ঢাকা ০১:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

কলাপাড়ায় অস্তিত্ব সংকটে বাঁশ ও বেতের কারিগররা

এ এম মিজানুর রহমান বুলেট, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০৪:৪২:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩
  • / ৬৫১ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
পটুয়াখালীর কলাড়ায় এক সময় গ্রামগঞ্জে বাঁশ আর বেতের দ্বারা তৈরি তৈজস পত্রই ছিল জিনিসপত্র রাখার ভরসা। গোলা ভরা ধান যে পাত্রে রাখা হত সেই গোলাই তৈরি হত বাঁশ কিংবা বেত দিয়ে। কিন্তু অধুনিক যুগে প্লাস্টিকের দাপট আর সহজ লভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বাজার দখল হওয়ায় এসবের ব্যবহার আর কারিগরদের দেখা মেলেনা। যাও আছে তা হাতেগোনা কয়েকজন। তাদের পুঁজি আর ক্রেতার অভাবে সেগুলো হারাতে বসছে এসবের ব্যবহার। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে এক কালের গ্রামে জৌলুশ নিয়ে চলা বাঁশ আর বেতের তৈরি তৈজসপত্র। পেশা ছেড়ে দিয়েছে অনেকেই। যারা ধরে রেখেছে তাও নগন্য। দিন চলে কোন রকমের।
জানামতে, একটা সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ছিল বাঁশ আর বেতের দ্বারা তৈরি নানা তৈজস পত্র। ধান মাপার পালা, ধামা সের, গোলা, কুলা, চালনি, পানডালা, ধানের গোলা, নানা রঙ্গের চটই, ছোট ছোট পাটি, খেলনা, গরুর ঠুসি,কলমদানি, কাস্তের ঠোঙ্গা, বাঁশি,ফুলদানি, তরকারি ঢাকনা, চাল মাপার পুরাসহ নানান রকমের আসবাব।
এইসবের দেখা মেলেনা এখন আর তেমনটা। আধুনিক সময়ে এসে এসবের ব্যবহার নাই বললেই চলে। এখন উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পথে। আগে গ্রামের বাড়িতে প্রায়শই দেখা মিলত বাঁশ আর বেতের। এগুলো এখন আর চোখেও তেমন পড়েনা। বাঁশের দেখা কিছুটা মিললেও বেতের দেখা মিলছেই না। একদিকে যেমন ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়েছে গ্রামের বাসিন্দারা তেমনি কারিগরদের মজুরি এবং বাঁশ আর বেতের সংকটে এ পেশা বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে উন্নত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক ঋণ চায় এখানকার কারিগররা।
২৫ বছর ধরে কুটির শিল্পের সাথে জড়িত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের পুলিন ব্যাপারি। তিনি বলেন, একটা সময় খুব বিক্রি বাট্টা ভালো ছিল। উৎপাদন খরচ ও কাঁচা মালের দাম কম থাকার পাশাপাশি মানুষের চাহিদাও ছিল বেশ। সব মিলিয়ে ভালো ভাবেই চলত দিনগুলো।এখন কাঁচা মালের অভাব  আর উৎপাদন খরচ  বেশি হওয়ায় এ শিল্প একেবারেই শেষের পথে।  লোকজনের চাহিদাও কম। সব মিলিয়ে যেন এ শিল্পটা আর থাকলোনা।
