ঢাকা ০৬:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

কম্বলের পল্লী কাজীপুর

কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ১১:২৫:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৫৪৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
যমুনা শিকস্তি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার মানুষ চিরদিনই ভাঙাগড়ার নিরন্তর সংগ্রামে রত। বর্ষাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর চাষযোগ্য জমি হারানোয় শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতদের জীবন চালানো ছিল দুর্বিসহ। উপার্জনের বিকল্প পথ বাছতে আশির দশকে উপজেলার বরশিভাঙ্গা গ্রামের ছাইফুল ইসলাম পাড়ি জমান রাজধানীর মিরপুরে। তারপর ঝুটকাপড় কিনে এনে তা সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। সেই কম্বল সাইকেলের পেছনে করে বিক্রি শুরু করেন গ্রামে গ্রামে। বদলাতে থাকে সাইফুলের জীবন।
তার দেখাদেখি কাজীপুরে কম্বল তৈরি শুরু করেন অনেকেই। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। কাজীপুর পরিচিত হয়ে উঠেছে কম্বলের পল্লী নামে। এবার প্রকৃতিতে শীত আসতে দেরি হওয়ায় কম্বল পল্লী খ্যাত শিমুলদাইড় বাজার কর্মে ব্যস্ত হতে একটু সময় নিয়েছে। তবে শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এ পল্লী সরগরম হয়ে উঠেছে। বিরামহীন কাজ করছেন কারিগররা।
এখন উপজেলার শিমলুদাইড়, বর্শীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, মুসলিমপাড়া, গাড়াবেড়সহ প্রায় ২০টি গ্রামের ২০ থেকে ২৫ হাজার নারী পুরুষ কম্বল তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর এই কম্বল শিল্পের প্রাণ কেন্দ্র শিমুলদাইড় বাজার। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাজারে কম্বল তৈরির কাজ চলছে।
জানা গেছে, বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কম্বল ও শিশুদের শীতবস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন এখানকার কারিগর ও শ্রমিকরা। এই ছয় মাসে কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি। এবার প্রকৃতিতে শীত আসতে দেরি হওয়ায় এ পল্লী ব্যস্ত হয়েছে একটু দেরিতেই। নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত কাপড় কিনে এনে তৈরি করা হয় কম্বল। এই কম্বল সেলাই করেই এখানকার হাজারো নারী পুরুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই কম্বল দিয়েই উত্তরাঞ্চলসহ দেশের প্রায় ৪০টি জেলার হাজার হাজার হতদরিদ্র পরিবার শীত নিবারণ করেন।
ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২শ ৫০ থেকে ৪শ ৫০ টাকা কেজি দরে কম্বল তৈরির রোল কাপড় কেনা হয়। ওজন ভিত্তিতে প্রতি কেজি কাপড় থেকে তিন থেকে পাঁচটি কম্বল তৈরি হয়। মান ভেদে প্রতিটি কম্বল ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
শিমুলদাইড় গ্রামের জোসনা নামের এক কারিগর বলেন, ‘বাড়ির কামের ফাকে কম্বল বানাই। আমি কাপড় কাইট্যা সাইজ কইর‍্যা দেই আর বেটি স্কুল থাইক্যা আইস্যা সেলাই করে। এ আয়ে সংসার ভালোই চইলত্যাছে।’ গাড়াবেড় গ্রামের স্বপ্না খাতুন বলেন, ‘আগে মহাজনের কাছ থেকেই কাপড় এনে সেলাই করেছি। এখন নিজেই ঢাকা থেকে কাপড় এনে সেলাই করে কম্বল বানাই। সেই কম্বল শিমুলদাইড় বাজারের দোকানে বিক্রি করে বেশি আয় করি।’
মনিরুল ইসলাম নামের কম্বল তৈরির এক কারিগর বলেন, ‘আমি মনসুর আলী কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে কাপড় কাটা ও ভাঁজের কাজ করি। যা আয় করি তাতে নিজের খরচ বাদে পরিবারকেও দিতে পারছি।’
কম্বল ব্যবসায়ি বাদশা মিয়া বলেন, ‘একটি ঝুট কম্বল ২শ থেকে ৫শ ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ভালো মানেরগুলো দাম একটু বেশি। নারায়ণগঞ্জ থেকে এ ঝুট কাপড় কেজি প্রতি প্রকারভেদে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনে আনি। যা গতবার ২০ টাকা থেতে ৩৫ টাকা ছিল। প্রতিটি কম্বল তৈরি করতে মজুরি দিতে হয় ২০ থেকে ৩৫ টাকা। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে নারী কারিগররা এগুলো তৈরি করেন।’ আব্দুস ছালাম নামের একজন বলেন, ‘এবছর বেঁচা কেনা কম। হরতালের কারণে গাড়ি যাতায়াতে সমস্যা হয়। শুক্র-শনিবারে গাড়ি লোড হয় বেশি। এদিকে কম্বল তৈরির কাঁচামালের দামও আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি।’
লোকমান নামের এক পাইকার বলেন, ‘এখানে তৈরি কম্বলের মান ভালো। বিক্রি হয় বেশি। এখান থেকে পাইকারি কিনে নিয়ে আমি লালমনিরহাটে খুচরা বিক্রি করি। আমার মত শতশত পাইকার এখান থেকে মাল কেনে।’
কম্বল ব্যবসায়ি কমিটির সভাপতি শরিফুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘এখানে মানসম্মত ও দামি কম্বলও তৈরি হচ্ছে। ১শ ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ছয় হাজার ৮শ টাকার কম্বল তৈরি করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। চীন থেকেও আসছে কম্বল শিল্পের কাঁচামাল। আগে শুধু ঝুট এনে জোড়া দিয়ে কম্বল তৈরি করা হতো। এখন সময়ের সঙ্গে বদলেছে চাহিদা বদলেছে ব্যবসার ধরণও। গত বছর একশ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে এ বজারে।’
কাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, ‘শিমুলদাইড় বাজারের তৈরি কম্বলে সারাদেশের শীত নিবারণ হয়। এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যবসায়িরা নিরাপদে ব্যবসা করছেন কোন প্রকার চাঁদাবাজি নেই। এ শিল্পের প্রসারে যা-যা প্রয়োজন সব করা হবে।’
বাখ//আর

