ঢাকা ০৪:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

কওমী শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত আনোয়ার শাহ্ ( রহঃ)

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৪:১১:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩
  • / ৫১২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মোঃ হেলাল উদ্দিন :

ইসলামী শিক্ষার আলোকে যুগযুগ ধরে মুসলিম জাতি মানবিক আচরণ সামাজিক মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি মাতা-পিতা শিক্ষক আত্মীয় স্বজন এমনকি অন্যান্য  ধর্মালম্বী এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কোরান হাদিসের শিক্ষাই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে । সে দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই । এসবের মূলে শিক্ষকের সুচিন্তিত নির্দেশনা চির অম্লান হয়ে আছে জাতি সত্ত্বার হৃদয়ে । যাপিত জীবনে সব কিছু ভুলে গেলেও প্রকৃত শিক্ষার্থী তাঁর আর্দশিক মানুষটির কথা কখনো ভুলতে পারেনা। জীবন ও কর্মে শিক্ষক নামের বটবৃক্ষ অমর হয়ে বেঁচে থাকে ছাত্রের অন্তরে । সে প্রয়াস থেকে লিখুনির মাধ্যমে আমার পরম শ্রদ্ধা ভাজন শিক্ষকের ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিময় কিছু কথা তুলে আনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ।

কওমী শিক্ষা জীবনে আমার এবং লাখো জনের হৃদয়ের বন্ধন, কিশোরগঞ্জের আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মহাপরিচালক এবং ঐতিহাসিক শহিদী মসজিদের আমৃত্যু খতিব, বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীন আযহার আলী আনোয়ার শাহ্ (রহঃ)। এ অঞ্চলের মানুষজনের ধারণা যাঁর শূন্যতা আলেম সমাজে পূর্ণ হবার নয়। আমার শ্বাশত সন্মানিত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে তিনি ছিলেন , অনুপম এক আর্দশের নাম। আলোকিত এ গুনি সন্তান ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি জেলা শহরের পুরান থানার ঐতিহাসিক সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন, তাঁর পিতা বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) এর বিশিষ্ট খলিফা । উস্তাদুল উলামা ইসলামিক রাজনীতির পুরোধা বিপ্লবী আতাহার আলী ( রহঃ) । যিঁনি কিনা এ বাংলায় তৌহিদ তমদ্দুন এবং একত্ববাদের ঝান্ডা উড্ডিন করার লক্ষ্যে মাঠে ময়দানে ইকামতে দ্বীনের কাজ করেছেন । অন্ধকার পথ থেকে জাতিকে আলোর পথে তথা কোরান হাদিসের জ্ঞান অর্জনের উপর অগ্র নায়কের ভূমিকা রেখে ছিলেন । মুসলিম উম্মাকে মুক্তির পথের সন্ধান দিতে প্রানান্তকর ভাবে দ্বীন প্রচারের জন্য তাঁর অকৃত্রিম অবদানের কথা সর্বমহলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে । আলেম উলামা বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদীদের সহস্র বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গে কোরান সুন্নাহ ভিত্তিক বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়া এবং ময়মনসিংহে (চরপাড়া) জামিয়া ইসলামিয়া নামে দুটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন । এসব মাদ্রাসায় দেওবন্দের কারিকলামে আরবি, উর্দু , ফার্সি ইলমে ফিকাহ দর্শন সহ আধুনিক শিক্ষা  বাংলা , ইংরেজি ,গণিত, সমাজ বিজ্ঞান (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত), ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় পাঠদান করা হয়। বিমূর্ত চিন্তাবীদ এ বুজুর্গের হাতে গড়া ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদ, নূর মসজিদ, জামিয়ার পাঠাগার এবং খানখায়ে আশরাফিয়া কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । যুগশ্রেষ্ঠ ওলী আল্লামা আতহার আলী (রহঃ) সুযোগ্য উত্তরসুরী, কওমী শিক্ষার বাতিঘর জামিয়ার পরিচালক ও শহীদি মসজিদের খতিব, আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ্। জ্ঞানের উচ্চতায় বাংলার উলামা এবং তৌহিদী জনতার হৃদয় পটে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ছিলেন। শিরেক বিদাতের বিরুদ্ধে জনতার চিরচেনা প্রতিবাদী এক কন্ঠস্বর সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাহ্সাব হুজুর । তাঁর তথ্য উপাত্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এ মাওলানার শৈশবের বুনিয়াদি ও নৈতিক শিক্ষা তাঁর পিতার নিকটেই হাতেখড়ি । এছাড়াও প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা মাওলানা নিছার আলী (রহঃ.) এবং বাংলা, ইংরেজি সহ অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রখ্যাত ভাষাবিদ মাস্টার আব্দুর রশিদ (রহঃ) নিকট অর্জন করেন । মেধামী এ আলেম ১৯৬০ সালে ১ বছর ৬ মাস সময়ের মধ্যে হাফেজ নুরুল ইসলাম (রহঃ) শিখানো পথে জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে ৩০ পারা কোরানের হাফেজ হওয়ার কৃতিত্ব লাভ করেন । কওমী শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার দ্বিতীয় ধাপ কিতাবী তায়ালিম বহুমুখী শিক্ষা তদানিন্তন সময়ের ভাষাবীদ লেখক সাহিত্যিক সায়্যিদ আব্দুল আহাদ কাশেমি (রহঃ.) নিবির পর্যবেক্ষণে মিজান ( আরবি শব্দ চয়নের ব্যাকরণ ) নাহমেমীর , হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া, শরহে জামি (আরবি ব্যাক্য বিন্যাসের ব্যাকরণ ) হেদায়া (ফতুয়া) মিশকাত (হাদিস), জালালাইন (তাফসীর ) ও দারুল হাদিস ইত্যাদি গ্রন্থ শিখন শুরু হয় । তাঁর বর্ণাঢ্য শিক্ষা জীবনের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ছিল, সাধারণত একজন শিক্ষার্থীর দাওরা পাশ করতে নয় বছর সময় লেগে যেত, তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাধে শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে কয়েকটি জামাতে প্রমোশন প্রদান করেন । এর ফলে জামিয়া থেকে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সাথে হাদিস বিভাগের পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেন। অসাধারণ প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে তাঁর জামিয়ার শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রত্যাশায় পিতার উপদেশকে পাথেয় করে ১৯৬৪ সালে কওমী ধারার বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ পাকিস্তানের নিউটাউন জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে পড়া লেখা করেন। বিজ্ঞ শিক্ষকদের নিকট তাফসীর ও হাদিস বিভাগে বিশেষ দক্ষতা অর্জন লাভে সক্ষম হয় । ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিখ্যাত উস্তাদুল উলামা তদানীন্তন পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আজ অব্দি বাংলাদেশের কোন ছাত্র পাকিস্তানে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে তাঁর অর্জিত মেধার রেকোর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি । পাকিস্তানে তাঁর সন্মানিত ( আসাতেজায়ে কেরাম) শিক্ষকগণ হলেন, যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহঃ.) আল্লামা ওয়ালী হাসান টুংকি (রহঃ), ইদ্রিস মিঠারী (রহঃ.), ইলমে তাফসির বিভাগে হাফিজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী (রহঃ.)।

মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর চারজন খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষক হলেন, বিশ্বনন্দিত ক্বারী আতা সোলাইমান রিযক্ব আল মিশরী (রহঃ.), আরবি সাহিত্য ও তাজবিদুল কোরানের শিক্ষক হলেন, ইব্রাহিম আবদুল্লাহ (রহঃ.)। শিক্ষায় উচ্চতর ডিক্রি অর্জনের পর আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রহঃ ) এর বিশিষ্ট খলিফা মুহিউস্সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহঃ) এর হাতে তিনি বায়াত গ্রহন করেন। দীর্ঘদিন এসলাহী পথে চলতে- চলতে তাঁকে পীর সাহেব খেলাফত প্রদান করেন । কিন্ত আল্লাহর এ ওলী গতানুগতিক অন্যসব ব্যাবসায়ী পীরদের মত দোকান খুলে বসেননি । কখনও এ আবেদ লোক দেখানো ইবাদত পছন্দ করতেন না বরং তা পরিহার করে চলতেন । বিমূর্ত চিন্তার প্রতিক আল্লামা শাহ্ সাহেব শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে ১৯৬৮ সালে একজন ( মুহাক্কেক) অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে দ্বীনের খেদমতে তাঁর বাবার হাতে গড়া ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় যোগ দান করেন। প্রাণবন্ত ভাবে পাঠদানের মাধ্যমে মহান পেশা শিক্ষকতা এবং বস্তুনিষ্ঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকবে যুগযুগান্তরে । মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসেবে শিক্ষা বিস্তারের জগতে নিজেকে কান্ডারি বলে উপস্থান করেছিলেন শ্রেণি কক্ষে । তাঁর প্রমিত বাংলা ভাষায় পাঠদান পদ্ধতি ছিল অসাধারন। যত দুর্বল শিক্ষার্থীই হউক না কেন সকল ছাত্ররাই কিতাবের ( তাকরির) আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পারতো । ক্যাবিক ভাষায় যখন ক্লাসে কথা বলতেন, তাঁর সুললিত কণ্ঠের মোহনায় শিক্ষার্থীরা ভেসে যেতো, তখন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ছবক শ্রবন করতো । তিনি কিতাবের যে অংশটি ক্লাসে একবার পাঠদান করেছেন তা আর দ্বিতীয়বার কাউকে তাকরার করতে হয়নি । আরবি, উর্দু , ফার্সি, নাহু ছরফ, তাফসীর হাদিস সকল ভাষার উপর ছিল তাঁর পুর্ণ দখল । যখন কোন ক্লাসে কারিমা কিংবা পান্দেনামা বুস্তা গুলিস্তা পড়াতেন। হুজুরের সুরের ঝংকারে মহিত হয়ে অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে তা শ্রবণ করত । প্রযুক্তির যুগে শিক্ষকদের মান উন্নয়ন হলেও এমন একজন দার্শনিক চেতনার উঁচু মানের শিক্ষক কওমী অঙ্গনে বর্তমানে বিরল! বহু ভাষাবিদ পরিছন্ন হৃদয়ের সূর্যসন্তান রূপসী হাওর জেলা কিশোরগঞ্জে জন্ম নিবে কি না জনমনে প্রশ্ন জাগতে পারে । মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারে তাঁর মুল্যবোধ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রেখে যাওয়া বক্তব্যগুলো বর্তমান সময় উপযোগী । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেগুলো হতে পারে উত্তম আদর্শ । জামিয়ার শিক্ষার্থীরা যারা যুগ শ্রেষ্ঠ এ মুবালে­গের সান্নিধ্য লাভ করতে পেয়েছে এবং তাঁর আদর্শকে জীবনের পাথেয় হিসেবে আগলে রেখেছেন তাঁরা সকলেই মর্দেমুজাহিদের দেখানো পথে আলোর সন্ধান খুঁজে পেয়েছে । ধন্য হয়েছে তাঁদের ব্যাক্তি, সামাজিক, পারিবারিক ও ইসলাম প্রচার প্রসারের জীবনে ।

১৯৮৬ থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত তাঁকে কাছ থেকে দেখার এবং তাঁর কর্মময় জীবনের ( নসিহত ) উপদেশ শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আনোয়ার শাহ্ শব্দটি আজো সেমিনার সেম্পোজিয়াম ওয়াজ মাহফিল কিংবা আলোচনার টেবিলে কোথাও উচ্চারিত হতে শুনলেই হৃদয় শিহরিত হয়ে উঠে । এ মাওলানার কিছু স্মৃতিবিজড়িত কথা অতিতের স্মৃতির মতো মমহৃদয় পটে ভেসে উঠে। তাঁর কর্মযজ্ঞ এবং লৌকিক আচরণ ছিল সর্বউৎকৃষ্ট ভদ্রতার প্রান্তপথ । জামিয়ার শিক্ষা কারিকলাম নিপুণ ভাবে সাজাতেন, ক্লাস চলাকালীন সময় প্রতিটি শ্রেণির পাঠদান পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতেন । ক্লাসে শিক্ষক অনুপস্থি থাকলে সে ক্লাসে পড়াতেন । কখনো ফজরের নামাজের পূর্বে মাদ্রাসার আবাসিক ভবনে চলে আসতেন । হলে কারা ঘুম থেকে জেগেছে এবং পড়া লেখা করছে কিনা নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে