ঢাকা ১০:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ব্রিটিশ যুগে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হাজারদুয়ারি

মোঃ হায়দার আলী (ভারতের হাজারদুয়ারী থেকে)
  • আপডেট সময় : ০২:২৩:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৮৬২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কি বিষয়ে লিখব, তা চন্তা করছিলাম, শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম এবার দেশের  হরতাল, অবরোধ, আগামি সংসদ নির্বাচন, দেশী, বিদেশীদের চাপসহ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে লেখার চিন্তা ভাবনা করলাম কিন্তু হাঠাৎ করে ভারতের কলিকাতা চলে এলাম। তাই এ সম্পর্কে লিখা হলো না। আমার এক ভ্যাগনে ও সহযাত্রী এক প্রধান শিক্ষকের সাথে ঘুরতে আসলাম হাজার দুয়ারী। লিখার থিম পরিবর্তন করে এ সম্পর্কে  লিখার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করলাম।

বাঙালি যেমন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তেমনি কোন ভ্রমণপিপাসু বাঙালির মন সবসময়ই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাঁধন ভেঙ্গে মুখোমুখি হতে চায় নতুন কোন সাংস্কৃতিক জগতের। আর পৃথিবীতে সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্য উভয়েরই শিকড় প্রোথিত থাকে অতীত ইতিহাসের অন্তঃস্থলে। তাই ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের আগ্রহ বাঙালির সর্বকালের।

ব্রিটিশ যুগে বাংলার এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হল হাজারদুয়ারি। বিশালাকার এই প্রাসাদে প্রত্যেকটি হলঘর অনুপম সৌন্দর্যের আলোকে সজ্জিত। বাংলার নবাবি আমলে স্থাপত্যকলার এক উজ্জল প্রতিফলন হল এই হাজারদুয়ারি প্রাসাদ।

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ এখন ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এখানে দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের জন্য একটি অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানে মাসে অন্তত ৭০ হাজার  মানুষ এর অনুগমন হয়, হাজারদুয়ারির অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় লালবাগ নামক অঞ্চলে। এর পাশ দিয়ে ভাগীরথী আপন রূপ নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বহুদূরে। সাধারণত এই প্রাসাদটি বহু দরজাবিশিষ্ট বলে তাই একে ‘হাজারদুয়ারি’ নামকরণ করা হয়ে থাকে। বাইরে থেকে ও ভিতর থেকে হাজারদুয়ারিতে অনেক দরজা দৃশ্যমান হলেও এর মধ্যে অনেক দরজাই আদপে নকল। অথচ দূর থেকে পুরোপুরি আসল বলে মনে হয়। হাজারদুয়ারির চমক শুধু তার দুয়ারেই না, ঘরগুলোও মনোমুগ্ধকর।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি রাজপ্রাসাদ।এই প্রাসাদে অনেক দরজা আছে৷ তার থেকেই প্রাসাদের এই নামকরণ হয়েছে৷ অবশ্য সব দরজা সত্য নয়, অনেক নকল দরজাও রয়েছে ৷

বাংলার নবাবদের রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুঘলদের অধীনে যখন সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা, ওই রকম সময়ে সম্রাট ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন অবশ্য মুর্শিদকুলির নাম ছিল করতলব খাঁ। করতলবের সততা এবং দক্ষতা সম্রাটকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি করতলব খাঁকে ভাগীরথী গঙ্গার তীরে মকসুদাবাদে রাজধানী সরানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধি প্রধান করেছিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব, মকসুদাবাদের নাম পাল্টে মুর্শিদাবাদ করার অনুমতিও দেন তার সঙ্গে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী সরিয়ে আনেন। ততদিনে তিনি বাংলার সুবাহদার। দিল্লির রাজশক্তি তখন ক্রমশ ক্ষয় পাচ্ছে, সেই সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতেন। হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নবাব।

