ লেখক : মোঃ হায়দার আলী, সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ও প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী।]

নিউজটি শেয়ার করুন

ইতিহাসে হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে

আপডেট সময় : ০৮:৪৪:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩

// মোঃ হায়দার আলী //

আমাদের এই অঞ্চলের শিক্ষা ও সামাজিক, দাতব্য কর্মকাণ্ডে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি- সেই তালিকার শীর্ষে থাকা একটি নাম হচ্ছে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন। নিজের সকল সম্পত্তি দান করা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে প্রভৃতি কাজে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মুহসীন।

অকৃতদার কিংবা অবৈষয়িক যেকোনো উপমা দিয়েই মহিমাণ্বিত করা যায় এই ব্যাক্তিটিকে। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। একারণে জীবনবোধ সম্পর্কে তার এক আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি বোনের কাছ থেকে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও, কয়েক বছরের মধ্যে সব সম্পত্তির দানপত্র লিখে দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন কোরান শরীফ কপি করে করে।

হাজী মুহাম্মদ মহসিন (৩ জানুয়ারি ১৭৩২ ২৯ নভেম্বর ১৮১২) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার একজন প্রখ্যাত মুসলিম জনহিতৈষী, ধার্মিক, উদার ও জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি তাঁর নিজের দানশীলতার মহৎ গুণাবলীর জন্য দানবীর খেতাব পেয়েছিলেন। যদিও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন, যার ফলস্বরূপ তিনি সে সময়ে বিপুল সম্পত্তি আয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিপুল সম্পত্তির মালিকানা হয়েও তিনি কেবল একটি খুব সহজ ও অযৌক্তিক জীবনযাপন করেননি, বরং তিনি যথাযথ শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা এবং দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তার সম্পত্তির বিশাল আত্মত্যাগ করেছিলেন।

মহসীনের সম্পদ পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে ঐতিহ্যগত ও আধুনিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ছড়িয়ে দিয়েছে
হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত কিছু স্কুল, মাদ্রাসা এবং কলেজে তার অনুদানের অর্থ দিয়ে এখনও অনেক বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের কাঠামো প্রদান করে এবং উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়।

আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ”তবে ওনার অর্থে প্রথম যে কলেজটি শুরু হয়, হুগলি মহসীন কলেজ- সেখানে কিন্তু সবাই পড়তে পারতেন। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গুরুদেব মুখোপাধ্যায়, দিজেন্দ্রনাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এরকম বিখ্যাত বাঙ্গালিরা এই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাদের সবার অবদান সম্পর্কে আমরা জানি।”

নিজের সকল সম্পত্তি দান করা, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মুহসীন। অকৃতদার, অবৈষয়িক মুহসীন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। জীবন সম্পর্কে তার গড়ে উঠেছিল আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মুহম্মদ মহসিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠার পর এই ফান্ডের তহবিল তখনকার সরকার বাঙ্গালির, বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার কাজে ব্যয় করতে শুরু করে। তাতে আমাদের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বড় রকমের শিক্ষার একটি রেনেসাঁ শুরু হয়-বিশেষ করে অবহেলিত মুসলিম সমাজের জন্য।”

”যদিও মুহসীনের নামটা সেভাবে উচ্চারিত হয় না। কিন্তু মূলত তার অবদানেরই মুসলমানদের লেখাপড়ার প্রতি যে আগ্রহটা, সেটার একটা বড় অবদান হচ্ছে মহসিনের সেই তহবিলের,” তিনি বলছেন।

রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি লবণ ব্যবসার মতো নানা খাতে বিনিয়োগ করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন আগা মোতাহার। তার তিনজন স্ত্রী থাকলেও কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আগা মোতাহার যখন মারা যান, তখন তার স্ত্রী জয়নাব খাতুনের গর্ভে জন্ম নেয়া সাতবছর বয়সী একটি মেয়ে ছিল, মরিয়ম খাতুন ওরফে মুন্নুজান। আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পত্তি মেয়ের নামে দিয়ে যান।

আগা মোতাহার মারা যাওয়ার পর জয়নাব খাতুনকে বিয়ে করেন হাজী ফয়জুল্লাহ। সেই ঘরেই জন্ম হয় মুহম্মদ মুহসীনের। তাকে  হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেও ধারণা করা হয়। খুব তাড়াতাড়ি মুন্নুজান মির্জা সালেহ অথবা সালেহ-উদ-দিনকে বিয়ে করেন। তিনিও ছিলেন একজন জমিদার এবং অনেক ধনসম্পত্তির মালিক। এই দম্পতির কোন সন্তান ছিল না। তাদের জমিদারির আয়ের বেশিরভাগ অংশই তারা দাতব্য কাজে ব্যয় করতেন।

১৭৬৩ সালে সালেহ-উদ-দিন মারা যাওয়ার পরে মু্ন্নুজান তার দাতব্য কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দেন। অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, তার যেহেতু কোন সন্তান ছিল না, তিনি প্রজাদেরই সন্তান বলে মনে করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান, মসজিদ তৈরি, কুয়া ও বিশাল পুকুর খনন, রাস্তাঘাট ও বাজার তৈরি করতে শুরু করেন।

তিনি চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও যেন এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। তার বিশ্বাস জন্মে, এজন্য একমাত্র তার ভাই মুহাম্মদ মুহসীনের ওপর নির্ভর করা যায়। হুগলিতে ফিরে এসে বিষয় সম্পত্তির দায়িত্ব নেয়ার জন্য তিনি ভাইকে চিঠি লিখে পাঠান।
সধারণা করা হয়, বোনের এসব দাতব্য কর্মকাণ্ড মুহাম্মদ মুহসীনকে অনুপ্রাণিত করেছিল শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।

পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ মহসিন বলছেন, ”নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ”

শিক্ষায় হাজী মুহসীনের অবদান
মুন্নুজান অথবা হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।

সেই সময় এই তহবিলের আকার ছিল পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আট লাখ আটানব্বই হাজার চারশো রুপি এবং নগদ পাঁচ হাজার দুইশ ৪৩ রুপি। সরকারি বন্ড থেকে বছরের আয় ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৪ রুপি। সেই সময়ের হিসাবে এটি অনেক টাকা।

১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে ‘মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড’ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। হাজী মোহাম্মদ মুহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন শিয়া ধর্মকেন্দ্র ইমামবাড়ার খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।

পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে।

দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের বয়স তখন প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি। তখন তার চিন্তা এসেছিল যে, তার মৃত্যুর পরে এই বিপুল সম্পত্তির কি হবে? তাই ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তির ওয়াকফ বা দানপত্র করে দেন। সেখানে এই সম্পত্তির আয় কীভাবে বিলি বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় স্থাপনা, জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে এসব অর্থ।

১৮১২ সালে এ ধার্মিক দানবীর হুগলিতে ৭৯–৮০ বছর বয়সে (হুগলি, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত) ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।

হাজী মুহাম্মাদ মুহসীন বেঁচেছিলেন একজন আলেমে দ্বীনের মতো। আর মৃত্যুতে তাঁর নামের সঙ্গে ‘দাতা’ বা ‘দানবীর’ কথাটা যুক্ত হয়ে গেছে চিরকালের জন্য। আল্লাহ তার অবদান কবুল করে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।

[ লেখক : মোঃ হায়দার আলী, সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ও প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী।]