দেখভাল করতেন । ছাত্রদের ঘুম না ভাঙ্গলে দরজায় করাঘাত করে সবার ঘুম ভাঙ্গাতেন । কঠোর ভাবে ছাত্রাবাস পরিস্কার পরিচন্ন রাখার নির্দেশ প্রদান করতেন । ছাত্রদের সাথে কখনো পিতা, বন্ধু , অভিভাবক আবার কখনো ন্যায়পরায়ণ শাসকের ভূমিকায় আবির্ভাব হতে দেখা যায় । যতদূর মনে পড়ে জামিয়ার শিক্ষার্থীদের (ছালানা ইমতেহান ) বার্ষিক পরীক্ষার পর লম্বা সময়ের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যেতো পরীক্ষার শেষে দিন তৃতীয় তলার হল্রুমে সকল উস্তাদ এবং ছাত্রদের নিয়ে সাংস্কৃতিক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো । এতে বরাবরের মত আমাকে উর্দু নাত পরিবেশন করতে হতো । হাজার শিক্ষার্থীর সামনে আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো “ আয় বাদে ছবালেজা পয়গাম ক্কারিনেছে অথবা মুজেকো পাওয়ালো মুছাফের না ছমজো, মাই আয়ানেহিহো ভুলায়া গায়া হো ইত্যাদি । বন্ধের ঘোষণার সংবাদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো । অপেক্ষার সময় আর যাচ্ছেনা অনেকেই বাড়ি যাবার সকল প্রস্তুতি ব্যাগে কাপড় ও আসবাব পত্র আগে থেকেই ঘুছিয়ে রেখেছে বন্ধ বলার সাথে সাথে বাবা মায়ের কাছে ছুটে যাবে বলে । কর্মী শিক্ষার্থীদের আচরণ অন্যান্য শিক্ষাস্তরের শিক্ষার্থীর মত নয় । আনন্দের মাঝেও হলরুমে ছিলনা কোনরূপ হৈচৈ, নীরব অপেক্ষার প্রহর। ধবধবে সাদা পোষাকে পরিপাটি মেজাজে মুখে পান চিবুতে চিবুতে নীরব পায়ে হলরুমে পৌঁছে গেলেন ইনসান গড়ার কান্ডারি । মুর্হুতেই নিস্তব্ধ বিশাল হলরুম। মঞ্চের মধ্যমনি প্রিন্সিপাল আনোয়ার শাহ্ ( রহঃ) তাঁর পাশেই জামিয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ঐতিহাসিক কিশোরগঞ্জ সদর আসনের সাবেক জাতীয় সংসদের প্রয়াত এমপি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন লেখক গবেষক রাজনীতিবিদ এবং তৌহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন আল্লামা মাওলানা আতাউর রহমান খান ( রহঃ) এবং অন্যান্য ( শিক্ষক ) আসাতেজাবৃন্দ এবং দুই নক্ষত্রের উপস্থিতে হল রুম প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো । ছাত্র ও শিক্ষকদের বক্তব্য শেষে মঞ্চে দাঁড়াতেন অধ্যক্ষ আনোয়ার শাহ্। তাঁর সুললিত কণ্ঠে প্রাম্ভিকতায় মহান রবের প্রশংসা এবং রাসুলে কারিম ( সাঃ) উপর দুরুদে ইব্রাহীমের মাধ্যমে কথা বলা শুরু করতেন । আজ স্মৃতির পাতা থেকে তাঁর কাব্যিক কিছু কথা পাঠক সমাজের সামনে উপস্থাপন করা না হলে আনোয়ার শাহ্ নামটির প্রতি অবিচার করা হবে । আমাকে দাঁড়াতে হতে পারে আসামির কাঠগড়ায় । ছাত্রজনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন সাহিত্যিকের অমিয় ভাষায় উপদেশ মুলক কথা বলতেন । তখন শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে একাকার হয়ে যেতো । কোন এক ছাত্র সমাবেশে আবেগ আফ্লুত কণ্ঠে বলনে , আর্দশিক মানুষ গড়ার নিমিত্তে আমাদের আকাবেরগণ প্রতিষ্টা করেছেন আজকের জামিয়া । যাঁদের চিন্তা চেতনায় স্বপ্নে ছিল কালেমার পতাকা বাহীবিশ্ব রেখে যাবে।তাঁদের সেআকাঙ্ক্ষা শতভাগ বাস্তব না, হলেও দ্বীনি এ মিলনমেলার পরিবেশ বলে দিচ্ছে আকাবেরদের প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখতে পেরেছে । শিক্ষা জীবনে দুনিয়া অর্জনের বাসনা পরিহার করে, কিতাবের জ্ঞান সাধনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কোন বিকল্প নেই । আগামীর সময় ইসলামের জন্য হতে পারে অগ্নী পথসম । ইসলামের দুশমনেরা সমাজের পরতে পরতে নাস্তিক্যবাদ ( অর্ধম ) কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে । ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের মুসলিম জাতি । ইসলামের মৌলিক প্রতিপাদ্য বিষয় সমূহ শিক্ষার মাধ্যমে তৌহিদের বাণী সমাজে প্রচারের দায়িত্ব তোমাদের কাঁধে নিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ জাগরণে তোমাদেরকে সৈনিকের ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে । জামিয়ার ছাত্র হিসেবে সবার দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে ইসলামের পক্ষে এবং সমাজ বিনির্মাণে সেবামূলক মনোভাব তৈয়ার করার জন্য ছাত্র জীবনই উত্তম সময় । লম্বা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে জ্ঞানের অনুশীলন ভুলে যাবেনা । পরিবার ও সমাজের মানুষকে সলাতের দাওয়াত প্রদান তোমাদের উপর মহান দায়িত্ব । অনুপম আখলাক গঠনের মাধ্যমে তুমাকেই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন জাগাতে হবে উম্মতে মুসলিমার হৃদয় পটে। শিরিক বিদআতের কর্মকাণ্ডে সয়লাব গোঁটা বাংলাদেশ, মানুষের দোরগোড়ায় রিয়েল ইসলামের বিধিবিধান পৌঁছে দিতে হবে । খোড়ধার বক্তব্য শুনে মাদ্রাসার ছাত্ররা নতুন দিগন্তের স্বপ্নে মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল । তাঁর নাফেরার দেশে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে জামিয়ার হল রুম হারালো শ্বাশত জীবন্ত কিংবদন্তীর বক্তব্যের স্রোত ধ্বনি । জামিয়ার অতীত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর অধ্যাপনা জীবনে ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত স্নেহের পরশ বিলিয়েছেন। ৮০ দশক থেক ৯৩ পর্যন্ত জামিয়ার হোষ্টেলে খাবারের মান একেবারে মন্দ বা খুব ভালো এমন ছিলনা । ডাইনিং-এ প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুবারে প্রায় ৩ শত ছাত্রের খাবার পাক হতো । আমরা যারা টাকার বিনিময়ে হোষ্টেলের খাবার খেতাম তার অধিক সংখ্যক ফ্রি খাবার পেতো। বেশ কিছুদিন যাবত খাবারের মান নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে অসন্তুটি দেখা দেয় । কিন্তু এ অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে যেতে কেউ সাহস পাচ্ছেনা । এমনকি আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা যারা ছিলেন তারাও বিব্রতবোধ প্রকাশ করেন । ভাবছি কি করা যায় তারপর বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম খাবারের মান উন্নত করার জন্য আবেদন নিয়ে হুজুরের কাছে যাবো । সময় নির্ধারণ হলো আগামীকাল আসরের নামাজের সময় নুর মসজিদে প্রিন্সিপালের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো । যথাসময় নুর মসজিদে পৌঁছে গেলাম কিন্তু কে এ বিষয়টি উপস্থাপন করবে তা নিয়ে মতনৈক্য সৃষ্টি হলো, সতীর্থ বন্ধুরা সেদিন আমার ওপরে সমর্থন দিয়েছিল । কারণ আমি জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা আশরাফ উদ্দিন (বিলবরুল্লাহ) হুজুরের ভাগ্নে। নামাজের পর অধ্যক্ষের সাথে নুর মসজিদে সাক্ষাৎ পেলাম সালাম বিনিময় হলো তারপর তিনি পরশ মাখানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন! কি খবর তোমরা ? নতশিরে বলে উঠলাম কিছু কথা বলার ছিল । তাঁর উত্তরে বলেন বাসায় আসো । খানিকটা ভয়ে ভয়ে আল্লামার পেছনে আমরা কজন ছুটে চলেছি আর ভাবছি কি জানি হয় । বাসায় যাওয়ার পর আমাদের সৌজন্যে নাস্তা পরিবেশন করা হলো তার পর তিনি আমাদের কথা গুলো অত্যন্ত গভীর ভাবে আমাদের কথা শুনে উত্তর দিলেন এতদিন বলনি কেন ? আমরা খুশি মনে মাদ্রাসায় চলে আসলাম। বাদ এশা অধ্যক্ষ সাহেব মাদ্রাসায় এসে সবার শ্রদ্ধাভাজন (দপ্তরী) তালে হোসেন নানাকে ডাকলেন, যিনি আমৃত্যু জামিয়ার একনিষ্ঠ খাদেম ও শহীদি মসজিদের মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন । তার পর বাবুর্চিকে ডেকে পাঠালেন খাবার (খানা ) নিয়ে আসার জন্য। বাবুর্চি প্রশ্ন করলো কোন হোটেল থেকে আনবো? হুজুর বললেন ,আমাদের ছাত্ররা যে খাবার খায় তা নিয়ে আসো অর্থাৎ জামিয়ার হোষ্টেলের খাবার । ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলা থেকে ডাকা ডাকির শব্দ শুনে রুম থেকে ভের হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতে ছিলাম । এখন অবশ্য সে ছাত্রাবাসটি নেই, দ্বীনের এ অতন্ত্র প্রহরী তা ভেঙে ৭ তলা একটি নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন । তালে নানা হুজুরকে সব সময় তুমি করে বলতেন , কারন বয়সে তালে নানা বড় ছিলেন । নানা হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলো তুমি এ খানা খাইতে পারবা ? কিছুক্ষণ পর বাবুর্চি খাবার নিয়ে আসলো সে খাবার তিনি খেয়ে বাবুর্চিকে নির্দেশ দিলেন খাবারের মান উন্নত করতে হবে । পরদিন থেকে দুবেলায় ভালো চালের ভাত ডাল এবং বিকালে ভালো মাছ সপ্তায় একদি গোশতের ব্যাবস্থা করে দিলেন । কিন্তু মানসম্মত খাবারের জন্য কোন মূল্য বৃদ্ধি করেন নাই, আনন্দিত হলো ছাত্রাবাসের সকল ছাত্ররা । একজন মানবিক ও আন্তরিক মানুষ হিসেবে তিনি প্রমাণিত ছিলেন । তারপর থেকে তিনি নিয়মিত ভাবে বোর্ডিংয়ের খাবারের খোঁজ খবর নিতেন । শহিদী মসজিদের শূন্য মেহরাব খোঁজে বিশ্ববিখ্যাত খতিব আযহার আলীকে । যে মেহরাব থেকে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারিত হতো সুদ ঘুষ সমাজের অনিয়ম কবর পূজা বাতেলের বিপক্ষে ন্যায় নীতির পক্ষে জাগরত করে রাখতেন এ মসজিদের মুসলি­দের । ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যখনি কোন ব্যাক্তি গোষ্ঠি রাষ্ট্র বা সরকার দ্বারা ঘটে যাওয়া সমসাময়িক বিষয়ের উপর হাজার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার শক্তিতে মুখরিত ছিলেন, ইসলামের বিরুদ্ধবাদী নাস্তিক মুর্তাদদের সাথে কোন দিন আপোষ করে পথ চলেননি । তাঁর নন্দিত খোৎবা শহিদী মসজিদে আজ আর নেই । ঘুরে ফিরে মানুষেরা তাঁকে খোঁজে মেহরাবে। রমযানের তারাবীর নামেজে শহিদী মসজিদের মুসলি­রা চিরতরে হারালো শ্রেষ্ঠ ইমামের কণ্ঠে হৃদয়ে তন্ময় করা ঐশী গ্রন্থআল কোরানের সুরের যে, সূরের আকুলতায় মানুষ সিজদায় লুটাতো । শিক্ষক থেকে যে ভাবে জামিয়ার প্রেন্সিপালের চেয়ারে আনোয়ার শাহ্ , হযরত আতাহার আলী (রহঃ) ওফাতের পর ভাটি বাংলা রূপসী হাওর ইটনা উপজেলার আলোকিত সন্তান হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান ( রহঃ) জামিয়ার প্রিন্সিপালের মহান দায়িত্ব পালন করছিলেন ,জামিয়ার সুত্রে জানা যায় দীর্ঘদিনদায়িত্ব পালনের পর স্বাস্থ্যগত কারণে জনাব খান অক্ষমতা প্রকাশ করলে,ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কিছুদিন আল­ামা আনোয়ার শাহ্ দায়িত্ব পালন করেন।১৯৮৩ সালে জামিয়ার মজলিসে শুরার বৈটকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনাব আনোয়ার শাহ্ প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিতে বাধ্যহন ।তাঁর পরিচালনায় জামিয়াকে উন্নত শিক্ষা ব্যাবস্থা ভৌত অবকাঠামোর উন্নতি সহ নান্দনিক প্রতিষ্টানের রূপদান করেন । জামিয়া বাংলাদেশের কমী মাদরাসার অন্যতম মডেল হিসেবে দেশ জুড়ে প্রশংসা অর্জন করে । রাখেন। ইন্তেকাল দেশবরেণ্য আলেম আল­ামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ্ (৭৩ ) বছর বয়সে এ ধরার সকল মায়ার বাঁধন ত্যাগ করে মহান প্রভুর ডাকে ২০২০ সালের ( ২৯ ) জানুয়ারি, বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার সময় ঢাকা রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ ছেলে ২ কন্যা আত্মীয় স্বজন সহ দেশ বিদেশে অসংখ্য বন্ধু বান্ধব ছাত্র শিক্ষক এবং গুণগাহী রেখে যান। পরদিন বৃহস্পতিবার (৩০ ) জানুয়ারি দুপুর ২টায় তাঁর ছোট ছেলে আঞ্জার শাহ্ এর ইমামতিত্বে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে কিশোরগঞ্জের সর্ববৃহত জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থান বাগেজান্নাতে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক, নিকলী, কিশোরগঞ্জ ।