ব্রিটিশ যুগে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হাজারদুয়ারি

১৭শ শতাব্দী থেকে ইংরেজ শাসনের আগে পর্যন্ত সুবা বাংলা, বিহার ও ওড়িষার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ শহর৷ এখানে রাজত্ব করতেন নবাবরা ৷এখানকার নবাব হুমায়ুন জা ইউরোপিয় স্থপতি দিয়ে এই প্রাসাদ বানান৷ অনেকে ভুল করে ভাবেন যে, এই প্রাসাদ বুঝি নবাব সিরাজউদ্দৌলার দৌলার তৈরি। এই প্রাসাদ তৈরী হয় সিরাজ জমানার পরে। সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল হীরাঝিল প্রাসাদ৷ তা এখন ভাগীরথী নদীতে তলিয়ে গেছে৷ এই প্রাসাদ ইউরোপিয় ধাঁচে বানানো। এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত৷ তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় নানা অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা ছিল।

বর্তমানে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এখানে একটা সংগ্রহশালা বানিয়েছেন৷ তবে দুর্বল কাঠামোর জন্য দর্শকদের তিনতলায় উঠতে দেওয়া হয় না৷ শুক্রবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকে।

এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত৷ তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় নানা অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা ছিল। বর্তমানে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এখানে একটা সংগ্রহশালা বানিয়েছেন৷ তবে দুর্বল কাঠামোর জন্য দর্শকদের তিনতলায় উঠতে দেওয়া হয় না।

তারপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বাংলার মসনদে বসেছেন সুজাউদ্দিন, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, সিরাজ-উদ-দৌলা। সিরাজকে পরাজিত করে ১৭৫৭ সালে বাংলার দখল নিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মিরজাফরকে নবাব বানাল তারা। তারপর মিরকাশিম নবাব হলেন, তারপর আবার মিরজাফর। ততদিনে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরোপুরি ব্রিটিশদের দখলে। একের পর এক পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে মুর্শিদাবাদ। সেই জীবন্ত সাক্ষীকে চাক্ষুস দেখতে পর্যটকরা মুর্শিদাবাদে ভিড় জমান।

মুর্শিদাবাদে দর্শনীয় স্থানগুলির তালিকায় মধ্যে পর্যটকরা সবার আগে রাখেন হাজারদুয়ারি প্রাসাদকে। এই দুর্গপ্রাসাদ যেখানে অবস্থিত, সেই পুরো চত্বরটাকে বলে নিজামত কিলা বা কিলা নিজামত। হাজারদুয়ারি ছাড়াও ইমামবাড়া, ঘড়ি ঘর, মদিনা মসজিদ, চক মসজিদের মতো বেশ কিছু স্থাপত্য রয়েছে কিলা নিজামত এলাকায়।

জানা যায়, নবাব নাজিম হুমায়ুন জা তৈরি করিয়েছিলেন হাজারদুয়ারি। ১৮২৯ সালে তিনি এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গোটা স্থাপত্যের রূপকার ছিলেন ডানকান ম্যাকলিওড। দেখলেই বোঝা যায়, এই প্রাসাদের স্থাপত্যশৈলী ইউরোপীয় ঘরানার, বিশেষ করে ইতালীয় রীতির সৌধগুলোর সঙ্গে মিল প্রচুর। ১৮৩৭ সালে মুর্শিদাবাদের প্রধান আকর্ষণ হাজারদুয়ারির নির্মাণকার্য শেষ হয়।

৪১ একর জায়গা নিয়ে এই প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ১ হাজারটা দরজা আছে বলে এর নাম হাজারদুয়ারি। অবশ্য দরজাগুলির মধ্যে ১০০ টাই নকল। তবে চট করে দেখে নকল দরজাগুলোকে চিহ্নিত করা বেশ মুশকিল। দেওয়ালের মধ্যে এমনভাবে ডিজাইন করা, বাইরে থেকে দেখলে হুবহু আসল দরজা মনে হবে। দুর্গপ্রাসাদে যদি হঠাৎ করে শত্রুরা আক্রমণ করে বসে, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যই নকল দরজাগুলো বানানো হয়েছিল। সাধারণভাবে প্রাসাদটি হাজারদুয়ারি নামে প্রচলিত হলেও, হুমায়ুন জা একে ‘বড়ো কুঠি’ নামেই ডাকতো