তিনি আরো বলেন, একটা মাঝারী ধরনের ডোলা বানাতে সময় লাগে এক দুপুর। এখানে কাঁচা মাল আর সময় মিলিয়ে যেটা ব্যয় হয় সেটা কাঙ্খিত টাকায় বিক্রি করতে পারিনা। আগে ডেইলি ১০ টা ডোলা বিক্রি হত। এখন সপ্তাহে ১০ টা বিক্রি হয়না। সরকার এ শিল্পের দিকে নজর দিলে ভালো হত। সহজ শর্তে ঝণ ও কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিলে এ শিল্পটা বেঁচে যেত৷
মনোহরপুড়ের অনিল চন্দ্র ব্যাপারী বলেন, কুটির শিল্লের সাথে জড়িত ছিলাম প্রায় ২০ বছর। এ পেশাকে বংশ পরমপরায় নিয়েছিলাম আপন করেই কিন্তু  ছেড়ে দিতে হয়েছে এ পেশাকে। আমার বাবার হাত ধরে শিখছিলাম এ কাজ। কিন্তু বাঁশ বেত না পাওয়ায় প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, বন উজাড় করা। শ্রম অনুযায়ী অর্থ না পাওয়া। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যার কারনে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
মিচরিপাড়ার সুনিল চন্দ্র ব্যাপারী বলেন, এখন এগুলোর চল নাই। পরিবর্তন আইছে এ জগৎটায়। আমরা উন্নত প্রশিক্ষণ পাইনা। এখন গ্রামে কোন বাঁশ ঝাড় নাই। আনতে হয় বাহির থেকে ১ টাকার মাল ৭ টাহা দিয়া। শ্রম দিয়া সঠিক মূল্য পাইনা। ছেলে মেয়ে বৌ এদের নিয়ে সংসার চলেনা। মনে কষ্ট নিয়েই এ পেশাকে বিদায় দিছি। এখন হাল হালুটি করি। কোনমতে দিন চলে। তবে যারা এখনো ধরে রেখেছে এ পেশাকে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে যুগের সাথে চলতে সহজ শর্তে ঋণ দিলে টিকত এ পেশা।
নূরজাহান লাইভস্টক এন্ড হ্যাচারীর স্বত্বাধিকারী মো. নাইম বলেন, এক সময় গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে বাঁশ আর বেতের ঝাড় ছিল। এখন এসবের দেখাই মেলেনা। ব্যবহারের ক্ষেত্র ছিল বহু। গাছে বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র। সব যায়গায় ছিল বাঁশ আর বেতের ব্যবহার। এখন মানুষজন এগুলোর ব্যবহার আর বন জঙ্গল উজাড় পাশাপাশি আধুনিকতার ছোয়া না দেওয়ায় ঐতিহ্যের কুটির শিল্প একেবারে শেষের পথে।
পটুয়াখালী জেলার বিসিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত)  মো. আলমগীর সিকদার বলেন, বিভিন্ন সেক্টরেই আধুনিকতার ছোয়া পেয়েছে। কুটির শিল্পের নানা জিনিসপত্র এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। যে পরিমাণে চাহিদা রয়েছে সে পরিমান আমরা রপ্তানি করতে পারছি না। আমারা বছরে ২ থেকে ৩ বার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।  তারা আসলে আমরা উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি না। পেশায় ভ্যারিয়েশন আনতে হবে। দেশের বিভিন্ন যায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতেও ভালো বিক্রি হয়৷ তবে অনেকে নতুনত্ব না আনায় বাজারে টিকতে না পেরে ছিটকে পড়ছে। আমারা সব সময়ই চেষ্টা করি কুটির শিল্পীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার।  এটা সব সময় অব্যহত থাকে।
বাখ//আর

