ঢাকা ০৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

তাঁতপল্লীতে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য : তাঁতীদের মুখে ফুঁটেছে হাঁসি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:৩১:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩
  • / ৪৯৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

// শফিউল আযম ও শামছুর রহমান শিশির //

আসন্ন ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্র সিরাজগঞ্জ, কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুরসহ বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের তাঁতপ্রধান পল্লীগুলো কর্মমূখর হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের তাঁত মালিক ও শ্রমিকের ব্যতিব্যস্ততায় মূখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লীগুলো। বৃহত্তর পাবনা জেলার পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এ দু’টি জেলার তাঁতপল্লীতে তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত আধুনিক রুচিশীল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা থ্রিপিছসহ নানা দেশীয় তাঁতবস্ত্র। শাড়ির উপরে বর্ণিল সুতা, ব্লক, বাটিক ও চুমকির কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া, কাপড়ের উপর প্রিন্ট এবং রঙ তুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি কাপড়ের চাহিদা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে  দেশে-বিদেশে। ব্যাক্তি উদ্যোগে এসব তাঁতবস্ত্র রফতানি হচ্ছে ভারত, জার্মানী, ইটালী, ইংল্যান্ডসহ বহিঃবিশ্বের নানা দেশে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত তাঁতের শাড়ির শতকরা ৪০ ভাগ রফতানি হচ্ছে ভারতে। নানা রং-বেরংয়ের বাহারী ডিজাইনের দেশি তাঁতের শাড়ির গুণগত মান ও বাজার দর ভারতীয় বস্ত্র বাজারের অনুকূলে থাকায় শাহজাদপুরসহ পাবনা- সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীতে উৎপাদিত তাঁতের শাড়ির কদর ও চাহিদা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমশই বাড়ছে। ভারতসহ বহিঃবিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভিত্তিতে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রফতানি করতে পেরে তাঁতীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালীতে তৈরি তাঁতবস্ত্র ইতোমধ্যে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় তৈরি করছেন তাঁত কারখানার মালিকরা। কাপড়ের উৎপাদন বৃ্দ্ধিতে কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকেরা। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহল আর তাঁতের খট্খট্ শব্দে সরব হয়ে উঠেছে এবং প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, চৌহালী, সুজানগর ও ঈশ্বরদীসহ বৃহত্তর পাবনার তাঁতপল্লী। কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে  নলি ভরা, সুতা পারি করা, মাড় দেয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননোর কাজ ও হ্যান্ড থাইজিংয়েও সহযোগিতা করছে ওই এলাকার নারী শ্রমিকরা। বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে দাম। এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন তাঁত ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন শাহজাদপুর কাপড়ের হাট পরিদর্শন করে ও অসংখ্য তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ, নরসিংন্দী, ঢাকার মিরপুরের বেনারসী, সোঁনারগাঁ’র জামদানী, যশোরের মোমিননগর নওদ গ্রামে তৈরি হস্তচালিত ও বৈদ্যুতিক পাওয়ারলুলে উৎপাদিত তাঁতের শাড়িসহ দেশের তাঁতসমৃদ্ধ প্রায় সকল এলাকা থেকে শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে তাঁতের শাড়ি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য শত শত ব্যাপারী পাইকারেরা সপ্তাহের দুটি হাটে শাহজাদপুরে আসছেন। ঐহিত্যবাহী শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের লালমিয়া সুপার মার্কেটের আকন্দ টেক্সটাইল পরিদর্শনকালে তাঁতবস্ত্র রফতানিকারক লুৎফর রহমান লিটন আকন্দ জানান, ‘ঐহিত্যবাহী শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সিজনের প্রতি হাটে অসংখ্য ভারতীয় ক্রেতা শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে শাড়ি কাপড় ক্রয়ে আসছেন। তারা একেকজন কমপক্ষে ২ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়ি থেকে শুরু করে ১৫ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়িও ক্রয় করছেন।