এখন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে প্রাসাদটির মধ্যে জাদুঘর গড়ে উঠেছে। বাংলার নবাব, অভিজাত এবং ব্রিটিশদের ব্যবহৃত ও শৌখিন নানা জিনিস স্থান পেয়েছে এখানে। রয়েছে তখনকার আসবাব, বাসনপত্র, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি, নবাবি আমলের বই, পুঁথিপত্র। যেমন আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপি এবং সোনা দিয়ে মোড়া কোরান শরিফ। ২ হাজারেরও বেশি অস্ত্রের সম্ভার আছে। তার মধ্যে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র যেমন দেখা যায়, তেমনই দর্শকদের জন্য রাখা হয়েছে সেই ছুরি, যা দিয়ে মহম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করেছিলেন। আলিবর্দি খাঁ এবং সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ারও সেখানে দেখতে পাবেন। আরো যে কত কিছু রয়েছে, বলে শেষ করা যাবে না। গোটা জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য জাদুঘর খোলা থাকে।

হাজারদুয়ারির ঠিক বিপরীতে রয়েছে নিজামত ইমামবাড়া। মহরমের দিন এটি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাকি দিনগুলি এই স্থাপত্য কেবল বাইরে থেকেই দেখতে পাবেন। হাজারদুয়ারির প্রাঙ্গণেই আছে বিখ্যাত ঘড়ি মিনার। প্রাসাদের সামনেই দেখতে পাবেন বাচ্চাওয়ালি তোপ। কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল খোশবাগ, মোতঝিল, কাটরা মসজিদ, নসিপুর প্রাসাদ, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ি ইত্যাদি। তবে এগুলির বিভিন্ন স্থানে ২০/২৫ রুপি টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।  সবস্থান  গুলিতে ব্যপকহারে ইতিহাস বিক্রিত করা হয়েছে, বিভিন্নভাবে মূর্তি তৈরী করে রাখা হয়েছে,  সত্যি দুঃখজনক,  অনেকের ধারনা এক সময় মসুলমানদের জিনিসের অস্তিত্ব থাকবে না। এক শ্রেনীর প্রভাবশালী মানুষ জমিজায়গা দখল করে নির্মান করছেন ঘর, বাড়ী, দোকান, হোটেল,, লজ।

এখানে আগত মানুষদের সুয়োগ  সুবিধার দারুন  অভাব রয়েছে। শুধু কি তাই সুকৌশলে মাস্তানী ও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে কথিত গাইডার দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে  হাজার হাজার রুপি, সহজ সরল ভ্রমন পিপাসুরা বাধ্য হয়েই প্রতারিত হচ্ছেন।

কিভাবে যাওয়া যায়ঃ ট্রেনে যেতে চাইলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার কিংবা ভাগীরথী এক্সপ্রেস অথবা কলকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে টিকিট কেটে  নামতে হবে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে। এছাড়া এসপ্ল্যানেড থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার বাস পাওয়া যায়।

থাকার স্থানঃ বহরমপুরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের বহর ট্যুরিজম প্রপার্টি। সেখানে থেকেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে পারেন। বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ১১ কিলোমিটারের মতো। এছাড়া মুর্শিদাবাদ শহরেও বেশ কিছু হোটেল এবং রিসর্ট,লজ রয়েছ।

মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারীতে কি হাজারটা দরজা আছে? হাজার দুয়ারীর ইতিহাস কী?

হাজারদুয়ার কথাটির অর্থ ১,০০০টি দরজা। সুতরাং, হাজারদুয়ারিতে ১,০০০টি দরজাই আছে। তবে এদের মধ্যে ১০০টি দরজা কিন্তু কৃত্রিম, দেয়ালের গায়ে দরজার অনুকরণে ছবি আঁকা।তাই সত্যিকারের দরজা আছে ৯০০টি। সুতরাং, আক্ষরিক অর্থে এখানে ১,০০০টি দরজা থাকলেও সবগুলি আসল দরজা নয়।

