মাছ সংকটে বন্ধের পথে উল্লাপাড়ার শুঁটকির চাতাল
- আপডেট সময় : ০৭:৫২:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
- / ৪১১ বার পড়া হয়েছে

উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা : দেশের সর্ববৃহৎ বিল ‘চলনবিল’ অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় মাছ সংকটে ভুগছে শুটকি চাষীরা। পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুঁটকির চাতাল। ফলে শুঁটকি চাষীরা চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছে।
একদিকে বন্যার পানি দ্রুত কমে যাওয়া ও অন্যদিকে কারেন্ট, মশুরি, বেড়জাল, বাদাই জাল ও বিশেষত: অবৈধ চায়না দোয়ার দিয়ে নির্বিচারে পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নিধনের কারণে বর্তমানে মাছের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে ।
এতিকে, শুঁটকি করতে পর্যাপ্ত মাছের প্রয়োজন হলেও কাঙ্খিত পরিমান মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। মাছ সংকটের কারণে শুঁটকির চাতালগুলো থেকে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। ফলে বেকার হয়ে পড়া চাতাল শ্রমিকেরা তাদের জীবন জীবীকার প্রশ্নে চোখেমুখে সর্ষের ফুল দেখছেন।
জানা গেছে, প্রতিবছর উপজেলার বিভিন্ন চচতালে ১শ’র বেশী নারী শ্রমিক শুঁটকির চাতালে কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করতো। কিন্তু মাছ সংকটের কারণে চলতি বছরে তদস্থলে মাত্র ২০/২৫ জন নারী শ্রমিক শুঁটকির চাতালে কাজ করছে। বাঁকি শ্রমিক ছাঁটাই করায় তারা বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।
উল্লাপাড়া উপজেলার মোহনপুর, বড় পাঙ্গাসী কলেজ এলাকায় ও বড় পাঙ্গাসীর বেশ কয়েকটি এলাকাসহ মোহনপুর উধুনিয়া সড়কের দু’ধারে প্রায় আড়াই যুগ পূর্ব থেকেই মাছ শুঁটকি করার চাতাল গড়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই মাছ শুকানোর ধুম শুরু হয়ে যায় শুটকির চাতালগুলোতে। কর্মীদের কার্মব্যস্ততা চলে চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত।
গত কয়েক বছরেই বহু সংখ্যক চাতাল গড়ে উঠে ওই এলাকাগুলোতে। বর্ষা মৌসুমে চলে জমজমাট শুঁটকির ব্যবসা । চলতি বছরেও এ জায়গাগুলোতে নতুন চাতাল বসানো হলেও মাছ সংকটে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে শুটকি চাষীরা। বন্ধের পথে অনেক শুটকি চাতাল।
চাতাল মালিকরা জানান, প্রতিদিন ভোরে স্থানীয় লাহিড়ী মোহনপুর পাইকারী মাছ বাজারের আড়ৎ থেকে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা দেশীয় নানা জাতের মাছ পাইকারি দরে কিনে আনেন। দেশীয় পুঁটি, টেংরা, চাঁদা, বাইমসহ নানা জাতের ছোট মাছ কিনে এনে বাঁশের তৈরি মাচার উপর ছড়িয়ে রোদে শুকিয়ে শুটকি করা হয়। শুটকি হওয়ার পর আধুনিক পদ্ধতিতে প্যাকেট জাত করা হয়। উপজেলার সর্বত্র এলাকায় বিক্রেয় সাথে সাথে বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, সৈয়দপুর, রংপুর, পঞ্চগড় সহ উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলোর বিভিন্ন বাজারে পাইকারি দরে বিক্রি করেন তারা।
উপজেলার মোহনপুর এলাকায় প্রায় পনের জন শুটকি মাছের ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। শুঁটকি মাছ সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে চলতি বছরে চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এ বছরে মাছের সংকট দেখা দেওয়ায় দিশেহারা হয়ে পরেছেন শুটকি চাষি ও শুটকি ব্যবসায়ীরা।
শুঁটকি ব্যবসায়ী আ. মতিন জানান, বর্ষার পানি না শুকানো পর্যন্ত চাতালগুলো চালু থাকে। এসময় শুটকি শুকানোর জন্য সহস্রাধিক পরিবার চাতালগুলোতে কাজ করেন। কিন্তু আগের মত সেই কর্ম চঞ্চলতা এখন নেই। কারণ এবার বন্যার পানিতে পর্যাপ্ত মাছ নেই । মাছের সংকটের কারণে চলতি বছর শুঁটকির উৎপাদনও কম হবে।
দেড় থেকে দু’যুগ ধরে শুটকি মাছের ব্যবসার সাথে জড়িত ফরহাদ সরকার , আউয়াল প্রামাণিক, হবিবর শেখ, সাচ্চু মন্ডল, রফিকুল ইসলাম, শাহ আলম, নজরুল ইসলাম জানান, চাতালগুলোয় মাছ শুকানো থেকে শুরু করে বাছাইয়ের যাবতীয় কাজে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। এরা সবাই ২’শ টাকা দিন হাজিরায় শুটকির চাতালে ভোর ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত কাজ করেন। তবে এবছর মাছ না পাওয়ায় তারাও সঠিক ভাবে কাজ করতে পারছে না। এতে করে তাদেরও জীবিকার নির্বাহের সমস্যা হয়ে দ্বাড়িয়েছে।
কর্মী মহিরন বেগম, আছিয়া খাতুন জানান, তাদের সংসারের অভাব-অনটন দূর করার লক্ষে বাড়তি আয়ের জন্য শুটকির চাতালগুলোতে কাজ করতেন। কিন্তু এ বছর মাছ সংকট দেখা দেয়ার তারা চাতালগুলোতে আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না।
মোহনপুর শুটকি চাতাল মালিকরা জানান, মোহনপুর এলাকা থেকে প্রতি বছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচশো মন শুটকি মাছ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়। এ বছর মাছ না পাওয়ায় প্রতিবছরের অর্ধেক পরিমান শুটকি মাছ বিক্রি করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এবারে স্বাভাবিক বর্ষা না হওয়ায় মাছ মেলেনি। আবার মৌসুম পেরিয়ে অনেকটা অসময়ে স্বাভাবিক বর্ষা হলেও পানি থেকেছে মাত্র ক’দিন। তার উপর বর্ষা আসতে না আসতেই কারেন্ট জাল, বাদাই, চায়না জাল দিয়ে মাছ নিধন করা হচ্ছে। বিশেষ করে পোনা মাছ নিধন করার ফলে মাছ সংকট দেখা দেওয়ার মূল কারন বলে মনে করছেন শুটকি ব্যবসায়ী ও সচেতন মহল। সব মিলিয়ে পর্যাপ্ত মাছ না মেলায় চাতালগুলো কোনোমতে চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বায়েজিদ আলম জানান, এ বছর বন্যা পানি বেশি দিন না থাকায় দেশি জাতের মাছ তেমন পাওয়া যায়নি। তবে দেশি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার সেগুলো আমরা করার চেষ্টা করছি। সেই সাথে কারেন্ট জাল, বাদাই, চায়না জাল এগুলোর অবৈধ ব্যবহারে আমরা আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করেছি।
গত বছর এ উপজেলায় প্রায় পনে দুই কোটি টাকা মূল্যের উনসত্তর মেট্রিক টন শুটকি মাছ উৎপাদন করা হয়েছিলো। তবে চলতি বছর শুটকি উৎপাদন নিয়ে অনেকটাই সংশয় রয়েছে।