নিউজটি শেয়ার করুন

কলাপাড়ায় অস্তিত্ব সংকটে বাঁশ ও বেতের কারিগররা

আপডেট সময় : ০৪:৪২:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩
পটুয়াখালীর কলাড়ায় এক সময় গ্রামগঞ্জে বাঁশ আর বেতের দ্বারা তৈরি তৈজস পত্রই ছিল জিনিসপত্র রাখার ভরসা। গোলা ভরা ধান যে পাত্রে রাখা হত সেই গোলাই তৈরি হত বাঁশ কিংবা বেত দিয়ে। কিন্তু অধুনিক যুগে প্লাস্টিকের দাপট আর সহজ লভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বাজার দখল হওয়ায় এসবের ব্যবহার আর কারিগরদের দেখা মেলেনা। যাও আছে তা হাতেগোনা কয়েকজন। তাদের পুঁজি আর ক্রেতার অভাবে সেগুলো হারাতে বসছে এসবের ব্যবহার। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে এক কালের গ্রামে জৌলুশ নিয়ে চলা বাঁশ আর বেতের তৈরি তৈজসপত্র। পেশা ছেড়ে দিয়েছে অনেকেই। যারা ধরে রেখেছে তাও নগন্য। দিন চলে কোন রকমের।
জানামতে, একটা সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ছিল বাঁশ আর বেতের দ্বারা তৈরি নানা তৈজস পত্র। ধান মাপার পালা, ধামা সের, গোলা, কুলা, চালনি, পানডালা, ধানের গোলা, নানা রঙ্গের চটই, ছোট ছোট পাটি, খেলনা, গরুর ঠুসি,কলমদানি, কাস্তের ঠোঙ্গা, বাঁশি,ফুলদানি, তরকারি ঢাকনা, চাল মাপার পুরাসহ নানান রকমের আসবাব।
এইসবের দেখা মেলেনা এখন আর তেমনটা। আধুনিক সময়ে এসে এসবের ব্যবহার নাই বললেই চলে। এখন উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পথে। আগে গ্রামের বাড়িতে প্রায়শই দেখা মিলত বাঁশ আর বেতের। এগুলো এখন আর চোখেও তেমন পড়েনা। বাঁশের দেখা কিছুটা মিললেও বেতের দেখা মিলছেই না। একদিকে যেমন ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়েছে গ্রামের বাসিন্দারা তেমনি কারিগরদের মজুরি এবং বাঁশ আর বেতের সংকটে এ পেশা বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে উন্নত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক ঋণ চায় এখানকার কারিগররা।
২৫ বছর ধরে কুটির শিল্পের সাথে জড়িত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের পুলিন ব্যাপারি। তিনি বলেন, একটা সময় খুব বিক্রি বাট্টা ভালো ছিল। উৎপাদন খরচ ও কাঁচা মালের দাম কম থাকার পাশাপাশি মানুষের চাহিদাও ছিল বেশ। সব মিলিয়ে ভালো ভাবেই চলত দিনগুলো।এখন কাঁচা মালের অভাব  আর উৎপাদন খরচ  বেশি হওয়ায় এ শিল্প একেবারেই শেষের পথে।  লোকজনের চাহিদাও কম। সব মিলিয়ে যেন এ শিল্পটা আর থাকলোনা।
তিনি আরো বলেন, একটা মাঝারী ধরনের ডোলা বানাতে সময় লাগে এক দুপুর। এখানে কাঁচা মাল আর সময় মিলিয়ে যেটা ব্যয় হয় সেটা কাঙ্খিত টাকায় বিক্রি করতে পারিনা। আগে ডেইলি ১০ টা ডোলা বিক্রি হত। এখন সপ্তাহে ১০ টা বিক্রি হয়না। সরকার এ শিল্পের দিকে নজর দিলে ভালো হত। সহজ শর্তে ঝণ ও কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিলে এ শিল্পটা বেঁচে যেত৷
মনোহরপুড়ের অনিল চন্দ্র ব্যাপারী বলেন, কুটির শিল্লের সাথে জড়িত ছিলাম প্রায় ২০ বছর। এ পেশাকে বংশ পরমপরায় নিয়েছিলাম আপন করেই কিন্তু  ছেড়ে দিতে হয়েছে এ পেশাকে। আমার বাবার হাত ধরে শিখছিলাম এ কাজ। কিন্তু বাঁশ বেত না পাওয়ায় প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, বন উজাড় করা। শ্রম অনুযায়ী অর্থ না পাওয়া। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যার কারনে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
মিচরিপাড়ার সুনিল চন্দ্র ব্যাপারী বলেন, এখন এগুলোর চল নাই। পরিবর্তন আইছে এ জগৎটায়। আমরা উন্নত প্রশিক্ষণ পাইনা। এখন গ্রামে কোন বাঁশ ঝাড় নাই। আনতে হয় বাহির থেকে ১ টাকার মাল ৭ টাহা দিয়া। শ্রম দিয়া সঠিক মূল্য পাইনা। ছেলে মেয়ে বৌ এদের নিয়ে সংসার চলেনা। মনে কষ্ট নিয়েই এ পেশাকে বিদায় দিছি। এখন হাল হালুটি করি। কোনমতে দিন চলে। তবে যারা এখনো ধরে রেখেছে এ পেশাকে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে যুগের সাথে চলতে সহজ শর্তে ঋণ দিলে টিকত এ পেশা।
নূরজাহান লাইভস্টক এন্ড হ্যাচারীর স্বত্বাধিকারী মো. নাইম বলেন, এক সময় গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে বাঁশ আর বেতের ঝাড় ছিল। এখন এসবের দেখাই মেলেনা। ব্যবহারের ক্ষেত্র ছিল বহু। গাছে বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র। সব যায়গায় ছিল বাঁশ আর বেতের ব্যবহার। এখন মানুষজন এগুলোর ব্যবহার আর বন জঙ্গল উজাড় পাশাপাশি আধুনিকতার ছোয়া না দেওয়ায় ঐতিহ্যের কুটির শিল্প একেবারে শেষের পথে।
পটুয়াখালী জেলার বিসিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত)  মো. আলমগীর সিকদার বলেন, বিভিন্ন সেক্টরেই আধুনিকতার ছোয়া পেয়েছে। কুটির শিল্পের নানা জিনিসপত্র এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। যে পরিমাণে চাহিদা রয়েছে সে পরিমান আমরা রপ্তানি করতে পারছি না। আমারা বছরে ২ থেকে ৩ বার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।  তারা আসলে আমরা উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি না। পেশায় ভ্যারিয়েশন আনতে হবে। দেশের বিভিন্ন যায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতেও ভালো বিক্রি হয়৷ তবে অনেকে নতুনত্ব না আনায় বাজারে টিকতে না পেরে ছিটকে পড়ছে। আমারা সব সময়ই চেষ্টা করি কুটির শিল্পীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার।  এটা সব সময় অব্যহত থাকে।
বাখ//আর