ঢাকা ০৬:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

আম্রাপালি আমের নামকরণের হাস্যরসাত্মক ইতিহাস

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৫:২৪:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ মে ২০২৩
  • / ৪৯৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
// মো: হায়দার আলী //
মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়।
এ জন্যই সমাজে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, শিক্ষার্থীরাও যুগে যুগে স্মরণ রাখেন।
 এসব নিয়ে লেখা শুরু করতেই মহিশালবাড়ি আল ইসলা ইসলামি একাডেমিতে বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার ছোট ছেলে আজিজ আরিফিন জীম বাজার থেকে আম্রপলি আম কিনে আনার জন্য বায়না ধরলো।  আমি মজা করে বললাম ওই আম সম্পর্কে আমি অবগত নয় ছোট আব্বু। তখন সে আমার স্মার্টফোনটি নিয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে আম্রপলি অমের ছবি ও ভিডিও দেখালো তাই লিখার থিম পরিবর্তন করে আম্রপলি আম সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত নিয়ে আল্লাহ নাম নিয়ে  লিখা শুরু করলাম। জানি না পাঠকগণ কতটা উপকৃত হবেন?
ব্যুৎপত্তিগতভাবে, তার নামের দুই অংশ দুটি সংস্কৃত শব্দের সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত: আম্র যার অর্থ আম এবং পল্লভা, যার অর্থ কচি পাতা বা শাখা। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজকীয় বাগানে আম গাছের পাদদেশে জন্মগ্রহণের জন্যই তার এমন নামকরণ হয়েছিল। তারুণ্যে আম্রপালি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন।
আম্রপালি, “আম্বপালিকা”, “আমবাপালি” বা “আম্র” নামেও পরিচিত, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রাচীন ভারতে বৈশালী (প্রাচীন শহর) প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান বিহারে অবস্থিত) প্রসিদ্ধ নগরবধূ বা রাজ বারাঙ্গনা তথা নর্তকী ছিলেন। বুদ্ধের উপদেশ অনুসরণ করে তিনি আরহান্ত হয়েছিলেন। পুরাতন পালি গ্রন্থ এবং বৌদ্ধ রীতিনীতিতে (আগাম সূত্র) তাঁর উল্লেখ রয়েছে, বিশেষতঃ বুদ্ধের সাথেই তাঁর সংযোগ পাওয়া যায়। আম্বপালি উদ্যানে তার সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন বুুুদ্ধ। পরে আম্রপালি তার আদেশে উদ্যানটি দান করেছিলেন এবং সেখানে বুদ্ধ তার বিখ্যাত আম্বপালিকা সূত্র প্রচার করেছিলেন।
আম্রপালি কিংবদন্তির উত্থান প্রায় ১৫০০ বছর আগে বৌদ্ধ জাতক গল্পে হয়েছিল।
স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই আম্রপালি আম খুবই প্রিয়। ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আম্রপামি। কিন্তু এই আমটার নামকরণ কোথা থেকে হলো ?
আম্রপালি জন্মেছিলো আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে ভারতে। সে ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী। যার রুপে পাগল ছিলো পুরো দুনিয়া। আর এই রুপই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। যার কারণে সে ছিলো ইতিহাসের এমন একজন নারী যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিলো !
আম্রপালি বাস করতেন বৈশালী শহরে। বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর যেটি বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত।
মাহানামন নামে এক ব্যক্তি শিশুকালে আম্রপালিকে আম গাছের নীচে খুজে পায়। তার আসল বাবা মা কে ইতিহাস ঘেটেও তা জানা যায়নি। যেহেতু তাকে আম গাছের নীচে পায় তাই তার নাম রাখে আম্রপামি। সংস্কৃতে আম্রমানে আম, এবং পল্লব হল পাতা। অর্থাৎ, আমগাছের নবীন পাতা।
কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা দিতেই আম্রপালিকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। তার রুপে চারপাশের সব মানুষ পাগল হয়ে যায়।
দেশ বিদেশের রাজপুত্র রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তার জন্য পাগলপ্রায়। নানা জায়গায় এ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া বিবাদের খবরও আসতে থাকে। সবাই তাকে একনজর দেখতে চায়, বিয়ে করতে চায়। এ নিয়ে আম্রপালির মা বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।
তারা তখন বৈশালীতে সকল গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করার জন্য বলেন। কারণ সবাই আম্রপালিকে বিয়ে করতে চায়। তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেয় তা হল, আম্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবেনা। কারণ তার রুপ। সে একা কারো হতে পারেনা। আম্রপালি হবে সবার সে হবে একজন নগরবধু মানে সোজা বাংলায় পতিতা।।
এটা ছিলো একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল !!
আম্রপালি সে সভায় ৫টি শর্ত রাখেন-
আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(১) নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার ঘর হবে
(২) তাঁর মূল্য হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(৩) একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবে
(৪ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তার গৃহে প্রবেশ করা যাবে
(৫) তার গৃহে কে এল গেলো এ নিয়ে কোন অনুসন্ধান করা যাবে না।
সবাই তার এসব শর্ত মেনে নেয়।
এভাবে দিনে দিনে আম্রপালি বিপুল ধন সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। আম্রপালি রুপের কথাও দেশ বিদেশে আরও বেশি করে ছড়াতে থাকে।
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। শোনা যায়, তার স্ত্রীর সংখ্যা নাকি ৫০০ ছিলো ! নর্তকীদের নাচের এক অনুষ্ঠানে বিম্বিসার এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা। তখন তার এক সভাসদ বলেন, “মহারাজ,এই নর্তকী আম্রপালির নখের যোগ্য নয়” !!
বিম্বিসারের এক কথাটি নজর এড়ায়নি। সে তার সভাসদ থেকে আম্রপালি সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করে, কিন্তু তার সভাসদ বলেন সেটা সম্ভব নয়। কারণ তাহলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে। আর আম্রপালির দেখা পাওয়াও এত সহজ নয়। দেশ বিদেশের বহু রাজা রাজপুত্র আম্রপালির প্রাসাদের সামনে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কিন্তু মন না চাইলে সে কাউকে দেখা দেয়না।
এত কথা শুনে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালিকে দেখে আসবে।কি এমন আছে সেই নারীর মাঝে, যার জন্য পুরো জাহান পাগল হয়ে আছে !
তারপর বহু চড়াই উৎরাই শেষে, রাজার আম্রপালির সাথে দেখা করার সুযোগ আসে আম্রপালির প্রাসাদ আম্রকুন্জে, কিন্তু দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে উঠেন এত কোন নারী নয়, যেন সাক্ষাৎ পরী! এ কোনভাবেই মানুষ হতে পারেনা। এত রুপ মানুষের কিভাবে হতে পারে !!!! কিন্তু অবাক রাজার জন্য আরও অবাক কিছু অপেক্ষা করছিলো কারণ আম্রপালি প্রথম দেখাতেই তাকে সে যে মগধ রাজ্যের রাজা বিম্বিসার কে চিনে ফেলে। এবং আম্রপালি জানায় সে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বহু আগে থেকেই।
 এ কথা শুনে রাজার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। রাজা সাথে সাথে তাকে তার রাজ্যের রাজরাণী বানানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আম্রপালি জানে, তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নিবেনা। উল্টো বহু মানুষের জীবন যাবে। রক্তপাত হবে। তাই তাকে দ্রত এখান থেকে চলে যেতে বলে। রাজা বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করে আম্রপালিকে পেতে চান, কিন্তু আম্রপালি তার নিজের রাজ্যের কোন ক্ষতি চাননা। তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
এদিকে বিম্বিসার এর সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালির প্রেমে মগ্ন ছিলেন। সে বিম্বিসারকে আটক করে নিজে সংহাসন দখল করে বসেন এবং আম্রপালিকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজেভাবে আহত হন। পরবর্তীতে আম্রপালির সেবায় সুস্থ্য হয়ে গোপনে তার নিজের রাজ্যে ফেরত যান। সেদিনও আম্রপালি অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
এত নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কি হলো ? গৌতম বুদ্ধর সময়কাল তখন, গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশো সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন। একদিন বৈশালী রাজ্যের রাবান্দা থেকে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে তার মনে ধরে গেলো। আম্রপালি ভাবলো দেশ বিদেশের রাজারা আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে আর এত সামান্য একজন মানুষ। সে সন্ন্যাসীকে ৪ মাস তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে বললেন। সবাই ভাবলো বুদ্ধ কখনোই রাজি হবেন না। কারণ, একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবে এটা হতেই পারেনা কিন্তু গৌতম বুদ্ধ সেদিন তাকে রাখতে রাজি হলো এবং এটাও বললো আমি শ্রমণের (তরুণ সে সন্ন্যাসীর নাম ছিলো) চোখে কোন কামনা বাসনা দেখছিনা। সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত !!