নিউজটি শেয়ার করুন

কম্বলের পল্লী কাজীপুর

আপডেট সময় : ১১:২৫:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩
যমুনা শিকস্তি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার মানুষ চিরদিনই ভাঙাগড়ার নিরন্তর সংগ্রামে রত। বর্ষাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর চাষযোগ্য জমি হারানোয় শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতদের জীবন চালানো ছিল দুর্বিসহ। উপার্জনের বিকল্প পথ বাছতে আশির দশকে উপজেলার বরশিভাঙ্গা গ্রামের ছাইফুল ইসলাম পাড়ি জমান রাজধানীর মিরপুরে। তারপর ঝুটকাপড় কিনে এনে তা সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। সেই কম্বল সাইকেলের পেছনে করে বিক্রি শুরু করেন গ্রামে গ্রামে। বদলাতে থাকে সাইফুলের জীবন।
তার দেখাদেখি কাজীপুরে কম্বল তৈরি শুরু করেন অনেকেই। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। কাজীপুর পরিচিত হয়ে উঠেছে কম্বলের পল্লী নামে। এবার প্রকৃতিতে শীত আসতে দেরি হওয়ায় কম্বল পল্লী খ্যাত শিমুলদাইড় বাজার কর্মে ব্যস্ত হতে একটু সময় নিয়েছে। তবে শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এ পল্লী সরগরম হয়ে উঠেছে। বিরামহীন কাজ করছেন কারিগররা।
এখন উপজেলার শিমলুদাইড়, বর্শীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, মুসলিমপাড়া, গাড়াবেড়সহ প্রায় ২০টি গ্রামের ২০ থেকে ২৫ হাজার নারী পুরুষ কম্বল তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর এই কম্বল শিল্পের প্রাণ কেন্দ্র শিমুলদাইড় বাজার। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাজারে কম্বল তৈরির কাজ চলছে।
জানা গেছে, বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কম্বল ও শিশুদের শীতবস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন এখানকার কারিগর ও শ্রমিকরা। এই ছয় মাসে কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি। এবার প্রকৃতিতে শীত আসতে দেরি হওয়ায় এ পল্লী ব্যস্ত হয়েছে একটু দেরিতেই। নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত কাপড় কিনে এনে তৈরি করা হয় কম্বল। এই কম্বল সেলাই করেই এখানকার হাজারো নারী পুরুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই কম্বল দিয়েই উত্তরাঞ্চলসহ দেশের প্রায় ৪০টি জেলার হাজার হাজার হতদরিদ্র পরিবার শীত নিবারণ করেন।
ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২শ ৫০ থেকে ৪শ ৫০ টাকা কেজি দরে কম্বল তৈরির রোল কাপড় কেনা হয়। ওজন ভিত্তিতে প্রতি কেজি কাপড় থেকে তিন থেকে পাঁচটি কম্বল তৈরি হয়। মান ভেদে প্রতিটি কম্বল ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
