ঢাকা ০৪:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পাবনা-সিরাজগঞ্জে লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৪৬৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম : ঘন ঘন লোডশেডিয়ে পাবনা-সিরাজগঞ্জের বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে কাপড় উৎপাদনে ধস নেমেছে। এদিকে তাঁত উপকরণ সুতা, রংসহ ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ও তাঁত বস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় অব্যাহত লোকসানে প্রায় লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় চার লাখ ক্ষুদ্র তাঁতী, শ্রমিক ও জোগালী। উর্দ্ধমূখী দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে বেকার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর বেসিকসেন্টর সূত্রে জানা গেছে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত। ২০০৩ সালের তাঁত বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী দুটি জেলায় বিদ্যুচালিত পাওয়ারলুম ও চিত্তরঞ্জন তাঁতের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। পাবনা সদর, সাঁথিয়া, সুজানগর, বেড়া, সিরাজগঞ্জের চৌহালীর এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ সদর, উল্লাপাড়া উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।

এ অঞ্চলের তাঁতে উৎপাদিত কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হতো। কিন্তু তাঁতপল্লীগুলোতে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোডশেডিংয়ে কারণে কাপড় উৎপাদনে ধস নেমেছে। আবার যে পরিমান কাপড় উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলো হাটে বিক্রি হচ্ছে না। সে কারণে অনেক মালিক তাঁত কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।

তাঁত প্রধান এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, তাঁতীপাড়ায় আগের মতো খট খট শব্দ নেই। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে কাজ বন্ধ। কারখানার সামনে কয়েকজন তাঁত শ্রমিক গোল হয়ে বসে আছেন। মলিন মুখে ক্ষোভ ও হতাশার ছাপ ফুটে উঠেছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে তাঁতশিল্পে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি। অনেক কারখানা মালিক কাপড় উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় চার লাখ ক্ষুদ্র তাঁতী ও শ্রমিক।

বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে সুতা তৈরি, রং দেয়া, সুতা শুকানো, নলিভরা ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে গড়ে ৩-৪ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন তাঁতী মালিক শ্রমিক মিলে প্রায় ৭ লাখ মানুষ। এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক পরিবারের ত্রিশ লাখ নারী পুরুষের জীবন-জীবিকা। অনেক ক্ষুদ্র তাঁতী, নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজের সন্ধানে চলে গেছেন ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সাভার, চিটাগাংয়ে। সেখানে অনেকই গার্মেন্টসে কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ রিক্সাভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

পাবনার কুলুনিয়া গ্রামের গ্রামের তাঁত কারখানা মালিক সৈয়দ আলী বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। কিন্তু সরকার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ৪ থেকে ৫ ঘন্টা জেনারেটর চালু রাখলে ১০ থেকে ১২ লিটার তেল প্রযোজন হচ্ছে। এই কয়েক ঘন্টার জন্য অতিরিক্ত দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। একই গ্রামের সুতার দোন মালিক কামাল ব্যাপারি বলেন, ৫০ কাউন্টে এক বেল সুতা এক বছর আগে ছিল ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন সেই সুতার দাম ২২ হাজার ২০০ টাকা। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া লোডশেডিং ও সুতাসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁতিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

শাহজাদপুর উপজেলার রামবাড়ী গ্রামের তাঁত শ্রমিক আবুল হোসেন জানান, দিনে তিন-চারটি শাড়ী তৈরি করা যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে এখন সারা দিনে দুটি শাড়ী তৈরি করা কঠিন। সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রহম আলী, আব্দুল কদ্দুস ও আব্দুল জব্বার বলেন, আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন-চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ও রাতে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে। এ কারণে ঠিত মতো কাজ হচ্ছে না। আয়ও কমেছে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।

শাহজাদপুর হাটে পাইকারি কাপড় বিক্রি করেন বেড়া উপজেলার পৌর এলাকার সান্যালপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন করোনার ক্ষতি কাটিয়ে তাঁতশিল্প ঘুড়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ ঘন ঘন লোডশেডিং, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে তাঁত শিল্প খাঁদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে কাপড়ের উৎপাদন খরচ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কাপড়েরর বাজারে। আগে শাহজাদপু হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ৪-৫ ট্রাক শাড়ী লুঙ্গি কিনে নিয়ে যেত। দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এক দুই ট্রাক কাপড় কিনছেন।

ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরেনর আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের প্রতিনিধি পলাশ দত্ত জানান, বাংলাদেশের উন্নতমানের শাড়ী লুঙ্গি, থ্রি পিস পশ্চিম বাংলার কলকাতা, ডালখোলা, খড়কপুর, মাদাহ, মুর্শিদাবাদ, ভগবানগোলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট ছোট পাইকার ও খুচরা দোকানিদের কাছে পাবনা-সিরাজগঞ্জের কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক আতাইকুলা, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও এনায়েতপুর হাট থেকে প্রতি মাসে এখান থেকে ৩০ ট্রাক কাপড় কিনে ভারতে পাঠাতেন। সেই কাপড় বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দামে বিক্রি করা হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সবাই মিলে মাত্র ৪-৫ ট্রাক কাপড় কিনছেন বলে তিনি জানান।

পাবনা ইন্ডাষ্ট্রিয়েল ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোঃ শাজাহান আলী আশরাফি বলেন, তাঁত কারখানা মালিকদের বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে, আবার উচ্চমূল্যে ডিজেল কিনে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে কাপড় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁত কারখানা মালিকদের। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বলেন, লোডশেডিং ও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে অধিকাংশ সময় কারখানায় কাপড় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। শ্রমিকরাও কাজ করতে পারছেনা। নতুন করে তেলের দাম বৃদ্ধিতে সুতার দাম বেড়েছে। আর যতটুকু কাপড় তৈরি করা হচ্ছে, তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। তিনি জানান, দুটি জেলায় প্রায় তিন লাখ তাঁত আছে। এরমধ্যে লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে শ্রমিকরাও বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে কারখানা চালানো যাচ্ছে না।

তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা-সিরাজগঞ্জের চৌহালীর এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি আতাইকুলা চারটি কাপড়ের হাট গড়ে উঠেছে। হাটগুলোতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংক, কাপড় ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, আতাইকুলা হাটে প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে ৬দিন (দিনরাত মিলে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে এসে শাড়ী, লুঙ্গি ক্রয় করে থাকেন। ভারতের ব্যবসায়ীরা এসব হাট থেকে শাড়ী ও লুঙ্গি কিনে থাকেন। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ শত কোটি টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রফতানি ও ব্যাংক লেনদেন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এই পরিসংখানে তাঁতশিল্প বিপর্যয়ে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পাবনা-সিরাজগঞ্জে লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ

আপডেট সময় : ০৬:৩৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

শফিউল আযম : ঘন ঘন লোডশেডিয়ে পাবনা-সিরাজগঞ্জের বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে কাপড় উৎপাদনে ধস নেমেছে। এদিকে তাঁত উপকরণ সুতা, রংসহ ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ও তাঁত বস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় অব্যাহত লোকসানে প্রায় লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় চার লাখ ক্ষুদ্র তাঁতী, শ্রমিক ও জোগালী। উর্দ্ধমূখী দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে বেকার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর বেসিকসেন্টর সূত্রে জানা গেছে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত। ২০০৩ সালের তাঁত বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী দুটি জেলায় বিদ্যুচালিত পাওয়ারলুম ও চিত্তরঞ্জন তাঁতের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। পাবনা সদর, সাঁথিয়া, সুজানগর, বেড়া, সিরাজগঞ্জের চৌহালীর এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ সদর, উল্লাপাড়া উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।

এ অঞ্চলের তাঁতে উৎপাদিত কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হতো। কিন্তু তাঁতপল্লীগুলোতে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোডশেডিংয়ে কারণে কাপড় উৎপাদনে ধস নেমেছে। আবার যে পরিমান কাপড় উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলো হাটে বিক্রি হচ্ছে না। সে কারণে অনেক মালিক তাঁত কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।

তাঁত প্রধান এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, তাঁতীপাড়ায় আগের মতো খট খট শব্দ নেই। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে কাজ বন্ধ। কারখানার সামনে কয়েকজন তাঁত শ্রমিক গোল হয়ে বসে আছেন। মলিন মুখে ক্ষোভ ও হতাশার ছাপ ফুটে উঠেছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে তাঁতশিল্পে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি। অনেক কারখানা মালিক কাপড় উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় চার লাখ ক্ষুদ্র তাঁতী ও শ্রমিক।

বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে সুতা তৈরি, রং দেয়া, সুতা শুকানো, নলিভরা ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে গড়ে ৩-৪ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন তাঁতী মালিক শ্রমিক মিলে প্রায় ৭ লাখ মানুষ। এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক পরিবারের ত্রিশ লাখ নারী পুরুষের জীবন-জীবিকা। অনেক ক্ষুদ্র তাঁতী, নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজের সন্ধানে চলে গেছেন ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সাভার, চিটাগাংয়ে। সেখানে অনেকই গার্মেন্টসে কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ রিক্সাভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

