ঢাকা ০৫:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার

মোঃ নাহিদ হাসান
  • আপডেট সময় : ১১:৫০:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩
  • / ৭০২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকেই পারমাণবিক শক্তি বলে। মানব জাতি এক শতকেরও বেশি সময় ধরে পরমাণু বিদ্যার সাথে পরিচিত । দীর্ঘ এ সময়ে বিজ্ঞানীরা পরমাণু বিষয়ে এমন অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন যে, তার ফলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও পরমাণু শক্তির কথা বললেই বিশ্বের মানুষের মনে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, আতঙ্ক ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের চিত্রই ফুটে ওঠে। এর সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার একাধিক পরমাণু বোমার আঘাতে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি এবং এ দুটি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজ্যান হাওয়ার্সের ১৯৫৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ‘এটমস ফর পিস’ বিষয়ে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু শক্তির সামরিক প্রয়োগে বিশ্ববাসী যে মানবিক বিপর্যয়ে ছিল তা থেকে দৃষ্টি সরানোর লক্ষ্যে, পারমাণবিক শক্তি কিভাবে শান্তিপূর্ণ পর্যায়ে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে আস্থায় আনা।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে গবেষণা কাজে ঢাকায় বাংলা একাডেমি সংলগ্ন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র  প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-১৫, ১৯৭৩ এর মাধ্যমে দেশে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও তাঁর জামাতা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পরামর্শে পরমাণু শক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আদলে দেশে পরমাণু গবেষণাগার তৈরি করার জন্য সাভারে ২৬৫ একর জমি বরাদ্দ হয় এবং সেখানে পরে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অতঃপর এ প্রতিষ্ঠানেই ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয় ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি।

পরমাণু প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি প্রচলিত শান্তিপূর্ণ ব্যবহার দেখা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে । জ্বালানি সংকট বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংকট । জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং খনিজ কয়লা প্রভৃতি ফসিল জ্বালানি ব্যয়বহুল এবং শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, পরমাণু জ্বালানির উৎস ইউরেনিয়াম প্রচলিত সকল জ্বালানির চেয়ে অনেক বেশী লাভজনক ও সাশ্রয়ী। কারণ, অত্যন্ত অল্প পরিমাণ ইউরেনিয়াম দিয়ে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র  প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

পরমাণু শক্তির ব্যাপক ব্যবহার চলছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে। প্রাণঘাতি রোগ ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য পারমাণবিক রশ্মি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও থাইরয়েড, রক্ত শূন্যতা, প্রদাহ ও পচনের মতো বিভিন্ন রোগ পারমাণবিক রশ্মির মাধ্যমে খুব ভালোভাবে সনাক্ত করা হয়। কম্পিউটার টমোগ্রাফি স্ক্যান বা সি.টি স্ক্যান করার যন্ত্রগুলো, বিশেষ করে এ যন্ত্রের আধুনিক সংস্করণগুলোয় মানুষের শরীরের বিভিন্ন সমস্যাগুলো সনাক্ত করার জন্য পারমাণবিক শক্তির ব্যাপক ব্যবহা্র হচ্ছে। ম্যাগনেটিক রিজোনেন ইমেজিং বা এম .আর. আই নামের পরীক্ষার সময়ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কিছু তেজস্ত্রিয় পদার্থ প্রবেশ করিয়ে ঐসব স্থানের ছবি তোলা হয় । মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অসঙ্গতিগুলো সনাক্ত করার জন্যে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় ।  আজকাল লেজার রশ্মি ও অন্য কিছু তেজস্ত্রিয় রশির মাধ্যমে অস্ত্রপচারও করা হয়ে থাকে । এসব অস্ত্রপচারের সময় সাধারণত রক্তপাত ঘটে না এবং কোনো ব্যথাও পাওয়া যায় না । এমনকি পশু পাখীর বংশগত উন্নয়ন এবং অপেক্ষাকৃত বেশী উপকারী প্রাণি প্রতিপালন ও লালনের কাজেও পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ।

ফসলের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় ভিন্ন ভিন্ন জিনের মাধ্যমে। সকল জিনের কাজ এক রকম নয়। কোনো জিন ফসলের ফলনের জন্য দায়ী, কোনটি উচ্চতা, কোনটি রং, কোনটি রোগ সৃষ্টির আবার কোনটি রোগ প্রতিরোধের। এ রকম হাজারো বৈশিষ্ট্যের জন্য হাজারো রকম জিন দায়ী। এ জিনগুলো চারটি নিউক্লিওটাইড : এডিনোসিন, থাইমিন গুয়ানোসিন, সাইটোসিনের দীর্ঘ চেইনের মাধ্যমে গঠিত। দীর্ঘ এ চেইনের কোথাও একটু পরিবর্তন ঘটলে এর কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ পরিবর্তনের ফলে নানান কিছু হতে পারে। রোগ সংবেদনশীল জিনটি রোগপ্রতিরোধী হতে পারে, প্রতিকূল আবহাওয়ার উপযোগী জিনের উদ্ভব ঘটতে পারে যা ফসলের জন্য কাঙ্ক্ষিত।আইএইএ ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রবন্ধে বলা হচ্ছে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন শতকরা ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়াও উচ্চফলনশীল আগাম, রোগ, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব।

