ঢাকা ০৭:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

“মধু হইহইষ বিষ খাওয়াইলা” গান ধরে

নৌকা বাইয়ে মধু সংগ্রহে বনে গেল মৌয়ালরা

শাহজাহান সিরাজ, কয়রা (খুলনা) থেকে
  • আপডেট সময় : ০৮:৩২:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪
  • / ৪৯৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মাথায় গামছা বেঁধে সারি সারি নৌকা চালিয়ে দল বেঁধে মধু আহরণ করতে ছুটছেন মৌয়ালরা। তাদের গন্তব্য গহীন সুন্দরবন। সুন্দরবনে মধু খোঁজা আর বাঘ খোঁজা সমান কথা! কারণ দুটোই গহীন জঙ্গলে থাকে। জঙ্গলের গহীনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর মৌমাছির কষ্টের ধন ‘মধু’ বনে জঙ্গলে ঘুরে খুঁজে বের করেন একদল মানুষ। তাদের আমরা ‘মৌয়াল’ নামে চিনি। কয়রা উপজেলার ৪ নং কয়রা, ৬ নং কয়রা, ৩ নং কয়রা, পল্লীমঙ্গল, গুড়িবাড়ী, শাকবাড়ীয়া জোড়মিং, বেনাপানি, আংটিহারা গোলখালী, মাটিয়া ভাঙগা, ঘড়িলাল, চরামুখা, মহেশ্বরীপুর, বানিয়াখালী এলাকার এক হাজার থেকে ১২শ’ মানুষ এই পেশাকে তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

তাদেরই একজন আঃ হামিদ। আঃ হামিদ মৌয়াল ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনের গহীনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। প্রতি বছর পয়লা এপ্রিল মৌয়ালরা শুরু করেন মধু সংগ্রহ অভিযান। এজন্য নিতে হয় স্থানীয় বন বিভাগ থেকে মধু সংগ্রহের বিশেষ অনুমতি। বহুকাল ধরে তারা স্থানীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে বাঘের ভয় জয় করে মধু নিয়ে আসেন বনের গভীর থেকে। মধু সংগ্রহ করতে স্থানীয় কৌশল সম্পর্কে সুন্দরবনের আরেক মৌয়াল সাহেব আলী, বিল্লাল জানান, প্রথমে খড়ের কাড়ুয়াতে ধোঁয়া দিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি সরিয়ে নিতে হয়। পরে মৌচাকের মধু সঞ্চিত অংশটুকু কেটে সংগ্রহ করা হয়। এরপর মৌচাক চিপে বা কচলে বের করে আনা হয় সুস্বাদু মধু।

আঃ হামিদ জানান, মধু সংগ্রহের জন্য তারা পাঁচ সদস্যের টিম ছোটনৌকায় করে সুন্দরবনের ভেতরে চলে যান। একজন নৌকায় থাকেন। বাকিরা জঙ্গলের ভেতর ছড়িয়ে পড়েন। বনের ভেতরে খুজেঁ খুজেঁ বের করেন গাছের ডালে ঝুলে থাকা মৌচাক। কোনো একজন পথ হারালে ‘কু’ সংকেত দিয়ে খুঁজে নেন সঙ্গীকে। মৌয়াল দলের মধু সংগ্রহের অভিযান চলে এক থেকে দেড় মাস। ফলে তারা সঙ্গে নিয়ে যান চাল, ডাল, তেল, খাবার পানি, পেঁয়াজ, মরিচসহ পুরো মাসের খাবার। রাত্রী যাপনের জন্য নেন কাঁথা-বালিশও। আঃ হামিদ জানান, সাধারণত সুন্দরবনের পশুর গাছ, খলিশা ফুল গাছ ও বাইন গাছ, গরান গাছ ও কেওড়া গাছে মৌচাক বেশি পাওয়া যায়। মধু সংগ্রহকারী প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি চাকের মধু সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতি চাকে ৩, ৪ ,৫ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। জনপদে এই মধু বিক্রি করতে পারেন সাড়ে ৫শ থেকে ৬শত টাকা পর্যন্ত। প্রতি টিম এক মাসে প্রায় ১৬ মণ পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবনের মধু ঘিরে গড়ে উঠেছে কাশিয়াবাদ, বানিয়াখালী, ঘড়িলাল এলাকায় মধুর মোকাম। যেখান থেকে মধু ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। এই পেশাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে বাঘের ভয়, অন্যদিকে জলদস্যুদের ভয়। আর মৌমাছির কামড় তো সাধারণ ঘটনা।

কাশিয়াবাদ ফরেষ্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বলেন, বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করেছেন তারা। দেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ মৌসুম চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। সোমবার (১ এপ্রিল) থেকে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের মৌয়ালরা মধু মহলে প্রবেশ করেছেন। এ বছর সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই হাজার কুইন্টাল। আর মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৫০ কুইন্টাল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৌয়ালরা বনে প্রবেশ করার পর মধু আহরণের জন্য মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছি তাড়াতে অগ্নিকুÐ, বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে পারবেন তাদের জন্য মোট নয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা অমান্য করেল তার বিরুদ্ধে বন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান আছে।

বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ কেজি মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়। মধু ও মোম থেকে রাজস্ব আদায় হয় ৪৬ লাখ ৮৬ হাজার ৪১৩ টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কেজি মধু থেকে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০৫ কেজি মোম থেকে ১৩ লাখ ৩৯০ হাজার ৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়।

২০২২ সালে সুন্দরবনের মধু থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং মোম থেকে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ২০০ টাকা। সে বছর সুন্দরবন থেকে ২ হাজার ৩২০ কুইন্টাল মধু ও ৬৯৬ কুইন্টাল মোম পাওয়া যায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