নিউজটি শেয়ার করুন

কওমী শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত আনোয়ার শাহ্ ( রহঃ)

আপডেট সময় : ০৪:১১:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩

মোঃ হেলাল উদ্দিন :

ইসলামী শিক্ষার আলোকে যুগযুগ ধরে মুসলিম জাতি মানবিক আচরণ সামাজিক মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি মাতা-পিতা শিক্ষক আত্মীয় স্বজন এমনকি অন্যান্য  ধর্মালম্বী এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কোরান হাদিসের শিক্ষাই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে । সে দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই । এসবের মূলে শিক্ষকের সুচিন্তিত নির্দেশনা চির অম্লান হয়ে আছে জাতি সত্ত্বার হৃদয়ে । যাপিত জীবনে সব কিছু ভুলে গেলেও প্রকৃত শিক্ষার্থী তাঁর আর্দশিক মানুষটির কথা কখনো ভুলতে পারেনা। জীবন ও কর্মে শিক্ষক নামের বটবৃক্ষ অমর হয়ে বেঁচে থাকে ছাত্রের অন্তরে । সে প্রয়াস থেকে লিখুনির মাধ্যমে আমার পরম শ্রদ্ধা ভাজন শিক্ষকের ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিময় কিছু কথা তুলে আনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ।

কওমী শিক্ষা জীবনে আমার এবং লাখো জনের হৃদয়ের বন্ধন, কিশোরগঞ্জের আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মহাপরিচালক এবং ঐতিহাসিক শহিদী মসজিদের আমৃত্যু খতিব, বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীন আযহার আলী আনোয়ার শাহ্ (রহঃ)। এ অঞ্চলের মানুষজনের ধারণা যাঁর শূন্যতা আলেম সমাজে পূর্ণ হবার নয়। আমার শ্বাশত সন্মানিত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে তিনি ছিলেন , অনুপম এক আর্দশের নাম। আলোকিত এ গুনি সন্তান ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি জেলা শহরের পুরান থানার ঐতিহাসিক সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন, তাঁর পিতা বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) এর বিশিষ্ট খলিফা । উস্তাদুল উলামা ইসলামিক রাজনীতির পুরোধা বিপ্লবী আতাহার আলী ( রহঃ) । যিঁনি কিনা এ বাংলায় তৌহিদ তমদ্দুন এবং একত্ববাদের ঝান্ডা উড্ডিন করার লক্ষ্যে মাঠে ময়দানে ইকামতে দ্বীনের কাজ করেছেন । অন্ধকার পথ থেকে জাতিকে আলোর পথে তথা কোরান হাদিসের জ্ঞান অর্জনের উপর অগ্র নায়কের ভূমিকা রেখে ছিলেন । মুসলিম উম্মাকে মুক্তির পথের সন্ধান দিতে প্রানান্তকর ভাবে দ্বীন প্রচারের জন্য তাঁর অকৃত্রিম অবদানের কথা সর্বমহলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে । আলেম উলামা বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদীদের সহস্র বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গে কোরান সুন্নাহ ভিত্তিক বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়া এবং ময়মনসিংহে (চরপাড়া) জামিয়া ইসলামিয়া নামে দুটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন । এসব মাদ্রাসায় দেওবন্দের কারিকলামে আরবি, উর্দু , ফার্সি ইলমে ফিকাহ দর্শন সহ আধুনিক শিক্ষা  বাংলা , ইংরেজি ,গণিত, সমাজ বিজ্ঞান (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত), ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় পাঠদান করা হয়। বিমূর্ত চিন্তাবীদ এ বুজুর্গের হাতে গড়া ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদ, নূর মসজিদ, জামিয়ার পাঠাগার এবং খানখায়ে আশরাফিয়া কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । যুগশ্রেষ্ঠ ওলী আল্লামা আতহার আলী (রহঃ) সুযোগ্য উত্তরসুরী, কওমী শিক্ষার বাতিঘর জামিয়ার পরিচালক ও শহীদি মসজিদের খতিব, আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ্। জ্ঞানের উচ্চতায় বাংলার উলামা এবং তৌহিদী জনতার হৃদয় পটে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ছিলেন। শিরেক বিদাতের বিরুদ্ধে জনতার চিরচেনা প্রতিবাদী এক কন্ঠস্বর সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাহ্সাব হুজুর । তাঁর তথ্য উপাত্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এ মাওলানার শৈশবের বুনিয়াদি ও নৈতিক শিক্ষা তাঁর পিতার নিকটেই হাতেখড়ি । এছাড়াও প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা মাওলানা নিছার আলী (রহঃ.) এবং বাংলা, ইংরেজি সহ অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রখ্যাত ভাষাবিদ মাস্টার আব্দুর রশিদ (রহঃ) নিকট অর্জন করেন । মেধামী এ আলেম ১৯৬০ সালে ১ বছর ৬ মাস সময়ের মধ্যে হাফেজ নুরুল ইসলাম (রহঃ) শিখানো পথে জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে ৩০ পারা কোরানের হাফেজ হওয়ার কৃতিত্ব লাভ করেন । কওমী শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার দ্বিতীয় ধাপ কিতাবী তায়ালিম বহুমুখী শিক্ষা তদানিন্তন সময়ের ভাষাবীদ লেখক সাহিত্যিক সায়্যিদ আব্দুল আহাদ কাশেমি (রহঃ.) নিবির পর্যবেক্ষণে মিজান ( আরবি শব্দ চয়নের ব্যাকরণ ) নাহমেমীর , হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া, শরহে জামি (আরবি ব্যাক্য বিন্যাসের ব্যাকরণ ) হেদায়া (ফতুয়া) মিশকাত (হাদিস), জালালাইন (তাফসীর ) ও দারুল হাদিস ইত্যাদি গ্রন্থ শিখন শুরু হয় । তাঁর বর্ণাঢ্য শিক্ষা জীবনের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ছিল, সাধারণত একজন শিক্ষার্থীর দাওরা পাশ করতে নয় বছর সময় লেগে যেত, তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাধে শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে কয়েকটি জামাতে প্রমোশন প্রদান করেন । এর ফলে জামিয়া থেকে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সাথে হাদিস বিভাগের পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেন। অসাধারণ প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে তাঁর জামিয়ার শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রত্যাশায় পিতার উপদেশকে পাথেয় করে ১৯৬৪ সালে কওমী ধারার বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ পাকিস্তানের নিউটাউন জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে পড়া লেখা করেন। বিজ্ঞ শিক্ষকদের নিকট তাফসীর ও হাদিস বিভাগে বিশেষ দক্ষতা অর্জন লাভে সক্ষম হয় । ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিখ্যাত উস্তাদুল উলামা তদানীন্তন পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আজ অব্দি বাংলাদেশের কোন ছাত্র পাকিস্তানে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে তাঁর অর্জিত মেধার রেকোর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি । পাকিস্তানে তাঁর সন্মানিত ( আসাতেজায়ে কেরাম) শিক্ষকগণ হলেন, যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহঃ.) আল্লামা ওয়ালী হাসান টুংকি (রহঃ), ইদ্রিস মিঠারী (রহঃ.), ইলমে তাফসির বিভাগে হাফিজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী (রহঃ.)।

মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর চারজন খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষক হলেন, বিশ্বনন্দিত ক্বারী আতা সোলাইমান রিযক্ব আল মিশরী (রহঃ.), আরবি সাহিত্য ও তাজবিদুল কোরানের শিক্ষক হলেন, ইব্রাহিম আবদুল্লাহ (রহঃ.)। শিক্ষায় উচ্চতর ডিক্রি অর্জনের পর আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রহঃ ) এর বিশিষ্ট খলিফা মুহিউস্সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহঃ) এর হাতে তিনি বায়াত গ্রহন করেন। দীর্ঘদিন এসলাহী পথে চলতে- চলতে তাঁকে পীর সাহেব খেলাফত প্রদান করেন । কিন্ত আল্লাহর এ ওলী গতানুগতিক অন্যসব ব্যাবসায়ী পীরদের মত দোকান খুলে বসেননি । কখনও এ আবেদ লোক দেখানো ইবাদত পছন্দ করতেন না বরং তা পরিহার করে চলতেন । বিমূর্ত চিন্তার প্রতিক আল্লামা শাহ্ সাহেব শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে ১৯৬৮ সালে একজন ( মুহাক্কেক) অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে দ্বীনের খেদমতে তাঁর বাবার হাতে গড়া ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় যোগ দান করেন। প্রাণবন্ত ভাবে পাঠদানের মাধ্যমে মহান পেশা শিক্ষকতা এবং বস্তুনিষ্ঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকবে যুগযুগান্তরে । মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসেবে শিক্ষা বিস্তারের জগতে নিজেকে কান্ডারি বলে উপস্থান করেছিলেন শ্রেণি কক্ষে । তাঁর প্রমিত বাংলা ভাষায় পাঠদান পদ্ধতি ছিল অসাধারন। যত দুর্বল শিক্ষার্থীই হউক না কেন সকল ছাত্ররাই কিতাবের ( তাকরির) আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পারতো । ক্যাবিক ভাষায় যখন ক্লাসে কথা বলতেন, তাঁর সুললিত কণ্ঠের মোহনায় শিক্ষার্থীরা ভেসে যেতো, তখন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ছবক শ্রবন করতো । তিনি কিতাবের যে অংশটি ক্লাসে একবার পাঠদান করেছেন তা আর দ্বিতীয়বার কাউকে তাকরার করতে হয়নি । আরবি, উর্দু , ফার্সি, নাহু ছরফ, তাফসীর হাদিস সকল ভাষার উপর ছিল তাঁর পুর্ণ দখল । যখন কোন ক্লাসে কারিমা কিংবা পান্দেনামা বুস্তা গুলিস্তা পড়াতেন। হুজুরের সুরের ঝংকারে মহিত হয়ে অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে তা শ্রবণ করত । প্রযুক্তির যুগে শিক্ষকদের মান উন্নয়ন হলেও এমন একজন দার্শনিক চেতনার উঁচু মানের শিক্ষক কওমী অঙ্গনে বর্তমানে বিরল! বহু ভাষাবিদ পরিছন্ন হৃদয়ের সূর্যসন্তান রূপসী হাওর জেলা কিশোরগঞ্জে জন্ম নিবে কি না জনমনে প্রশ্ন জাগতে পারে । মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারে তাঁর মুল্যবোধ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রেখে যাওয়া বক্তব্যগুলো বর্তমান সময় উপযোগী । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেগুলো হতে পারে উত্তম আদর্শ । জামিয়ার শিক্ষার্থীরা যারা যুগ শ্রেষ্ঠ এ মুবালে­গের সান্নিধ্য লাভ করতে পেয়েছে এবং তাঁর আদর্শকে জীবনের পাথেয় হিসেবে আগলে রেখেছেন তাঁরা সকলেই মর্দেমুজাহিদের দেখানো পথে আলোর সন্ধান খুঁজে পেয়েছে । ধন্য হয়েছে তাঁদের ব্যাক্তি, সামাজিক, পারিবারিক ও ইসলাম প্রচার প্রসারের জীবনে ।

১৯৮৬ থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত তাঁকে কাছ থেকে দেখার এবং তাঁর কর্মময় জীবনের ( নসিহত ) উপদেশ শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আনোয়ার শাহ্ শব্দটি আজো সেমিনার সেম্পোজিয়াম ওয়াজ মাহফিল কিংবা আলোচনার টেবিলে কোথাও উচ্চারিত হতে শুনলেই হৃদয় শিহরিত হয়ে উঠে । এ মাওলানার কিছু স্মৃতিবিজড়িত কথা অতিতের স্মৃতির মতো মমহৃদয় পটে ভেসে উঠে। তাঁর কর্মযজ্ঞ এবং লৌকিক আচরণ ছিল সর্বউৎকৃষ্ট ভদ্রতার প্রান্তপথ । জামিয়ার শিক্ষা কারিকলাম নিপুণ ভাবে সাজাতেন, ক্লাস চলাকালীন সময় প্রতিটি শ্রেণির পাঠদান পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতেন । ক্লাসে শিক্ষক অনুপস্থি থাকলে সে ক্লাসে পড়াতেন । কখনো ফজরের নামাজের পূর্বে মাদ্রাসার আবাসিক ভবনে চলে আসতেন । হলে কারা ঘুম থেকে জেগেছে এবং পড়া লেখা করছে কিনা নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে দেখভাল করতেন । ছাত্রদের ঘুম না ভাঙ্গলে দরজায় করাঘাত করে সবার ঘুম