চার মাস শেষ। গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন। তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই। তবে কি আম্রপালির রুপের কাছেই হেরে গেলো শ্রমণ ?
সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন। তার পিছনে পিছনে আসেন একজন নারী। সেই নারীই ছিলেন আম্রপালি।
তিনি বলেন, তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি। কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালি।
আজ, সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান আম্রপালি !!! সব কিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী আম্রপালি।
আর এই আম্রপালি নারীর নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি ও নিলাম-এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন আম্রপালি।
আম্রপালির জীবনী নিয়ে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে: আম্রপালি (১৯৪৫) চলচ্চিত্রে সবিতা দেবী, জগদীশ শেঠি, প্রেম আদিব অভিনয় করেছিলেন। আম্রপালি (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে আম্রপালি চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবী এবং রাজা অজতশত্রু চরিত্রে অসিত বারান এবং আম্রপালি (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে বৈজয়ন্তীমালা আম্রপালি চরিত্রে  ও সুনীল দত্ত রাজা অজাতশত্রু হিসেবে অভিনয় করেছিলেন।
বলিউড অভিনেত্রী হেমা মালিনী প্রযোজিত, পরিচালিত এবং অভিনীত টেলিভিশন সিরিজ উইমেন অফ ইন্ডিয়ায় আম্রপালির গল্পটি চিত্রায়িত করা হয়েছিল যার সংগীতায়োজন করেছিলেন রবীন্দ্র জৈন ও হৃদয়নাথ মঙ্গেশকার।
আম্রপালী বিভিন্ন গ্রন্থের বিষয়বস্তুও হয়েছিলেন, যার মধ্যে আচার্য চতুরসেনের ১৯৪৮ সালের হিন্দি উপন্যাস বৈশালী কি নগরবধূ এবং বিমলা রায়নার ১৯৬২ সালের উপন্যাস আম্বাপালি সহ বিভিন্ন বই ছিল। ইংরেজিতে একটি সাম্প্রতিক কাজ, দ্য লিজেন্ড অফ আম্রপালি: এন এনচ্যান্টটিং সাগা ব্যরিড উইদিন দ্য স্যান্ডস অফ টাইম নামে লেখক অনুরাগ আনন্দ ২০১২ সালে সম্পন্ন করেছিলেন।
আম্রপালি নামে একটি টেলিভিশন সিরিজ ২০০২ সালে ডিডি ন্যাশনালে প্রচারিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ইরা মুখোতির লেখা ‘হিরোইনস’ গ্রন্থেও আম্রপালির উল্লেখ রয়েছে।
 ছোট  সাইজের এ আম,সবার কাছে প্রিয়। স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই আস্রপালী আম খুবই ভাল লাগে। আমটি ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন আমের রাজা ল্যাংড়া,  খিরসাপাত, ফজলিসহ সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আম্রপালি।
সে কালের বিশ্ব সুন্দরিকে নিয়ে নামকরণ করা আম্রপলি আম কে না খেতে চাই। তাইতো সবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়।
[লেখক : লেখক : প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী। সহঃ সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা, রাজশাহী।]
বা/খ: এসআর।

নিউজটি শেয়ার করুন

আম্রাপালি আমের নামকরণের হাস্যরসাত্মক ইতিহাস

আপডেট সময় : ০৫:২৪:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ মে ২০২৩
// মো: হায়দার আলী //
মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়।
এ জন্যই সমাজে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, শিক্ষার্থীরাও যুগে যুগে স্মরণ রাখেন।
 এসব নিয়ে লেখা শুরু করতেই মহিশালবাড়ি আল ইসলা ইসলামি একাডেমিতে বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার ছোট ছেলে আজিজ আরিফিন জীম বাজার থেকে আম্রপলি আম কিনে আনার জন্য বায়না ধরলো।  আমি মজা করে বললাম ওই আম সম্পর্কে আমি অবগত নয় ছোট আব্বু। তখন সে আমার স্মার্টফোনটি নিয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে আম্রপলি অমের ছবি ও ভিডিও দেখালো তাই লিখার থিম পরিবর্তন করে আম্রপলি আম সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত নিয়ে আল্লাহ নাম নিয়ে  লিখা শুরু করলাম। জানি না পাঠকগণ কতটা উপকৃত হবেন?
