ঢাকা ০৮:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা

মোঃ নাহিদ হোসেন
  • আপডেট সময় : ০৫:৩২:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • / ৬৯৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিনোদন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যপিয়াস মেটানোর জন্য রুপ-রস-গন্ধে ভরা নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবগাহন করেছে। বাংলাদেশ প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোন সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। ব-দ্বীপ সদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূ-ভাগ এবং সমুদ্র শুনিত বিস্তীর্ণ উপকূল। তাই প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

এখন শুধু আনন্দের খোরাক হিসেবে পর্যটনকে দেখা হয়না, বরং এটিকে দেখা হয় একটি শিল্প হিসেবে । যে কোনো স্থানের পর্যটন বিকাশের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সে স্থানের নিরাপত্তা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম অগ্রাধিকার খাত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, ২০১৮ সালে ১০টি শীর্ষ পর্যটকের দেশ হলো : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, জার্মানি ও থাইল্যান্ড। অথচ বিশ্বের অন্যতম পর্যটনবান্ধব দেশ হয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে তলানিতেই পড়ে আছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭’ অনুযায়ী, ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন। ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা বিশ্বে ভ্রমণ করবে। অর্থাৎ গত ৬৭ বছরে পর্যটক সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেড়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে।

‘পর্যটনকে নিয়ে আগে সেভাবে চিন্তা করা হয়নি, কিন্তু আজকে চিন্তা করা হচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটনে। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সেজন্য দরকার পর্যটনকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। দেশি-বিদেশি থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের সবাইকে পর্যটনের বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে’,বলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ।

সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে ।পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া আরো চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরো চাঙ্গা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়ামসিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ এভিয়েশন খাত নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। নতুন নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের অনুমোদন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বৃদ্ধি, বিমানবন্দর আধুনিকায়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাংলাদেশ পর্যটনকে আধুনিকায়নে ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সেবা প্রদানের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। চাঁদপুরের মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র।  নির্মাণ শুরু হতে যাওয়া এ পর্যটন প্রকল্পে থাকবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, চার কিলোমিটার দীর্ঘ কেবল কার, ট্রাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিম পার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, জিমন্যাশিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টি সেন্টার, হলি কর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, এগ্রিট্যুরিজম, গ্রিনএনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল প্রভৃতি। ব্লুরিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা ও ২০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের সুবিধা থাকবে। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।

পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশি পর্যটকনির্ভরতা ছাড়াও দেশের পর্যটক নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। এক হিসাবে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষ, গড়ে প্রতি বছর ১০ ভাগও যদি দেশ ঘুরে দেখে তাহলে বিশাল অংকের অর্থনৈতিক তত্পরতা সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন করেছে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল—গত আট বছরে ৬ হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবকালীন মানুষের ঘুরে বেড়ানোর যে প্রবণতা, তা এই অর্থনৈতিক বিকাশ আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পক্ষ অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে।

২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। বাংলাদেশের জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান; যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, বাংলাদেশকে গড়ে তুলছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে।

প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প সম্পর্কে কোন কথা বলতে গেলেই এই খাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান সবার আগে সামনে আসবে। তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দিন বদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৪০ লাখ পর্যটক আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকল্পে প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পর্যটন এলাকায় হোটেল বৃদ্ধি এবং পর্যটন ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, নবদিগন্তের ভোরের সূর্যের আলোর ন্যায় আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশের পর্যটন। কবির ভাষায় ‘বাংলাদেশের নদী মাঠ বেথুই বনের ধারে, পাঠিও বিধি আমায় বারে বারে।’

[লেখক : সায়েন্টিফিক এ্যাসিস্ট্যান্ট-১, ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্স (আইসিএস), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। Mail: nahidpust@gmail.com]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা

আপডেট সময় : ০৫:৩২:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিনোদন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যপিয়াস মেটানোর জন্য রুপ-রস-গন্ধে ভরা নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবগাহন করেছে। বাংলাদেশ প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোন সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। ব-দ্বীপ সদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূ-ভাগ এবং সমুদ্র শুনিত বিস্তীর্ণ উপকূল। তাই প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

এখন শুধু আনন্দের খোরাক হিসেবে পর্যটনকে দেখা হয়না, বরং এটিকে দেখা হয় একটি শিল্প হিসেবে । যে কোনো স্থানের পর্যটন বিকাশের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সে স্থানের নিরাপত্তা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম অগ্রাধিকার খাত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, ২০১৮ সালে ১০টি শীর্ষ পর্যটকের দেশ হলো : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, জার্মানি ও থাইল্যান্ড। অথচ বিশ্বের অন্যতম পর্যটনবান্ধব দেশ হয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে তলানিতেই পড়ে আছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭’ অনুযায়ী, ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন। ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা বিশ্বে ভ্রমণ করবে। অর্থাৎ গত ৬৭ বছরে পর্যটক সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেড়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে।

‘পর্যটনকে নিয়ে আগে সেভাবে চিন্তা করা হয়নি, কিন্তু আজকে চিন্তা করা হচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটনে। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সেজন্য দরকার পর্যটনকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। দেশি-বিদেশি থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের সবাইকে পর্যটনের বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে’,বলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ।

সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে ।পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া আরো চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরো চাঙ্গা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়ামসিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ এভিয়েশন খাত নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। নতুন নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের অনুমোদন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বৃদ্ধি, বিমানবন্দর আধুনিকায়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাংলাদেশ পর্যটনকে আধুনিকায়নে ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সেবা প্রদানের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। চাঁদপুরের মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র।  নির্মাণ শুরু হতে যাওয়া এ পর্যটন প্রকল্পে থাকবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, চার কিলোমিটার দীর্ঘ কেবল কার, ট্রাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিম পার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, জিমন্যাশিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টি সেন্টার, হলি কর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, এগ্রিট্যুরিজম, গ্রিনএনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল প্রভৃতি। ব্লুরিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা ও ২০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের সুবিধা থাকবে। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।

পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশি পর্যটকনির্ভরতা ছাড়াও দেশের পর্যটক নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। এক হিসাবে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষ, গড়ে প্রতি বছর ১০ ভাগও যদি দেশ ঘুরে দেখে তাহলে বিশাল অংকের অর্থনৈতিক তত্পরতা সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন করেছে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল—গত আট বছরে ৬ হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবকালীন মানুষের ঘুরে বেড়ানোর যে প্রবণতা, তা এই অর্থনৈতিক বিকাশ আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পক্ষ অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে।

২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। বাংলাদেশের জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান; যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, বাংলাদেশকে গড়ে তুলছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে।

প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প সম্পর্কে কোন কথা বলতে গেলেই এই খাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান সবার আগে সামনে আসবে। তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দিন বদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৪০ লাখ পর্যটক আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকল্পে প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পর্যটন এলাকায় হোটেল বৃদ্ধি এবং পর্যটন ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, নবদিগন্তের ভোরের সূর্যের আলোর ন্যায় আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশের পর্যটন। কবির ভাষায় ‘বাংলাদেশের নদী মাঠ বেথুই বনের ধারে, পাঠিও বিধি আমায় বারে বারে।’

[লেখক : সায়েন্টিফিক এ্যাসিস্ট্যান্ট-১, ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্স (আইসিএস), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। Mail: nahidpust@gmail.com]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)