শিমুলদাইড় গ্রামের জোসনা নামের এক কারিগর বলেন, ‘বাড়ির কামের ফাকে কম্বল বানাই। আমি কাপড় কাইট্যা সাইজ কইর‍্যা দেই আর বেটি স্কুল থাইক্যা আইস্যা সেলাই করে। এ আয়ে সংসার ভালোই চইলত্যাছে।’ গাড়াবেড় গ্রামের স্বপ্না খাতুন বলেন, ‘আগে মহাজনের কাছ থেকেই কাপড় এনে সেলাই করেছি। এখন নিজেই ঢাকা থেকে কাপড় এনে সেলাই করে কম্বল বানাই। সেই কম্বল শিমুলদাইড় বাজারের দোকানে বিক্রি করে বেশি আয় করি।’
মনিরুল ইসলাম নামের কম্বল তৈরির এক কারিগর বলেন, ‘আমি মনসুর আলী কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে কাপড় কাটা ও ভাঁজের কাজ করি। যা আয় করি তাতে নিজের খরচ বাদে পরিবারকেও দিতে পারছি।’
কম্বল ব্যবসায়ি বাদশা মিয়া বলেন, ‘একটি ঝুট কম্বল ২শ থেকে ৫শ ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ভালো মানেরগুলো দাম একটু বেশি। নারায়ণগঞ্জ থেকে এ ঝুট কাপড় কেজি প্রতি প্রকারভেদে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনে আনি। যা গতবার ২০ টাকা থেতে ৩৫ টাকা ছিল। প্রতিটি কম্বল তৈরি করতে মজুরি দিতে হয় ২০ থেকে ৩৫ টাকা। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে নারী কারিগররা এগুলো তৈরি করেন।’ আব্দুস ছালাম নামের একজন বলেন, ‘এবছর বেঁচা কেনা কম। হরতালের কারণে গাড়ি যাতায়াতে সমস্যা হয়। শুক্র-শনিবারে গাড়ি লোড হয় বেশি। এদিকে কম্বল তৈরির কাঁচামালের দামও আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি।’
লোকমান নামের এক পাইকার বলেন, ‘এখানে তৈরি কম্বলের মান ভালো। বিক্রি হয় বেশি। এখান থেকে পাইকারি কিনে নিয়ে আমি লালমনিরহাটে খুচরা বিক্রি করি। আমার মত শতশত পাইকার এখান থেকে মাল কেনে।’
কম্বল ব্যবসায়ি কমিটির সভাপতি শরিফুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘এখানে মানসম্মত ও দামি কম্বলও তৈরি হচ্ছে। ১শ ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ছয় হাজার ৮শ টাকার কম্বল তৈরি করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। চীন থেকেও আসছে কম্বল শিল্পের কাঁচামাল। আগে শুধু ঝুট এনে জোড়া দিয়ে কম্বল তৈরি করা হতো। এখন সময়ের সঙ্গে বদলেছে চাহিদা বদলেছে ব্যবসার ধরণও। গত বছর একশ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে এ বজারে।’
কাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, ‘শিমুলদাইড় বাজারের তৈরি কম্বলে সারাদেশের শীত নিবারণ হয়। এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যবসায়িরা নিরাপদে ব্যবসা করছেন কোন প্রকার চাঁদাবাজি নেই। এ শিল্পের প্রসারে যা-যা প্রয়োজন সব করা হবে।’
বাখ//আর