ভাগীরথী নদীর তীরে ১২ বিঘা জমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৮০ ফুট উচ্চতার হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। এর বর্তমান নাম হাজারদুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম। এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ ১৮২৯ সালে শুরু হয়ে ১৮৩৭ সালে শেষ হয়। মূল স্থপতি ছিলেন ডানকান ম্যাকলয়েড। নবাব নাজিম হুমায়ুনজার আদেশ অনুযায়ী তার তত্ত্বাবধানে প্রাসাদটি নির্মিত হয়। বাঙালি সগুর মিস্ত্রী ছিলেন তার সহকারী। এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখি, সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে এই প্রাসাদ তৈরি হয়। সুতরাং, সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাজারদুয়ারির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। হাজারদুয়ারি ভাল করে দেখতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। ত্রিতল প্রাসাদটির প্রথমতলে আছে অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি ও রেকর্ড রুম। অস্ত্রাগারে মোট ২,৬০০টি অস্ত্র আছে। এখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত মহম্মদী বেগের অস্ত্র, পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত মীরমদনের কামান ছাড়াও অনেক রকমের অস্ত্র রাখা আছে। আছে আলীবর্দী খাঁয়ের ব্যবহার করা তলোয়ার ও বহুনলা বন্দুক, মীরকাসিমের ছোরা, নাদির শাহের মাথার বর্ম, বিভিন্ন ধরন ও আকারের কামান, বিভিন্ন ধরনের ছোরা-সহ দুর্লভ সংগ্রহ।

‘একতলা প্যালেসের সামনের বিশাল সিঁড়িটি দরবার পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে লম্বা গোলাকার স্তম্ভে সুন্দর নকশার কাজ। সিঁড়ির দু’পাশে দুটি সিংহ মূর্তি ও দুটি ছোট সেলামি কামান। তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা। দোতলা ও তৃতীয় তলায় আর্ট গ্যালারি ও লাইব্রেরি। গ্যালারিতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা আছে এখানে। লাইব্রেরিতে রয়েছে বহু ধর্মপুস্তক, চুক্তিপত্র, নাটক, উপন্যাস, তাম্রলিপি, ইতিহাস, প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ, বিদেশি ভাষার গ্রন্থ ইত্যাদি।

সম্রাট আকবরের সময়কার আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপি ও বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হাতে লেখা ‘কোরান শরীফ’ আছে এখানে। এছাড়াও আছে নবাব আর ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু অস্ত্র, বাসন, আসবাব, বহু বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি রয়েছে। প্যালেসের সামনে রয়েছে মনোরম বাগান।

‘হাজারদুয়ারির ঠিক মুখোমুখি রয়েছে বড়া ইমামবরা। হাজারদুয়ারি ও ইমামবরার মাঝখানে মদিনা মসজিদ। সিরাজউদ্দৌলার তৈরি করা স্থাপনার মধ্যে শুধু এই মসজিদটিই টিকে আছে। মদিনা মসজিদের সামনে বাঁধানো বেদীর ওপর রাখা আছে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের বাচ্চাওয়ালি কামান। ‘ শোনা যায়, এই কামান ১৩-১৪ শতকে গৌড়ের কোনও নবাবের আমলে বানানো হয়েছিল। কেউ বলেন এটি বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের কামান। তবে সবচেয়ে চালু মতটি হল, ১৬৪৭ সালে এটি বানিয়েছিলেন ঢাকার বিশিষ্ট লোহার মিস্ত্রি জনার্দন কামার। এই কামান দাগার জন্য ১৮ সের বারুদের প্রয়োজন হত। প্রশ্ন হল, কামানের নাম বাচ্চাওয়ালি কামান হল কেন? শোনা যায়, এই কামান দাগা হয়েছিল মাত্রই একবার। কিন্তু সেই তোপ দাগার শব্দ এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে আশেপাশের অনেক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত ঘটে যায়। সেই থেকে কামানের নাম বাচ্চাওয়ালি।

‘হাজারদুয়ারির সামনের পূর্ব পাশে আকাশছোঁয়া ঘড়ি ঘর পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুর্শিদাবাদবাসী ও ভাগীরথী নদীতে চলাচলকারী যাত্রীবাহী নৌকা ও জলযানের মাঝি-মল্লার ও যাত্রীদের সুবিধার্থে ঘড়িটি নির্মাণ করা হয়।’

ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও সংস্কারের অভাবে অনেক কিছু ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে, দেখার জন্য কেউ নেই। ঐতিহাসিক  তাৎপর্যপূর্ণ হাজার দুয়ারীর ইতিহাস বিকৃতি থেকে এর সংস্কার ও উন্নয়ন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সচেতন মহল।।