ব্যুৎপত্তিগতভাবে, তার নামের দুই অংশ দুটি সংস্কৃত শব্দের সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত: আম্র যার অর্থ আম এবং পল্লভা, যার অর্থ কচি পাতা বা শাখা। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজকীয় বাগানে আম গাছের পাদদেশে জন্মগ্রহণের জন্যই তার এমন নামকরণ হয়েছিল। তারুণ্যে আম্রপালি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন।
আম্রপালি, “আম্বপালিকা”, “আমবাপালি” বা “আম্র” নামেও পরিচিত, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রাচীন ভারতে বৈশালী (প্রাচীন শহর) প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান বিহারে অবস্থিত) প্রসিদ্ধ নগরবধূ বা রাজ বারাঙ্গনা তথা নর্তকী ছিলেন। বুদ্ধের উপদেশ অনুসরণ করে তিনি আরহান্ত হয়েছিলেন। পুরাতন পালি গ্রন্থ এবং বৌদ্ধ রীতিনীতিতে (আগাম সূত্র) তাঁর উল্লেখ রয়েছে, বিশেষতঃ বুদ্ধের সাথেই তাঁর সংযোগ পাওয়া যায়। আম্বপালি উদ্যানে তার সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন বুুুদ্ধ। পরে আম্রপালি তার আদেশে উদ্যানটি দান করেছিলেন এবং সেখানে বুদ্ধ তার বিখ্যাত আম্বপালিকা সূত্র প্রচার করেছিলেন।
আম্রপালি কিংবদন্তির উত্থান প্রায় ১৫০০ বছর আগে বৌদ্ধ জাতক গল্পে হয়েছিল।
স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই আম্রপালি আম খুবই প্রিয়। ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আম্রপামি। কিন্তু এই আমটার নামকরণ কোথা থেকে হলো ?
আম্রপালি জন্মেছিলো আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে ভারতে। সে ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী। যার রুপে পাগল ছিলো পুরো দুনিয়া। আর এই রুপই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। যার কারণে সে ছিলো ইতিহাসের এমন একজন নারী যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিলো !
আম্রপালি বাস করতেন বৈশালী শহরে। বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর যেটি বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত।
মাহানামন নামে এক ব্যক্তি শিশুকালে আম্রপালিকে আম গাছের নীচে খুজে পায়। তার আসল বাবা মা কে ইতিহাস ঘেটেও তা জানা যায়নি। যেহেতু তাকে আম গাছের নীচে পায় তাই তার নাম রাখে আম্রপামি। সংস্কৃতে আম্রমানে আম, এবং পল্লব হল পাতা। অর্থাৎ, আমগাছের নবীন পাতা।
কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা দিতেই আম্রপালিকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। তার রুপে চারপাশের সব মানুষ পাগল হয়ে যায়।
দেশ বিদেশের রাজপুত্র রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তার জন্য পাগলপ্রায়। নানা জায়গায় এ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া বিবাদের খবরও আসতে থাকে। সবাই তাকে একনজর দেখতে চায়, বিয়ে করতে চায়। এ নিয়ে আম্রপালির মা বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।
তারা তখন বৈশালীতে সকল গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করার জন্য বলেন। কারণ সবাই আম্রপালিকে বিয়ে করতে চায়। তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেয় তা হল, আম্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবেনা। কারণ তার রুপ। সে একা কারো হতে পারেনা। আম্রপালি হবে সবার সে হবে একজন নগরবধু মানে সোজা বাংলায় পতিতা।।
এটা ছিলো একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল !!
