ঢাকা ০৩:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

চলনবিলে জলময় এলাকার আয়তন কমেছে ৪৬৯ বর্গকিলোমিটার

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৩০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • / ৪৪০ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

প্রায় দুই’শ (১৯৬) বছরের বিবর্তনে এক সময়ের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ৫০০ বর্গমাইল থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ কিলোমিটার। বছরের পর বছর পলি পড়ে কমছে জলমগ্ন এলাকার আয়তন। চলনবিলের বিশাল অংশ মাছ ও জলজ উদ্ভিদ শুন্য। মাছ ও জলজ উদ্ভিদ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তন, বড়াল নদীর উৎস মুখে (পদ্মা) স্লুইচ গেট, অপরিকল্পিত বাঁধ, সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ, দখল ও দূষণে বিলের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়েছে। বিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়ি (খাল) পলি জমে ভরাট হওয়ায় বর্ষার পর আবাদী জমিতে পরিনত হয়। এতে বিলুপ্তির পথে মাছ, জলজপ্রাণী ও গুল্মলতা।

“ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া” বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ স্থাপনের পর থেকে রেল পথের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়।

এমএ হামিদ টি,কে ১৯৬৭ সালে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। গঠণকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার আট বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক নয় থেকে ৩১ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাওয়ায় বাড়ছে ফসলী জমি। হারিয়ে যাচ্ছে মাছ ও জীববৈচিত্র।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এক সময় নন্দকুজা নদী, ভদ্রাবতী নদী, সরস্বতী নদী, ইছামতি নদী, গুমানী নদী, আত্রাই নদী, গুড়নদী, করতোয়া নদী, ফুলঝোর নদী, বড়াল নদী, তুলসী নদী, চেঁচুয়া নদী, ভাদাই নদী, চিকনাই নদী, বানগঙ্গা নদী, গোহালা নদী, ছয়আনি বিল, বাঁইড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ী বিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ার বিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরী বিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরাবিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রামবিল, বেরল বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, কাতল বিল, বাঘমারা বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারী বিল, কৈখোলা বিল, কানচগাড়ী বিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গা বিল, মেরীগাছা বিল, খলিশাগাড়ীর বিল, নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, জানিগাছার জোলা ছিল চলনবিলের প্রাণ।

বর্তমানে চলনবিল সংকুচিত হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার এক হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। মোট লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে জমির পরিমান প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। শুস্ক মওসুমে চলনবিলের নদী বিল শুকিয়ে জেগে ওঠে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। কৃষকরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজসহ নানা প্রকারের ফসল আবাদ হচ্ছে।

চলনবিলে কমে গেছে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ। যেমন পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া শাপলা ইত্যাদি। প্রতি বছর বর্ষা মওসুমের পর জেগে ওঠা সমতল ভূমিতে ফসল আবাদে প্রচুর পরিমান রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রযোগ ও কচুরিপানার কারণে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এছাড়া বিল-নদী সংকুচিত হওয়ার মাছ ও জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। চলনবিলের বিশাল অংশ জলজ উদ্ভিদ শুন্য। জলজ উদ্ভিদ ও মাছ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

কালের বিবর্তনে ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে ও বড়াল নদীর (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণ করায় চলনবিলের নদী-বিল-খাড়ির অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিলুপ্তির পথে বিলের মৎস্য সম্পদ, জলজপ্রাণি ও গুল্মলতা। এক সময় বিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে ভারতে রফতানি করা হতো। অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা জাল দলিল তৈরি করে দখলে নিয়েছে কয়েক হাজার একর জমি।

উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, চলনবিলের ১০টি উপজেলার আবাদযোগ্য বেশির ভাগ খাসজমি ও জলাশয় এখন প্রভাবশালীদের দখলে। একটা সময় ছিল যখন চলনবিরের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ তৈরি করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বনপাড়া-হাটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ সড়ক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মোঃ রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ৩৪ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও বিলে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট গভীরতায় পানি থাকতো। ফলে সারা বছরই নৌ-চলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী-বিল ভরাট হয়ে গেছে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের বিরুপ প্রভাব এবং ১৯৮০-এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ, দখল করে বসতি ও দোকাপাট স্থাপন করায় নদী ও বিলগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