পাবনার কুলুনিয়া গ্রামের গ্রামের তাঁত কারখানা মালিক সৈয়দ আলী বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। কিন্তু সরকার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ৪ থেকে ৫ ঘন্টা জেনারেটর চালু রাখলে ১০ থেকে ১২ লিটার তেল প্রযোজন হচ্ছে। এই কয়েক ঘন্টার জন্য অতিরিক্ত দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। একই গ্রামের সুতার দোন মালিক কামাল ব্যাপারি বলেন, ৫০ কাউন্টে এক বেল সুতা এক বছর আগে ছিল ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন সেই সুতার দাম ২২ হাজার ২০০ টাকা। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া লোডশেডিং ও সুতাসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁতিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

শাহজাদপুর উপজেলার রামবাড়ী গ্রামের তাঁত শ্রমিক আবুল হোসেন জানান, দিনে তিন-চারটি শাড়ী তৈরি করা যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে এখন সারা দিনে দুটি শাড়ী তৈরি করা কঠিন। সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রহম আলী, আব্দুল কদ্দুস ও আব্দুল জব্বার বলেন, আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন-চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ও রাতে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে। এ কারণে ঠিত মতো কাজ হচ্ছে না। আয়ও কমেছে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।

শাহজাদপুর হাটে পাইকারি কাপড় বিক্রি করেন বেড়া উপজেলার পৌর এলাকার সান্যালপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন করোনার ক্ষতি কাটিয়ে তাঁতশিল্প ঘুড়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ ঘন ঘন লোডশেডিং, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে তাঁত শিল্প খাঁদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে কাপড়ের উৎপাদন খরচ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কাপড়েরর বাজারে। আগে শাহজাদপু হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ৪-৫ ট্রাক শাড়ী লুঙ্গি কিনে নিয়ে যেত। দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এক দুই ট্রাক কাপড় কিনছেন।

ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরেনর আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের প্রতিনিধি পলাশ দত্ত জানান, বাংলাদেশের উন্নতমানের শাড়ী লুঙ্গি, থ্রি পিস পশ্চিম বাংলার কলকাতা, ডালখোলা, খড়কপুর, মাদাহ, মুর্শিদাবাদ, ভগবানগোলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট ছোট পাইকার ও খুচরা দোকানিদের কাছে পাবনা-সিরাজগঞ্জের কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক আতাইকুলা, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও এনায়েতপুর হাট থেকে প্রতি মাসে এখান থেকে ৩০ ট্রাক কাপড় কিনে ভারতে পাঠাতেন। সেই কাপড় বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দামে বিক্রি করা হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সবাই মিলে মাত্র ৪-৫ ট্রাক কাপড় কিনছেন বলে তিনি জানান।

পাবনা ইন্ডাষ্ট্রিয়েল ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোঃ শাজাহান আলী আশরাফি বলেন, তাঁত কারখানা মালিকদের বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে, আবার উচ্চমূল্যে ডিজেল কিনে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে কাপড় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁত কারখানা মালিকদের। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বলেন, লোডশেডিং ও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে অধিকাংশ সময় কারখানায় কাপড় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। শ্রমিকরাও কাজ করতে পারছেনা। নতুন করে তেলের দাম বৃদ্ধিতে সুতার দাম বেড়েছে। আর যতটুকু কাপড় তৈরি করা হচ্ছে, তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। তিনি জানান, দুটি জেলায় প্রায় তিন লাখ তাঁত আছে। এরমধ্যে লক্ষাধিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে শ্রমিকরাও বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে কারখানা চালানো যাচ্ছে না।

তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা-সিরাজগঞ্জের চৌহালীর এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি আতাইকুলা চারটি কাপড়ের হাট গড়ে উঠেছে। হাটগুলোতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংক, কাপড় ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, আতাইকুলা হাটে প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে ৬দিন (দিনরাত মিলে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে এসে শাড়ী, লুঙ্গি ক্রয় করে থাকেন। ভারতের ব্যবসায়ীরা এসব হাট থেকে শাড়ী ও লুঙ্গি কিনে থাকেন। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ শত কোটি টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রফতানি ও ব্যাংক লেনদেন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এই পরিসংখানে তাঁতশিল্প বিপর্যয়ে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।