আম্রপালি সে সভায় ৫টি শর্ত রাখেন-
আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(১) নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার ঘর হবে
(২) তাঁর মূল্য হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(৩) একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবে
(৪ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তার গৃহে প্রবেশ করা যাবে
(৫) তার গৃহে কে এল গেলো এ নিয়ে কোন অনুসন্ধান করা যাবে না।
সবাই তার এসব শর্ত মেনে নেয়।
এভাবে দিনে দিনে আম্রপালি বিপুল ধন সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। আম্রপালি রুপের কথাও দেশ বিদেশে আরও বেশি করে ছড়াতে থাকে।
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। শোনা যায়, তার স্ত্রীর সংখ্যা নাকি ৫০০ ছিলো ! নর্তকীদের নাচের এক অনুষ্ঠানে বিম্বিসার এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা। তখন তার এক সভাসদ বলেন, “মহারাজ,এই নর্তকী আম্রপালির নখের যোগ্য নয়” !!
বিম্বিসারের এক কথাটি নজর এড়ায়নি। সে তার সভাসদ থেকে আম্রপালি সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করে, কিন্তু তার সভাসদ বলেন সেটা সম্ভব নয়। কারণ তাহলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে। আর আম্রপালির দেখা পাওয়াও এত সহজ নয়। দেশ বিদেশের বহু রাজা রাজপুত্র আম্রপালির প্রাসাদের সামনে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কিন্তু মন না চাইলে সে কাউকে দেখা দেয়না।
এত কথা শুনে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালিকে দেখে আসবে।কি এমন আছে সেই নারীর মাঝে, যার জন্য পুরো জাহান পাগল হয়ে আছে !
তারপর বহু চড়াই উৎরাই শেষে, রাজার আম্রপালির সাথে দেখা করার সুযোগ আসে আম্রপালির প্রাসাদ আম্রকুন্জে, কিন্তু দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে উঠেন এত কোন নারী নয়, যেন সাক্ষাৎ পরী! এ কোনভাবেই মানুষ হতে পারেনা। এত রুপ মানুষের কিভাবে হতে পারে !!!! কিন্তু অবাক রাজার জন্য আরও অবাক কিছু অপেক্ষা করছিলো কারণ আম্রপালি প্রথম দেখাতেই তাকে সে যে মগধ রাজ্যের রাজা বিম্বিসার কে চিনে ফেলে। এবং আম্রপালি জানায় সে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বহু আগে থেকেই।
 এ কথা শুনে রাজার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। রাজা সাথে সাথে তাকে তার রাজ্যের রাজরাণী বানানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আম্রপালি জানে, তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নিবেনা। উল্টো বহু মানুষের জীবন যাবে। রক্তপাত হবে। তাই তাকে দ্রত এখান থেকে চলে যেতে বলে। রাজা বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করে আম্রপালিকে পেতে চান, কিন্তু আম্রপালি তার নিজের রাজ্যের কোন ক্ষতি চাননা। তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
এদিকে বিম্বিসার এর সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালির প্রেমে মগ্ন ছিলেন। সে বিম্বিসারকে আটক করে নিজে সংহাসন দখল করে বসেন এবং আম্রপালিকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজেভাবে আহত হন। পরবর্তীতে আম্রপালির সেবায় সুস্থ্য হয়ে গোপনে তার নিজের রাজ্যে ফেরত যান। সেদিনও আম্রপালি অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
এত নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কি হলো ? গৌতম বুদ্ধর সময়কাল তখন, গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশো সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন। একদিন বৈশালী রাজ্যের রাবান্দা থেকে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে তার মনে ধরে গেলো। আম্রপালি ভাবলো দেশ বিদেশের রাজারা আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে আর এত সামান্য একজন মানুষ। সে সন্ন্যাসীকে ৪ মাস তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে বললেন। সবাই ভাবলো বুদ্ধ কখনোই রাজি হবেন না। কারণ, একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবে এটা হতেই পারেনা কিন্তু গৌতম বুদ্ধ সেদিন তাকে রাখতে রাজি হলো এবং এটাও বললো আমি শ্রমণের (তরুণ সে সন্ন্যাসীর নাম ছিলো) চোখে কোন কামনা বাসনা দেখছিনা। সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত !!