খাদ্য দ্রব্যকে দীর্ঘকাল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে খাদ্য সামগ্রিকে ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণুমুক্ত রাখার ক্ষেত্রেও পরমাণু শক্তি কাজে লাগছে । তেজস্ত্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে এ কাজ করা হচ্ছে ।

ইদানীং খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ ও ভূমির উপরিভাগে অবস্থিত পানির বিভিন্ন উৎসও আবিষ্কার করা হচ্ছে। বাঁধের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা বা বাঁধের কোথাও পানি চুইয়ে বেরিয়ে পড়ছে কিনা তা নির্ধারণ করার কাজেও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা হয়। লবণাক্ত পানিকে মিষ্টি পানিতে রূপান্তরিত করার কাজেও পরমাণু শক্তির ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি রণাঙ্গনে পরিত্যাক্ত প্রাণঘাতি মাইন সনাক্ত করার কাজেও পরমাণু শক্তি ব্যবহার করা হয় ।

অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের বহু দেশ পরমাণু জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়াও পেট্রোকেমিকেল শিল্পে তেল ও গ্যাসের গুরুত্ব খুব বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি হিসেবে এ দুটি পদার্থের ব্যবহার এখন আর লাভজনক নয় । তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নতুন, সস্তা এবং পুণঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের চেষ্টা জোরদার করেছে। যেমন, বায়ু সৌরশক্তি ও ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি থেকে উৎপাদিত জ্বালানিগুলো দূষণবিহীন এবং বারবার ব্যবহারযোগ্য । কিন্তু এসব নতুন জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা বা সুযোগ এতো সীমিত যে তা দিয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, এ ধরনের জ্বালানির ব্যবহার বিশেষ মওসুম বা বিশেষ ভৌগলিক সীমার মধ্যেই সীমিত। তাই এ ধরনের জ্বালানি উৎপাদনের জন্যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হলেও সব অঞ্চলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয় না।ফলে পরমাণু জ্বালানির দিকে ঝোঁক বৃদ্ধির পাচ্ছে।

তবে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্যে খুবই জটিল প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়। আর এ জন্য খুবই উন্নত মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পারমাণবিক যন্ত্র বা স্থাপনাগুলোর সুরক্ষার দরকার হয়ে থাকে। কারণ, খুব ছোটখাটো ভুলের জন্যে পরিবেশের বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় এক বিস্ফোরণের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকায়, এমনকি পূর্ব ইউরোপেও তেজস্ত্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিপর্যয়ের কথা এখনও সবার মনে আছে। আর এ কারণেই ইউরোপের পরিবেশবাদী দলগুলো সমস্ত পারমাণবিক চুল্লী বন্ধ করে দেয়ার ভালো যুক্তি খুঁজে পায়। কিন্তু বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সস্তা দরের ফসিল  জ্বালানিগুলোর যুগ শেষ হয়ে আসেছে।এই অল্প পরিমাণ বর্ধিত তেল দিয়ে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশগুলোর উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই আপাতত পরমাণু জ্বালানির বড় কোন বিকল্প নাই।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রযুক্তি খুবই কল্যাণকর একটি প্রযুক্তি। বাংলাদেশ আইএইএ-র কারিগরি সহযোগিতায় পরমাণু শিক্ষা ও গবেষণা, খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, পানিতে আইসোটোপ কৌশল প্রয়োগ, পরিবেশ সুরক্ষা, নন-ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিংয়ের মতো শিল্প সহায়তা, শস্য ও গবাদিপশুর উন্নয়ন এবং পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক ক্ষেত্রে  প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। অতি সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, “আমাদের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার সাহসী চ্যালেঞ্জ  গ্রহণ করেছেন। যে কারণে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই উৎস হিসেবে বিবেচনা করে।” তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ  ব্যবহারের জন্য বিশ্বের সমগ্র মানবজাতিকে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করতে হবে। তবেই আমরা এ ধরাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারব।

[লেখক : সায়েন্টিফিক এ্যাসিস্ট্যান্ট-১, ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্স (আইসিএস), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। Mail: nahidpust@gmail.com]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নিউজটি শেয়ার করুন

পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার

আপডেট সময় : ১১:৫০:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩

পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকেই পারমাণবিক শক্তি বলে। মানব জাতি এক শতকেরও বেশি সময় ধরে পরমাণু বিদ্যার সাথে পরিচিত । দীর্ঘ এ সময়ে বিজ্ঞানীরা পরমাণু বিষয়ে এমন অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন যে, তার ফলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও পরমাণু শক্তির কথা বললেই বিশ্বের মানুষের মনে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, আতঙ্ক ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের চিত্রই ফুটে ওঠে। এর সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার একাধিক পরমাণু বোমার আঘাতে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি এবং এ দুটি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজ্যান হাওয়ার্সের ১৯৫৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ‘এটমস ফর পিস’ বিষয়ে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু শক্তির সামরিক প্রয়োগে বিশ্ববাসী যে মানবিক বিপর্যয়ে ছিল তা থেকে দৃষ্টি সরানোর লক্ষ্যে, পারমাণবিক শক্তি কিভাবে শান্তিপূর্ণ পর্যায়ে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে আস্থায় আনা।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে গবেষণা কাজে ঢাকায় বাংলা একাডেমি সংলগ্ন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র  প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-১৫, ১৯৭৩ এর মাধ্যমে দেশে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও তাঁর জামাতা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পরামর্শে পরমাণু শক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আদলে দেশে পরমাণু গবেষণাগার তৈরি করার জন্য সাভারে ২৬৫ একর জমি বরাদ্দ হয় এবং সেখানে পরে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অতঃপর এ প্রতিষ্ঠানেই ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয় ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি।

পরমাণু প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি প্রচলিত শান্তিপূর্ণ ব্যবহার দেখা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে । জ্বালানি সংকট বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংকট । জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং খনিজ কয়লা প্রভৃতি ফসিল জ্বালানি ব্যয়বহুল এবং শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, পরমাণু জ্বালানির উৎস ইউরেনিয়াম প্রচলিত সকল জ্বালানির চেয়ে অনেক বেশী লাভজনক ও সাশ্রয়ী। কারণ, অত্যন্ত অল্প পরিমাণ ইউরেনিয়াম দিয়ে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র  প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

পরমাণু শক্তির ব্যাপক ব্যবহার চলছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে। প্রাণঘাতি রোগ ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য পারমাণবিক রশ্মি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও থাইরয়েড, রক্ত শূন্যতা, প্রদাহ ও পচনের মতো বিভিন্ন রোগ পারমাণবিক রশ্মির মাধ্যমে খুব ভালোভাবে সনাক্ত করা হয়। কম্পিউটার টমোগ্রাফি স্ক্যান বা সি.টি স্ক্যান করার যন্ত্রগুলো, বিশেষ করে এ যন্ত্রের আধুনিক সংস্করণগুলোয় মানুষের শরীরের বিভিন্ন সমস্যাগুলো সনাক্ত করার জন্য পারমাণবিক শক্তির ব্যাপক ব্যবহা্র হচ্ছে। ম্যাগনেটিক রিজোনেন ইমেজিং বা এম .আর. আই নামের পরীক্ষার সময়ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কিছু তেজস্ত্রিয় পদার্থ প্রবেশ করিয়ে ঐসব স্থানের ছবি তোলা হয় । মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অসঙ্গতিগুলো সনাক্ত করার জন্যে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় ।  আজকাল লেজার রশ্মি ও অন্য কিছু তেজস্ত্রিয় রশির মাধ্যমে অস্ত্রপচারও করা হয়ে থাকে । এসব অস্ত্রপচারের সময় সাধারণত রক্তপাত ঘটে না এবং কোনো ব্যথাও পাওয়া যায় না । এমনকি পশু পাখীর বংশগত উন্নয়ন এবং অপেক্ষাকৃত বেশী উপকারী প্রাণি প্রতিপালন ও লালনের কাজেও পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ।

ফসলের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় ভিন্ন ভিন্ন জিনের মাধ্যমে। সকল জিনের কাজ এক রকম নয়। কোনো জিন ফসলের ফলনের জন্য দায়ী, কোনটি উচ্চতা, কোনটি রং, কোনটি রোগ সৃষ্টির আবার কোনটি রোগ প্রতিরোধের। এ রকম হাজারো বৈশিষ্ট্যের জন্য হাজারো রকম জিন দায়ী। এ জিনগুলো চারটি নিউক্লিওটাইড : এডিনোসিন, থাইমিন গুয়ানোসিন, সাইটোসিনের দীর্ঘ চেইনের মাধ্যমে গঠিত। দীর্ঘ এ চেইনের কোথাও একটু পরিবর্তন ঘটলে এর কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ পরিবর্তনের ফলে নানান কিছু হতে পারে। রোগ সংবেদনশীল জিনটি রোগপ্রতিরোধী হতে পারে, প্রতিকূল আবহাওয়ার উপযোগী জিনের উদ্ভব ঘটতে পারে যা ফসলের জন্য কাঙ্ক্ষিত।আইএইএ ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রবন্ধে বলা হচ্ছে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন শতকরা ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়াও উচ্চফলনশীল আগাম, রোগ, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব।