বা/খ : এসআর।

নিউজটি শেয়ার করুন

চলনবিলে জলময় এলাকার আয়তন কমেছে ৪৬৯ বর্গকিলোমিটার

আপডেট সময় : ১০:৩০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

প্রায় দুই’শ (১৯৬) বছরের বিবর্তনে এক সময়ের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ৫০০ বর্গমাইল থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ কিলোমিটার। বছরের পর বছর পলি পড়ে কমছে জলমগ্ন এলাকার আয়তন। চলনবিলের বিশাল অংশ মাছ ও জলজ উদ্ভিদ শুন্য। মাছ ও জলজ উদ্ভিদ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তন, বড়াল নদীর উৎস মুখে (পদ্মা) স্লুইচ গেট, অপরিকল্পিত বাঁধ, সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ, দখল ও দূষণে বিলের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়েছে। বিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়ি (খাল) পলি জমে ভরাট হওয়ায় বর্ষার পর আবাদী জমিতে পরিনত হয়। এতে বিলুপ্তির পথে মাছ, জলজপ্রাণী ও গুল্মলতা।

“ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া” বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ স্থাপনের পর থেকে রেল পথের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়।

এমএ হামিদ টি,কে ১৯৬৭ সালে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। গঠণকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার আট বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক নয় থেকে ৩১ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাওয়ায় বাড়ছে ফসলী জমি। হারিয়ে যাচ্ছে মাছ ও জীববৈচিত্র।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এক সময় নন্দকুজা নদী, ভদ্রাবতী নদী, সরস্বতী নদী, ইছামতি নদী, গুমানী নদী, আত্রাই নদী, গুড়নদী, করতোয়া নদী, ফুলঝোর নদী, বড়াল নদী, তুলসী নদী, চেঁচুয়া নদী, ভাদাই নদী, চিকনাই নদী, বানগঙ্গা নদী, গোহালা নদী, ছয়আনি বিল, বাঁইড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ী বিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ার বিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরী বিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরাবিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রামবিল, বেরল বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, কাতল বিল, বাঘমারা বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারী বিল, কৈখোলা বিল, কানচগাড়ী বিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গা বিল, মেরীগাছা বিল, খলিশাগাড়ীর বিল, নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, জানিগাছার জোলা ছিল চলনবিলের প্রাণ।

বর্তমানে চলনবিল সংকুচিত হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার এক হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। মোট লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে জমির পরিমান প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। শুস্ক মওসুমে চলনবিলের নদী বিল শুকিয়ে জেগে ওঠে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। কৃষকরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজসহ নানা প্রকারের ফসল আবাদ হচ্ছে।

চলনবিলে কমে গেছে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ। যেমন পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া শাপলা ইত্যাদি। প্রতি বছর বর্ষা মওসুমের পর জেগে ওঠা সমতল ভূমিতে ফসল আবাদে প্রচুর পরিমান রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রযোগ ও কচুরিপানার কারণে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এছাড়া বিল-নদী সংকুচিত হওয়ার মাছ ও জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। চলনবিলের বিশাল অংশ জলজ উদ্ভিদ শুন্য। জলজ উদ্ভিদ ও মাছ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

কালের বিবর্তনে ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে ও বড়াল নদীর (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণ করায় চলনবিলের নদী-বিল-খাড়ির অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিলুপ্তির পথে বিলের মৎস্য সম্পদ, জলজপ্রাণি ও গুল্মলতা। এক সময় বিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে ভারতে রফতানি করা হতো। অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা জাল দলিল তৈরি করে দখলে নিয়েছে কয়েক হাজার একর জমি।

উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, চলনবিলের ১০টি উপজেলার আবাদযোগ্য বেশির ভাগ খাসজমি ও জলাশয় এখন প্রভাবশালীদের দখলে। একটা সময় ছিল যখন চলনবিরের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ তৈরি করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বনপাড়া-হাটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ সড়ক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মোঃ রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ৩৪ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও বিলে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট গভীরতায় পানি থাকতো। ফলে সারা বছরই নৌ-চলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী-বিল ভরাট হয়ে গেছে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের বিরুপ প্রভাব এবং ১৯৮০-এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ, দখল করে বসতি ও দোকাপাট স্থাপন করায় নদী ও বিলগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

বা/খ : এসআর।