চার মাস শেষ। গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন। তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই। তবে কি আম্রপালির রুপের কাছেই হেরে গেলো শ্রমণ ?
সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন। তার পিছনে পিছনে আসেন একজন নারী। সেই নারীই ছিলেন আম্রপালি।
তিনি বলেন, তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি। কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালি।
আজ, সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান আম্রপালি !!! সব কিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী আম্রপালি।
আর এই আম্রপালি নারীর নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি ও নিলাম-এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন আম্রপালি।
আম্রপালির জীবনী নিয়ে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে: আম্রপালি (১৯৪৫) চলচ্চিত্রে সবিতা দেবী, জগদীশ শেঠি, প্রেম আদিব অভিনয় করেছিলেন। আম্রপালি (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে আম্রপালি চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবী এবং রাজা অজতশত্রু চরিত্রে অসিত বারান এবং আম্রপালি (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে বৈজয়ন্তীমালা আম্রপালি চরিত্রে  ও সুনীল দত্ত রাজা অজাতশত্রু হিসেবে অভিনয় করেছিলেন।
বলিউড অভিনেত্রী হেমা মালিনী প্রযোজিত, পরিচালিত এবং অভিনীত টেলিভিশন সিরিজ উইমেন অফ ইন্ডিয়ায় আম্রপালির গল্পটি চিত্রায়িত করা হয়েছিল যার সংগীতায়োজন করেছিলেন রবীন্দ্র জৈন ও হৃদয়নাথ মঙ্গেশকার।
আম্রপালী বিভিন্ন গ্রন্থের বিষয়বস্তুও হয়েছিলেন, যার মধ্যে আচার্য চতুরসেনের ১৯৪৮ সালের হিন্দি উপন্যাস বৈশালী কি নগরবধূ এবং বিমলা রায়নার ১৯৬২ সালের উপন্যাস আম্বাপালি সহ বিভিন্ন বই ছিল। ইংরেজিতে একটি সাম্প্রতিক কাজ, দ্য লিজেন্ড অফ আম্রপালি: এন এনচ্যান্টটিং সাগা ব্যরিড উইদিন দ্য স্যান্ডস অফ টাইম নামে লেখক অনুরাগ আনন্দ ২০১২ সালে সম্পন্ন করেছিলেন।
আম্রপালি নামে একটি টেলিভিশন সিরিজ ২০০২ সালে ডিডি ন্যাশনালে প্রচারিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ইরা মুখোতির লেখা ‘হিরোইনস’ গ্রন্থেও আম্রপালির উল্লেখ রয়েছে।
 ছোট  সাইজের এ আম,সবার কাছে প্রিয়। স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই আস্রপালী আম খুবই ভাল লাগে। আমটি ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন আমের রাজা ল্যাংড়া,  খিরসাপাত, ফজলিসহ সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আম্রপালি।
সে কালের বিশ্ব সুন্দরিকে নিয়ে নামকরণ করা আম্রপলি আম কে না খেতে চাই। তাইতো সবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়।
[লেখক : লেখক : প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী। সহঃ সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা, রাজশাহী।]
বা/খ: এসআর।