“মধু হইহইষ বিষ খাওয়াইলা” গান ধরে

নৌকা বাইয়ে মধু সংগ্রহে বনে গেল মৌয়ালরা

আপডেট সময় : ০৮:৩২:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪

মাথায় গামছা বেঁধে সারি সারি নৌকা চালিয়ে দল বেঁধে মধু আহরণ করতে ছুটছেন মৌয়ালরা। তাদের গন্তব্য গহীন সুন্দরবন। সুন্দরবনে মধু খোঁজা আর বাঘ খোঁজা সমান কথা! কারণ দুটোই গহীন জঙ্গলে থাকে। জঙ্গলের গহীনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর মৌমাছির কষ্টের ধন ‘মধু’ বনে জঙ্গলে ঘুরে খুঁজে বের করেন একদল মানুষ। তাদের আমরা ‘মৌয়াল’ নামে চিনি। কয়রা উপজেলার ৪ নং কয়রা, ৬ নং কয়রা, ৩ নং কয়রা, পল্লীমঙ্গল, গুড়িবাড়ী, শাকবাড়ীয়া জোড়মিং, বেনাপানি, আংটিহারা গোলখালী, মাটিয়া ভাঙগা, ঘড়িলাল, চরামুখা, মহেশ্বরীপুর, বানিয়াখালী এলাকার এক হাজার থেকে ১২শ’ মানুষ এই পেশাকে তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

তাদেরই একজন আঃ হামিদ। আঃ হামিদ মৌয়াল ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনের গহীনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। প্রতি বছর পয়লা এপ্রিল মৌয়ালরা শুরু করেন মধু সংগ্রহ অভিযান। এজন্য নিতে হয় স্থানীয় বন বিভাগ থেকে মধু সংগ্রহের বিশেষ অনুমতি। বহুকাল ধরে তারা স্থানীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে বাঘের ভয় জয় করে মধু নিয়ে আসেন বনের গভীর থেকে। মধু সংগ্রহ করতে স্থানীয় কৌশল সম্পর্কে সুন্দরবনের আরেক মৌয়াল সাহেব আলী, বিল্লাল জানান, প্রথমে খড়ের কাড়ুয়াতে ধোঁয়া দিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি সরিয়ে নিতে হয়। পরে মৌচাকের মধু সঞ্চিত অংশটুকু কেটে সংগ্রহ করা হয়। এরপর মৌচাক চিপে বা কচলে বের করে আনা হয় সুস্বাদু মধু।

আঃ হামিদ জানান, মধু সংগ্রহের জন্য তারা পাঁচ সদস্যের টিম ছোটনৌকায় করে সুন্দরবনের ভেতরে চলে যান। একজন নৌকায় থাকেন। বাকিরা জঙ্গলের ভেতর ছড়িয়ে পড়েন। বনের ভেতরে খুজেঁ খুজেঁ বের করেন গাছের ডালে ঝুলে থাকা মৌচাক। কোনো একজন পথ হারালে ‘কু’ সংকেত দিয়ে খুঁজে নেন সঙ্গীকে। মৌয়াল দলের মধু সংগ্রহের অভিযান চলে এক থেকে দেড় মাস। ফলে তারা সঙ্গে নিয়ে যান চাল, ডাল, তেল, খাবার পানি, পেঁয়াজ, মরিচসহ পুরো মাসের খাবার। রাত্রী যাপনের জন্য নেন কাঁথা-বালিশও। আঃ হামিদ জানান, সাধারণত সুন্দরবনের পশুর গাছ, খলিশা ফুল গাছ ও বাইন গাছ, গরান গাছ ও কেওড়া গাছে মৌচাক বেশি পাওয়া যায়। মধু সংগ্রহকারী প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি চাকের মধু সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতি চাকে ৩, ৪ ,৫ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। জনপদে এই মধু বিক্রি করতে পারেন সাড়ে ৫শ থেকে ৬শত টাকা পর্যন্ত। প্রতি টিম এক মাসে প্রায় ১৬ মণ পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবনের মধু ঘিরে গড়ে উঠেছে কাশিয়াবাদ, বানিয়াখালী, ঘড়িলাল এলাকায় মধুর মোকাম। যেখান থেকে মধু ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। এই পেশাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে বাঘের ভয়, অন্যদিকে জলদস্যুদের ভয়। আর মৌমাছির কামড় তো সাধারণ ঘটনা।

কাশিয়াবাদ ফরেষ্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বলেন, বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করেছেন তারা। দেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ মৌসুম চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। সোমবার (১ এপ্রিল) থেকে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের মৌয়ালরা মধু মহলে প্রবেশ করেছেন। এ বছর সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই হাজার কুইন্টাল। আর মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৫০ কুইন্টাল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৌয়ালরা বনে প্রবেশ করার পর মধু আহরণের জন্য মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছি তাড়াতে অগ্নিকুÐ, বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে পারবেন তাদের জন্য মোট নয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা অমান্য করেল তার বিরুদ্ধে বন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান আছে।

বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ কেজি মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়। মধু ও মোম থেকে রাজস্ব আদায় হয় ৪৬ লাখ ৮৬ হাজার ৪১৩ টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কেজি মধু থেকে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০৫ কেজি মোম থেকে ১৩ লাখ ৩৯০ হাজার ৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়।

২০২২ সালে সুন্দরবনের মধু থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং মোম থেকে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ২০০ টাকা। সে বছর সুন্দরবন থেকে ২ হাজার ৩২০ কুইন্টাল মধু ও ৬৯৬ কুইন্টাল মোম পাওয়া যায়।