[লেখক : মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী। ও সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ]
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নিউজটি শেয়ার করুন

ব্রিটিশ যুগে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হাজারদুয়ারি

আপডেট সময় : ০২:২৩:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ নভেম্বর ২০২৩

কি বিষয়ে লিখব, তা চন্তা করছিলাম, শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম এবার দেশের  হরতাল, অবরোধ, আগামি সংসদ নির্বাচন, দেশী, বিদেশীদের চাপসহ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে লেখার চিন্তা ভাবনা করলাম কিন্তু হাঠাৎ করে ভারতের কলিকাতা চলে এলাম। তাই এ সম্পর্কে লিখা হলো না। আমার এক ভ্যাগনে ও সহযাত্রী এক প্রধান শিক্ষকের সাথে ঘুরতে আসলাম হাজার দুয়ারী। লিখার থিম পরিবর্তন করে এ সম্পর্কে  লিখার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করলাম।

বাঙালি যেমন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তেমনি কোন ভ্রমণপিপাসু বাঙালির মন সবসময়ই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাঁধন ভেঙ্গে মুখোমুখি হতে চায় নতুন কোন সাংস্কৃতিক জগতের। আর পৃথিবীতে সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্য উভয়েরই শিকড় প্রোথিত থাকে অতীত ইতিহাসের অন্তঃস্থলে। তাই ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের আগ্রহ বাঙালির সর্বকালের।

ব্রিটিশ যুগে বাংলার এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হল হাজারদুয়ারি। বিশালাকার এই প্রাসাদে প্রত্যেকটি হলঘর অনুপম সৌন্দর্যের আলোকে সজ্জিত। বাংলার নবাবি আমলে স্থাপত্যকলার এক উজ্জল প্রতিফলন হল এই হাজারদুয়ারি প্রাসাদ।

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ এখন ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এখানে দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের জন্য একটি অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানে মাসে অন্তত ৭০ হাজার  মানুষ এর অনুগমন হয়, হাজারদুয়ারির অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় লালবাগ নামক অঞ্চলে। এর পাশ দিয়ে ভাগীরথী আপন রূপ নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বহুদূরে। সাধারণত এই প্রাসাদটি বহু দরজাবিশিষ্ট বলে তাই একে ‘হাজারদুয়ারি’ নামকরণ করা হয়ে থাকে। বাইরে থেকে ও ভিতর থেকে হাজারদুয়ারিতে অনেক দরজা দৃশ্যমান হলেও এর মধ্যে অনেক দরজাই আদপে নকল। অথচ দূর থেকে পুরোপুরি আসল বলে মনে হয়। হাজারদুয়ারির চমক শুধু তার দুয়ারেই না, ঘরগুলোও মনোমুগ্ধকর।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি রাজপ্রাসাদ।এই প্রাসাদে অনেক দরজা আছে৷ তার থেকেই প্রাসাদের এই নামকরণ হয়েছে৷ অবশ্য সব দরজা সত্য নয়, অনেক নকল দরজাও রয়েছে ৷

বাংলার নবাবদের রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুঘলদের অধীনে যখন সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা, ওই রকম সময়ে সম্রাট ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন অবশ্য মুর্শিদকুলির নাম ছিল করতলব খাঁ। করতলবের সততা এবং দক্ষতা সম্রাটকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি করতলব খাঁকে ভাগীরথী গঙ্গার তীরে মকসুদাবাদে রাজধানী সরানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধি প্রধান করেছিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব, মকসুদাবাদের নাম পাল্টে মুর্শিদাবাদ করার অনুমতিও দেন তার সঙ্গে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী সরিয়ে আনেন। ততদিনে তিনি বাংলার সুবাহদার। দিল্লির রাজশক্তি তখন ক্রমশ ক্ষয় পাচ্ছে, সেই সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতেন। হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নবাব।