খাদ্য দ্রব্যকে দীর্ঘকাল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে খাদ্য সামগ্রিকে ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণুমুক্ত রাখার ক্ষেত্রেও পরমাণু শক্তি কাজে লাগছে । তেজস্ত্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে এ কাজ করা হচ্ছে ।

ইদানীং খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ ও ভূমির উপরিভাগে অবস্থিত পানির বিভিন্ন উৎসও আবিষ্কার করা হচ্ছে। বাঁধের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা বা বাঁধের কোথাও পানি চুইয়ে বেরিয়ে পড়ছে কিনা তা নির্ধারণ করার কাজেও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা হয়। লবণাক্ত পানিকে মিষ্টি পানিতে রূপান্তরিত করার কাজেও পরমাণু শক্তির ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি রণাঙ্গনে পরিত্যাক্ত প্রাণঘাতি মাইন সনাক্ত করার কাজেও পরমাণু শক্তি ব্যবহার করা হয় ।

অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের বহু দেশ পরমাণু জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়াও পেট্রোকেমিকেল শিল্পে তেল ও গ্যাসের গুরুত্ব খুব বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি হিসেবে এ দুটি পদার্থের ব্যবহার এখন আর লাভজনক নয় । তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নতুন, সস্তা এবং পুণঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের চেষ্টা জোরদার করেছে। যেমন, বায়ু সৌরশক্তি ও ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি থেকে উৎপাদিত জ্বালানিগুলো দূষণবিহীন এবং বারবার ব্যবহারযোগ্য । কিন্তু এসব নতুন জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা বা সুযোগ এতো সীমিত যে তা দিয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, এ ধরনের জ্বালানির ব্যবহার বিশেষ মওসুম বা বিশেষ ভৌগলিক সীমার মধ্যেই সীমিত। তাই এ ধরনের জ্বালানি উৎপাদনের জন্যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হলেও সব অঞ্চলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয় না।ফলে পরমাণু জ্বালানির দিকে ঝোঁক বৃদ্ধির পাচ্ছে।

তবে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্যে খুবই জটিল প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়। আর এ জন্য খুবই উন্নত মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পারমাণবিক যন্ত্র বা স্থাপনাগুলোর সুরক্ষার দরকার হয়ে থাকে। কারণ, খুব ছোটখাটো ভুলের জন্যে পরিবেশের বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় এক বিস্ফোরণের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকায়, এমনকি পূর্ব ইউরোপেও তেজস্ত্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিপর্যয়ের কথা এখনও সবার মনে আছে। আর এ কারণেই ইউরোপের পরিবেশবাদী দলগুলো সমস্ত পারমাণবিক চুল্লী বন্ধ করে দেয়ার ভালো যুক্তি খুঁজে পায়। কিন্তু বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সস্তা দরের ফসিল  জ্বালানিগুলোর যুগ শেষ হয়ে আসেছে।এই অল্প পরিমাণ বর্ধিত তেল দিয়ে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশগুলোর উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই আপাতত পরমাণু জ্বালানির বড় কোন বিকল্প নাই।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রযুক্তি খুবই কল্যাণকর একটি প্রযুক্তি। বাংলাদেশ আইএইএ-র কারিগরি সহযোগিতায় পরমাণু শিক্ষা ও গবেষণা, খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, পানিতে আইসোটোপ কৌশল প্রয়োগ, পরিবেশ সুরক্ষা, নন-ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিংয়ের মতো শিল্প সহায়তা, শস্য ও গবাদিপশুর উন্নয়ন এবং পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক ক্ষেত্রে  প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। অতি সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, “আমাদের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার সাহসী চ্যালেঞ্জ  গ্রহণ করেছেন। যে কারণে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই উৎস হিসেবে বিবেচনা করে।” তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ  ব্যবহারের জন্য বিশ্বের সমগ্র মানবজাতিকে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করতে হবে। তবেই আমরা এ ধরাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারব।

[লেখক : সায়েন্টিফিক এ্যাসিস্ট্যান্ট-১, ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্স (আইসিএস), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। Mail: nahidpust@gmail.com]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)