ভাঙ্গাতেন । কঠোর ভাবে ছাত্রাবাস পরিস্কার পরিচন্ন রাখার নির্দেশ প্রদান করতেন । ছাত্রদের সাথে কখনো পিতা, বন্ধু , অভিভাবক আবার কখনো ন্যায়পরায়ণ শাসকের ভূমিকায় আবির্ভাব হতে দেখা যায় । যতদূর মনে পড়ে জামিয়ার শিক্ষার্থীদের (ছালানা ইমতেহান ) বার্ষিক পরীক্ষার পর লম্বা সময়ের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যেতো পরীক্ষার শেষে দিন তৃতীয় তলার হল্রুমে সকল উস্তাদ এবং ছাত্রদের নিয়ে সাংস্কৃতিক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো । এতে বরাবরের মত আমাকে উর্দু নাত পরিবেশন করতে হতো । হাজার শিক্ষার্থীর সামনে আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো “ আয় বাদে ছবালেজা পয়গাম ক্কারিনেছে অথবা মুজেকো পাওয়ালো মুছাফের না ছমজো, মাই আয়ানেহিহো ভুলায়া গায়া হো ইত্যাদি । বন্ধের ঘোষণার সংবাদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো । অপেক্ষার সময় আর যাচ্ছেনা অনেকেই বাড়ি যাবার সকল প্রস্তুতি ব্যাগে কাপড় ও আসবাব পত্র আগে থেকেই ঘুছিয়ে রেখেছে বন্ধ বলার সাথে সাথে বাবা মায়ের কাছে ছুটে যাবে বলে । কর্মী শিক্ষার্থীদের আচরণ অন্যান্য শিক্ষাস্তরের শিক্ষার্থীর মত নয় । আনন্দের মাঝেও হলরুমে ছিলনা কোনরূপ হৈচৈ, নীরব অপেক্ষার প্রহর। ধবধবে সাদা পোষাকে পরিপাটি মেজাজে মুখে পান চিবুতে চিবুতে নীরব পায়ে হলরুমে পৌঁছে গেলেন ইনসান গড়ার কান্ডারি । মুর্হুতেই নিস্তব্ধ বিশাল হলরুম। মঞ্চের মধ্যমনি প্রিন্সিপাল আনোয়ার শাহ্ ( রহঃ) তাঁর পাশেই জামিয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ঐতিহাসিক কিশোরগঞ্জ সদর আসনের সাবেক জাতীয় সংসদের প্রয়াত এমপি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন লেখক গবেষক রাজনীতিবিদ এবং তৌহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন আল্লামা মাওলানা আতাউর রহমান খান ( রহঃ) এবং অন্যান্য ( শিক্ষক ) আসাতেজাবৃন্দ এবং দুই নক্ষত্রের উপস্থিতে হল রুম প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো । ছাত্র ও শিক্ষকদের বক্তব্য শেষে মঞ্চে দাঁড়াতেন অধ্যক্ষ আনোয়ার শাহ্। তাঁর সুললিত কণ্ঠে প্রাম্ভিকতায় মহান রবের প্রশংসা এবং রাসুলে কারিম ( সাঃ) উপর দুরুদে ইব্রাহীমের মাধ্যমে কথা বলা শুরু করতেন । আজ স্মৃতির পাতা থেকে তাঁর কাব্যিক কিছু কথা পাঠক সমাজের সামনে উপস্থাপন করা না হলে আনোয়ার শাহ্ নামটির প্রতি অবিচার করা হবে । আমাকে দাঁড়াতে হতে পারে আসামির কাঠগড়ায় । ছাত্রজনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন সাহিত্যিকের অমিয় ভাষায় উপদেশ মুলক কথা বলতেন । তখন শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে একাকার হয়ে যেতো । কোন এক ছাত্র সমাবেশে আবেগ আফ্লুত কণ্ঠে বলনে , আর্দশিক মানুষ গড়ার নিমিত্তে আমাদের আকাবেরগণ প্রতিষ্টা করেছেন আজকের জামিয়া । যাঁদের চিন্তা চেতনায় স্বপ্নে ছিল কালেমার পতাকা বাহীবিশ্ব রেখে যাবে।তাঁদের সেআকাঙ্ক্ষা শতভাগ বাস্তব না, হলেও দ্বীনি এ মিলনমেলার পরিবেশ বলে দিচ্ছে আকাবেরদের প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখতে পেরেছে । শিক্ষা জীবনে দুনিয়া অর্জনের বাসনা পরিহার করে, কিতাবের জ্ঞান সাধনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কোন বিকল্প নেই । আগামীর সময় ইসলামের জন্য হতে পারে অগ্নী পথসম । ইসলামের দুশমনেরা সমাজের পরতে পরতে নাস্তিক্যবাদ ( অর্ধম ) কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে । ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের মুসলিম জাতি । ইসলামের মৌলিক প্রতিপাদ্য বিষয় সমূহ শিক্ষার মাধ্যমে তৌহিদের বাণী সমাজে প্রচারের দায়িত্ব তোমাদের কাঁধে নিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ জাগরণে তোমাদেরকে সৈনিকের ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে । জামিয়ার ছাত্র হিসেবে সবার দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে ইসলামের পক্ষে এবং সমাজ বিনির্মাণে সেবামূলক মনোভাব তৈয়ার করার জন্য ছাত্র জীবনই উত্তম সময় । লম্বা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে জ্ঞানের অনুশীলন ভুলে যাবেনা । পরিবার ও সমাজের মানুষকে সলাতের দাওয়াত প্রদান তোমাদের উপর মহান দায়িত্ব । অনুপম আখলাক গঠনের মাধ্যমে তুমাকেই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন জাগাতে হবে উম্মতে মুসলিমার হৃদয় পটে। শিরিক বিদআতের কর্মকাণ্ডে সয়লাব গোঁটা বাংলাদেশ, মানুষের দোরগোড়ায় রিয়েল ইসলামের বিধিবিধান পৌঁছে দিতে হবে । খোড়ধার বক্তব্য শুনে মাদ্রাসার ছাত্ররা নতুন দিগন্তের স্বপ্নে মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল । তাঁর নাফেরার দেশে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে জামিয়ার হল রুম হারালো শ্বাশত জীবন্ত কিংবদন্তীর বক্তব্যের স্রোত ধ্বনি । জামিয়ার অতীত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর অধ্যাপনা জীবনে ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত স্নেহের পরশ বিলিয়েছেন। ৮০ দশক থেক ৯৩ পর্যন্ত জামিয়ার হোষ্টেলে খাবারের মান একেবারে মন্দ বা খুব ভালো এমন ছিলনা । ডাইনিং-এ প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুবারে প্রায় ৩ শত ছাত্রের খাবার পাক হতো । আমরা যারা টাকার বিনিময়ে হোষ্টেলের খাবার খেতাম তার অধিক সংখ্যক ফ্রি খাবার পেতো। বেশ কিছুদিন যাবত খাবারের মান নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে অসন্তুটি দেখা দেয় । কিন্তু এ অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে যেতে কেউ সাহস পাচ্ছেনা । এমনকি আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা যারা ছিলেন তারাও বিব্রতবোধ প্রকাশ করেন । ভাবছি কি করা যায় তারপর বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম খাবারের মান উন্নত করার জন্য আবেদন নিয়ে হুজুরের কাছে যাবো । সময় নির্ধারণ হলো আগামীকাল আসরের নামাজের সময় নুর মসজিদে প্রিন্সিপালের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো । যথাসময় নুর মসজিদে পৌঁছে গেলাম কিন্তু কে এ বিষয়টি উপস্থাপন করবে তা নিয়ে মতনৈক্য সৃষ্টি হলো, সতীর্থ বন্ধুরা সেদিন আমার ওপরে সমর্থন দিয়েছিল । কারণ আমি জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা আশরাফ উদ্দিন (বিলবরুল্লাহ) হুজুরের ভাগ্নে। নামাজের পর অধ্যক্ষের সাথে নুর মসজিদে সাক্ষাৎ পেলাম সালাম বিনিময় হলো তারপর তিনি পরশ মাখানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন! কি খবর তোমরা ? নতশিরে বলে উঠলাম কিছু কথা বলার ছিল । তাঁর উত্তরে বলেন বাসায় আসো । খানিকটা ভয়ে ভয়ে আল্লামার পেছনে আমরা কজন ছুটে চলেছি আর ভাবছি কি জানি হয় । বাসায় যাওয়ার পর আমাদের সৌজন্যে নাস্তা পরিবেশন করা হলো তার পর তিনি আমাদের কথা গুলো অত্যন্ত গভীর ভাবে আমাদের কথা শুনে উত্তর দিলেন এতদিন বলনি কেন ? আমরা খুশি মনে মাদ্রাসায় চলে আসলাম। বাদ এশা অধ্যক্ষ সাহেব মাদ্রাসায় এসে সবার শ্রদ্ধাভাজন (দপ্তরী) তালে হোসেন নানাকে ডাকলেন, যিনি আমৃত্যু জামিয়ার একনিষ্ঠ খাদেম ও শহীদি মসজিদের মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন । তার পর বাবুর্চিকে ডেকে পাঠালেন খাবার (খানা ) নিয়ে আসার জন্য। বাবুর্চি প্রশ্ন করলো কোন হোটেল থেকে আনবো? হুজুর বললেন ,আমাদের ছাত্ররা যে খাবার খায় তা নিয়ে আসো অর্থাৎ জামিয়ার হোষ্টেলের খাবার । ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলা থেকে ডাকা ডাকির শব্দ শুনে রুম থেকে ভের হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতে ছিলাম । এখন অবশ্য সে ছাত্রাবাসটি নেই, দ্বীনের এ অতন্ত্র প্রহরী তা ভেঙে ৭ তলা একটি নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন । তালে নানা হুজুরকে সব সময় তুমি করে বলতেন , কারন বয়সে তালে নানা বড় ছিলেন । নানা হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলো তুমি এ খানা খাইতে পারবা ? কিছুক্ষণ পর বাবুর্চি খাবার নিয়ে আসলো সে খাবার তিনি খেয়ে বাবুর্চিকে নির্দেশ দিলেন খাবারের মান উন্নত করতে হবে । পরদিন থেকে দুবেলায় ভালো চালের ভাত ডাল এবং বিকালে ভালো মাছ সপ্তায় একদি গোশতের ব্যাবস্থা করে দিলেন । কিন্তু মানসম্মত খাবারের জন্য কোন মূল্য বৃদ্ধি করেন নাই, আনন্দিত হলো ছাত্রাবাসের সকল ছাত্ররা । একজন মানবিক ও আন্তরিক মানুষ হিসেবে তিনি প্রমাণিত ছিলেন । তারপর থেকে তিনি নিয়মিত ভাবে বোর্ডিংয়ের খাবারের খোঁজ খবর নিতেন । শহিদী মসজিদের শূন্য মেহরাব খোঁজে বিশ্ববিখ্যাত খতিব আযহার আলীকে । যে মেহরাব থেকে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারিত হতো সুদ ঘুষ সমাজের অনিয়ম কবর পূজা বাতেলের বিপক্ষে ন্যায় নীতির পক্ষে জাগরত করে রাখতেন এ মসজিদের মুসলি­দের । ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যখনি কোন ব্যাক্তি গোষ্ঠি রাষ্ট্র বা সরকার দ্বারা ঘটে যাওয়া সমসাময়িক বিষয়ের উপর হাজার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার শক্তিতে মুখরিত ছিলেন, ইসলামের বিরুদ্ধবাদী নাস্তিক মুর্তাদদের সাথে কোন দিন আপোষ করে পথ চলেননি । তাঁর নন্দিত খোৎবা শহিদী মসজিদে আজ আর নেই । ঘুরে ফিরে মানুষেরা তাঁকে খোঁজে মেহরাবে। রমযানের তারাবীর নামেজে শহিদী মসজিদের মুসলি­রা চিরতরে হারালো শ্রেষ্ঠ ইমামের কণ্ঠে হৃদয়ে তন্ময় করা ঐশী গ্রন্থআল কোরানের সুরের যে, সূরের আকুলতায় মানুষ সিজদায় লুটাতো । শিক্ষক থেকে যে ভাবে জামিয়ার প্রেন্সিপালের চেয়ারে আনোয়ার শাহ্ , হযরত আতাহার আলী (রহঃ) ওফাতের পর ভাটি বাংলা রূপসী হাওর ইটনা উপজেলার আলোকিত সন্তান হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান ( রহঃ) জামিয়ার প্রিন্সিপালের মহান দায়িত্ব পালন করছিলেন ,জামিয়ার সুত্রে জানা যায় দীর্ঘদিনদায়িত্ব পালনের পর স্বাস্থ্যগত কারণে জনাব খান অক্ষমতা প্রকাশ করলে,ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কিছুদিন আল­ামা আনোয়ার শাহ্ দায়িত্ব পালন করেন।১৯৮৩ সালে জামিয়ার মজলিসে শুরার বৈটকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনাব আনোয়ার শাহ্ প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিতে বাধ্যহন ।তাঁর পরিচালনায় জামিয়াকে উন্নত শিক্ষা ব্যাবস্থা ভৌত অবকাঠামোর উন্নতি সহ নান্দনিক প্রতিষ্টানের রূপদান করেন । জামিয়া বাংলাদেশের কমী মাদরাসার অন্যতম মডেল হিসেবে দেশ জুড়ে প্রশংসা অর্জন করে । রাখেন। ইন্তেকাল দেশবরেণ্য আলেম আল­ামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ্ (৭৩ ) বছর বয়সে এ ধরার সকল মায়ার বাঁধন ত্যাগ করে মহান প্রভুর ডাকে ২০২০ সালের ( ২৯ ) জানুয়ারি, বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার সময় ঢাকা রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ ছেলে ২ কন্যা আত্মীয় স্বজন সহ দেশ বিদেশে অসংখ্য বন্ধু বান্ধব ছাত্র শিক্ষক এবং গুণগাহী রেখে যান। পরদিন বৃহস্পতিবার (৩০ ) জানুয়ারি দুপুর ২টায় তাঁর ছোট ছেলে আঞ্জার শাহ্ এর ইমামতিত্বে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে কিশোরগঞ্জের সর্ববৃহত জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থান বাগেজান্নাতে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক, নিকলী, কিশোরগঞ্জ ।