ব্রিটিশ যুগে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হাজারদুয়ারি

১৭শ শতাব্দী থেকে ইংরেজ শাসনের আগে পর্যন্ত সুবা বাংলা, বিহার ও ওড়িষার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ শহর৷ এখানে রাজত্ব করতেন নবাবরা ৷এখানকার নবাব হুমায়ুন জা ইউরোপিয় স্থপতি দিয়ে এই প্রাসাদ বানান৷ অনেকে ভুল করে ভাবেন যে, এই প্রাসাদ বুঝি নবাব সিরাজউদ্দৌলার দৌলার তৈরি। এই প্রাসাদ তৈরী হয় সিরাজ জমানার পরে। সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল হীরাঝিল প্রাসাদ৷ তা এখন ভাগীরথী নদীতে তলিয়ে গেছে৷ এই প্রাসাদ ইউরোপিয় ধাঁচে বানানো। এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত৷ তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় নানা অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা ছিল।

বর্তমানে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এখানে একটা সংগ্রহশালা বানিয়েছেন৷ তবে দুর্বল কাঠামোর জন্য দর্শকদের তিনতলায় উঠতে দেওয়া হয় না৷ শুক্রবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকে।

এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত৷ তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় নানা অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা ছিল। বর্তমানে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এখানে একটা সংগ্রহশালা বানিয়েছেন৷ তবে দুর্বল কাঠামোর জন্য দর্শকদের তিনতলায় উঠতে দেওয়া হয় না।

তারপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বাংলার মসনদে বসেছেন সুজাউদ্দিন, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, সিরাজ-উদ-দৌলা। সিরাজকে পরাজিত করে ১৭৫৭ সালে বাংলার দখল নিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মিরজাফরকে নবাব বানাল তারা। তারপর মিরকাশিম নবাব হলেন, তারপর আবার মিরজাফর। ততদিনে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরোপুরি ব্রিটিশদের দখলে। একের পর এক পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে মুর্শিদাবাদ। সেই জীবন্ত সাক্ষীকে চাক্ষুস দেখতে পর্যটকরা মুর্শিদাবাদে ভিড় জমান।

মুর্শিদাবাদে দর্শনীয় স্থানগুলির তালিকায় মধ্যে পর্যটকরা সবার আগে রাখেন হাজারদুয়ারি প্রাসাদকে। এই দুর্গপ্রাসাদ যেখানে অবস্থিত, সেই পুরো চত্বরটাকে বলে নিজামত কিলা বা কিলা নিজামত। হাজারদুয়ারি ছাড়াও ইমামবাড়া, ঘড়ি ঘর, মদিনা মসজিদ, চক মসজিদের মতো বেশ কিছু স্থাপত্য রয়েছে কিলা নিজামত এলাকায়।

জানা যায়, নবাব নাজিম হুমায়ুন জা তৈরি করিয়েছিলেন হাজারদুয়ারি। ১৮২৯ সালে তিনি এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গোটা স্থাপত্যের রূপকার ছিলেন ডানকান ম্যাকলিওড। দেখলেই বোঝা যায়, এই প্রাসাদের স্থাপত্যশৈলী ইউরোপীয় ঘরানার, বিশেষ করে ইতালীয় রীতির সৌধগুলোর সঙ্গে মিল প্রচুর। ১৮৩৭ সালে মুর্শিদাবাদের প্রধান আকর্ষণ হাজারদুয়ারির নির্মাণকার্য শেষ হয়।

৪১ একর জায়গা নিয়ে এই প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ১ হাজারটা দরজা আছে বলে এর নাম হাজারদুয়ারি। অবশ্য দরজাগুলির মধ্যে ১০০ টাই নকল। তবে চট করে দেখে নকল দরজাগুলোকে চিহ্নিত করা বেশ মুশকিল। দেওয়ালের মধ্যে এমনভাবে ডিজাইন করা, বাইরে থেকে দেখলে হুবহু আসল দরজা মনে হবে। দুর্গপ্রাসাদে যদি হঠাৎ করে শত্রুরা আক্রমণ করে বসে, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যই নকল দরজাগুলো বানানো হয়েছিল। সাধারণভাবে প্রাসাদটি হাজারদুয়ারি নামে প্রচলিত হলেও, হুমায়ুন জা একে ‘বড়ো কুঠি’ নামেই ডাকতো

এখন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে প্রাসাদটির মধ্যে জাদুঘর গড়ে উঠেছে। বাংলার নবাব, অভিজাত এবং ব্রিটিশদের ব্যবহৃত ও শৌখিন নানা জিনিস স্থান পেয়েছে এখানে। রয়েছে তখনকার আসবাব, বাসনপত্র, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি, নবাবি আমলের বই, পুঁথিপত্র। যেমন আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপি এবং সোনা দিয়ে মোড়া কোরান শরিফ। ২ হাজারেরও বেশি অস্ত্রের সম্ভার আছে। তার মধ্যে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র যেমন দেখা যায়, তেমনই দর্শকদের জন্য রাখা হয়েছে সেই ছুরি, যা দিয়ে মহম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করেছিলেন। আলিবর্দি খাঁ এবং সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ারও সেখানে দেখতে পাবেন। আরো যে কত কিছু রয়েছে, বলে শেষ করা যাবে না। গোটা জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য জাদুঘর খোলা থাকে।

হাজারদুয়ারির ঠিক বিপরীতে রয়েছে নিজামত ইমামবাড়া। মহরমের দিন এটি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাকি দিনগুলি এই স্থাপত্য কেবল বাইরে থেকেই দেখতে পাবেন। হাজারদুয়ারির প্রাঙ্গণেই আছে বিখ্যাত ঘড়ি মিনার। প্রাসাদের সামনেই দেখতে পাবেন বাচ্চাওয়ালি তোপ। কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল খোশবাগ, মোতঝিল, কাটরা মসজিদ, নসিপুর প্রাসাদ, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ি ইত্যাদি। তবে এগুলির বিভিন্ন স্থানে ২০/২৫ রুপি টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।  সবস্থান  গুলিতে ব্যপকহারে ইতিহাস বিক্রিত করা হয়েছে, বিভিন্নভাবে মূর্তি তৈরী করে রাখা হয়েছে,  সত্যি দুঃখজনক,  অনেকের ধারনা এক সময় মসুলমানদের জিনিসের অস্তিত্ব থাকবে না। এক শ্রেনীর প্রভাবশালী মানুষ জমিজায়গা দখল করে নির্মান করছেন ঘর, বাড়ী, দোকান, হোটেল,, লজ।

এখানে আগত মানুষদের সুয়োগ  সুবিধার দারুন  অভাব রয়েছে। শুধু কি তাই সুকৌশলে মাস্তানী ও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে কথিত গাইডার দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে  হাজার হাজার রুপি, সহজ সরল ভ্রমন পিপাসুরা বাধ্য হয়েই প্রতারিত হচ্ছেন।

কিভাবে যাওয়া যায়ঃ ট্রেনে যেতে চাইলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার কিংবা ভাগীরথী এক্সপ্রেস অথবা কলকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে টিকিট কেটে  নামতে হবে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে। এছাড়া এসপ্ল্যানেড থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার বাস পাওয়া যায়।

থাকার স্থানঃ বহরমপুরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের বহর ট্যুরিজম প্রপার্টি। সেখানে থেকেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে পারেন। বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ১১ কিলোমিটারের মতো। এছাড়া মুর্শিদাবাদ শহরেও বেশ কিছু হোটেল এবং রিসর্ট,লজ রয়েছ।

মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারীতে কি হাজারটা দরজা আছে? হাজার দুয়ারীর ইতিহাস কী?

হাজারদুয়ার কথাটির অর্থ ১,০০০টি দরজা। সুতরাং, হাজারদুয়ারিতে ১,০০০টি দরজাই আছে। তবে এদের মধ্যে ১০০টি দরজা কিন্তু কৃত্রিম, দেয়ালের গায়ে দরজার অনুকরণে ছবি আঁকা।তাই সত্যিকারের দরজা আছে ৯০০টি। সুতরাং, আক্ষরিক অর্থে এখানে ১,০০০টি দরজা থাকলেও সবগুলি আসল দরজা নয়।

ভাগীরথী নদীর তীরে ১২ বিঘা জমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৮০ ফুট উচ্চতার হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। এর বর্তমান নাম হাজারদুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম। এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ ১৮২৯ সালে শুরু হয়ে ১৮৩৭ সালে শেষ হয়। মূল স্থপতি ছিলেন ডানকান ম্যাকলয়েড। নবাব নাজিম হুমায়ুনজার আদেশ অনুযায়ী তার তত্ত্বাবধানে প্রাসাদটি নির্মিত হয়। বাঙালি সগুর মিস্ত্রী ছিলেন তার সহকারী। এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখি, সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে এই প্রাসাদ তৈরি হয়। সুতরাং, সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাজারদুয়ারির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। হাজারদুয়ারি ভাল করে দেখতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। ত্রিতল প্রাসাদটির প্রথমতলে আছে অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি ও রেকর্ড রুম। অস্ত্রাগারে মোট ২,৬০০টি অস্ত্র আছে। এখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত মহম্মদী বেগের অস্ত্র, পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত মীরমদনের কামান ছাড়াও অনেক রকমের অস্ত্র রাখা আছে। আছে আলীবর্দী খাঁয়ের ব্যবহার করা তলোয়ার ও বহুনলা বন্দুক, মীরকাসিমের ছোরা, নাদির শাহের মাথার বর্ম, বিভিন্ন ধরন ও আকারের কামান, বিভিন্ন ধরনের ছোরা-সহ দুর্লভ সংগ্রহ।

‘একতলা প্যালেসের সামনের বিশাল সিঁড়িটি দরবার পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে লম্বা গোলাকার স্তম্ভে সুন্দর নকশার কাজ। সিঁড়ির দু’পাশে দুটি সিংহ মূর্তি ও দুটি ছোট সেলামি কামান। তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা। দোতলা ও তৃতীয় তলায় আর্ট গ্যালারি ও লাইব্রেরি। গ্যালারিতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা আছে এখানে। লাইব্রেরিতে রয়েছে বহু ধর্মপুস্তক, চুক্তিপত্র, নাটক, উপন্যাস, তাম্রলিপি, ইতিহাস, প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ, বিদেশি ভাষার গ্রন্থ ইত্যাদি।

সম্রাট আকবরের সময়কার আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপি ও বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হাতে লেখা ‘কোরান শরীফ’ আছে এখানে। এছাড়াও আছে নবাব আর ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু অস্ত্র, বাসন, আসবাব, বহু বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি রয়েছে। প্যালেসের সামনে রয়েছে মনোরম বাগান।

‘হাজারদুয়ারির ঠিক মুখোমুখি রয়েছে বড়া ইমামবরা। হাজারদুয়ারি ও ইমামবরার মাঝখানে মদিনা মসজিদ। সিরাজউদ্দৌলার তৈরি করা স্থাপনার মধ্যে শুধু এই মসজিদটিই টিকে আছে। মদিনা মসজিদের সামনে বাঁধানো বেদীর ওপর রাখা আছে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের বাচ্চাওয়ালি কামান। ‘ শোনা যায়, এই কামান ১৩-১৪ শতকে গৌড়ের কোনও নবাবের আমলে বানানো হয়েছিল। কেউ বলেন এটি বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের কামান। তবে সবচেয়ে চালু মতটি হল, ১৬৪৭ সালে এটি বানিয়েছিলেন ঢাকার বিশিষ্ট লোহার মিস্ত্রি জনার্দন কামার। এই কামান দাগার জন্য ১৮ সের বারুদের প্রয়োজন হত। প্রশ্ন হল, কামানের নাম বাচ্চাওয়ালি কামান হল কেন? শোনা যায়, এই কামান দাগা হয়েছিল মাত্রই একবার। কিন্তু সেই তোপ দাগার শব্দ এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে আশেপাশের অনেক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত ঘটে যায়। সেই থেকে কামানের নাম বাচ্চাওয়ালি।

‘হাজারদুয়ারির সামনের পূর্ব পাশে আকাশছোঁয়া ঘড়ি ঘর পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুর্শিদাবাদবাসী ও ভাগীরথী নদীতে চলাচলকারী যাত্রীবাহী নৌকা ও জলযানের মাঝি-মল্লার ও যাত্রীদের সুবিধার্থে ঘড়িটি নির্মাণ করা হয়।’

ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও সংস্কারের অভাবে অনেক কিছু ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে, দেখার জন্য কেউ নেই। ঐতিহাসিক  তাৎপর্যপূর্ণ হাজার দুয়ারীর ইতিহাস বিকৃতি থেকে এর সংস্কার ও উন্নয়ন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সচেতন মহল।।

[লেখক : মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী। ও সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ]
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)