পাবনার সুজানগর উপজেলার দোগাছির তাঁত কারখানা মালিক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক মানের এবং সময় উপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় দেশীয় তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাঁতীরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসাবে দেখছেন না। মানন্ধাত্তার আমলের বুনোন শৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছেন। ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সাথে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময় উপযোগী করে বুনোন শৈলী নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা আর রঙের এর মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলের তাঁতের কাপড়।

এ অঞ্চলের তাঁতপল্লীতে উন্নতমানের সিল্ক জামদানী, সুতি, কাতান, চোষা, সুতী জামদানী, বেনারশী, মিষ্টি পরী ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিছ ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব তাঁতবস্ত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বুটিক হাউজ কে-ক্রাফট তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে কানাডা ও আমেরিকায় এবং নগরদোলা বুটিক হাউজ ইংল্যান্ডে বাজারজাত করছে। এদিকে ঈদের বাজারে সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, চাচকিয়া, ওয়েষ্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্রান্ডের লুঙ্গির চাহিদা বেড়েছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ৩৮০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

শাহজাদপুর হাটে ভারতীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিমদিনাজপুর, উত্তরদিনাজপুর, দক্ষিণদিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামী শপিংমল ও বিপণী বিতানগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন ব্রান্ডের শাড়ী বিক্রি হয়। রমজানের ঈদ ও বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানে বাংলাদেশি শাড়ীর বাজার জমে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাংগাইল, ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলার তাঁত কারখানাগুলোতে তৈরি সিল্ক জামদানী, সুতি জামদানী, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারশী, চোষা, শেড, স্বর্ণলতা, কটন শাড়ী ভারতে রফতানি হচ্ছে। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি উন্নতমান, টেকসই, রুচিশীল শাড়ীর দাম কম হওযায় পশ্চিমবাংলার মহিলাদের বেশি পছন্দ বাংলাদেশি শাড়ী। শাহজাদপুর একটি উপজেলা শহর হলেও উত্তরাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবসায় সফল এলাকা হওয়ায় এখানে সরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা’র পাশাপাশি বেসরকারি ডাচবাংলা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাক, আল আরাফা ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংকসহ বিভিন্ন তফশীলি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। ফলে সব ধরনের ব্যাংকিং লেদনের সুযোগ থাকায় ব্যাপারী পাইকারদের তাঁতবস্ত্রের ব্যাবসা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তবে, দেশের হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুমে উৎপাদিত বিশ্বমানের তাঁতবস্ত্র বিশ্বের প্রতিটি দেশে রফতানির জন্য সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের তাঁতের শাড়ি তৈরিতেও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগীতা সরকারের কাছে চেয়েছেন এ অঞ্চলের প্রান্তিক তাঁতী ও মহাজনেরা।

পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ির আমদানিকারক সেলিম খাঁন জানান, রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বাজার ধরা জন্য পশ্চিমবাংলার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে আতাইকুলা, শাহজাদপুরহাট, এনায়েতপুরহাট, করোটিয়াহাট, বাবুরহাট ও ডেমরাহাট থেকে শাড়ী কিনছেন। এছাড়া রাজশাহীর সিল্ক, গরদ, পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারশি কাতান, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহাজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়ার স্বর্ণলতা, চোষা ও শেড শাড়ী, টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলসুধা, চিনাখোলা, দেওজান, নলুয়া, হিঙ্গানগর, এলাসিন, বাতুলি, বাজিদপুর, বল্লা, রামপুরের সুতি জামদানি, সিল্ক জামদানি ঢাকার মিরপুরের বেনারশি কাতান ও নারায়নগঞ্জের ডেমরার জামদানি তাঁত কারখানাগুলোতে গিয়ে পছন্দমতো শাড়ী কিনে নিচ্ছেন।

তাঁতীদের নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে শাড়ী তৈরি করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ এক হাজার থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা দামে কিনছেন। পরে সেই কাপড় সড়ক পথে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলার শপিংমল, বিপণীবিতানগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।

শাহজাদপুরের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রয় হচ্ছে। সে দেশের চেয়ে এদেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকশই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন।

বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলা সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিক্স তৈরি করা হচ্ছে  তাঁত পল্লীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরণের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতীরা উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ আর ফতুয়া তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ আড়াই হাজার থেকে  সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০  টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

শাহজাদপুর পৌর এলাকার থানারঘাট সংলগ্ন মুকুল উইভিং ফ্যাক্টরির সত্ত্বাধিকারী হাজী আব্দুর রউফ (বুলবুল) জানান, মানন্ধাতা আমলের বুনোন শৈলী বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এ শিল্প সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এবারের ঈদে বিশেষ আকর্ষন হচ্ছে শতভাগ কটন শাড়ি। উন্নতমানের কটনে তৈরী এ শাড়ির দুই দিকেই সদর। দাম হাতের নাগালের মধ্যে অর্থাৎ এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা। ইতোমধ্যে এই কটন শাড়ির ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কারখানায় শাড়ী উৎপাদনের সাথে সাথে বিক্রি হচ্ছে। আর কয়েকদিন পর অর্ডারের শাড়ী তৈরীর কাজ শুরু হবে বলে হাজী আব্দুর রউফ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড পাওয়ারলুম এন্ড হ্যান্ডলুম ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড এর উত্তরাঞ্চলের সাবেক পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এ্যান্ড পাওয়ারলুম ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ হায়দার আলী জানান, ‘শাহজাদপুরসহ বৃহত্তর পাবনার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকায় রোজার ঈদ ও বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে বর্তমানে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী তাঁতের কাপড়ের উৎপাদনের মোট অংশের শতকরা ৪০ ভাগ কাপড় শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে কেবলমাত্র ভারতেই রফতানি হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তাঁতবস্ত্রের ব্যাপক কদর থানায় ব্যাক্তি উদ্যোগে নানা দেশে রফতানি হচ্ছে। অতীতে এদেশের তাঁতীদের তৈরি বিশ্ববিখ্যাত মসলিন শাড়ি বিশ্বকজুড়ে খ্যাতি অর্জনের পর বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশের করা মন্তব্যটি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময়ের বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশ বস্ত্র উৎপাদনকারীরা ভবিষ্যতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী হবে বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমাদের দেশের তাঁতে তৈরি মসলিন শাড়ি একসময় যেমন বিশ্বখ্যাত হয়েছিল তেমনি সরকারিভাবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে ঘুরে দাঁড়াবে তাঁতশিল্প; জাতীয় অর্থনীতি হবে আরও সমৃদ্ধশালী এবং ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশের করা ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে প্রতিফলিত হবে।

বা/খ: এসআর।

 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

তাঁতপল্লীতে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য : তাঁতীদের মুখে ফুঁটেছে হাঁসি

আপডেট সময় : ১১:৩১:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩

// শফিউল আযম ও শামছুর রহমান শিশির //

আসন্ন ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্র সিরাজগঞ্জ, কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুরসহ বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের তাঁতপ্রধান পল্লীগুলো কর্মমূখর হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের তাঁত মালিক ও শ্রমিকের ব্যতিব্যস্ততায় মূখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লীগুলো। বৃহত্তর পাবনা জেলার পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এ দু’টি জেলার তাঁতপল্লীতে তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত আধুনিক রুচিশীল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা থ্রিপিছসহ নানা দেশীয় তাঁতবস্ত্র। শাড়ির উপরে বর্ণিল সুতা, ব্লক, বাটিক ও চুমকির কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া, কাপড়ের উপর প্রিন্ট এবং রঙ তুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি কাপড়ের চাহিদা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে  দেশে-বিদেশে। ব্যাক্তি উদ্যোগে এসব তাঁতবস্ত্র রফতানি হচ্ছে ভারত, জার্মানী, ইটালী, ইংল্যান্ডসহ বহিঃবিশ্বের নানা দেশে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত তাঁতের শাড়ির শতকরা ৪০ ভাগ রফতানি হচ্ছে ভারতে। নানা রং-বেরংয়ের বাহারী ডিজাইনের দেশি তাঁতের শাড়ির গুণগত মান ও বাজার দর ভারতীয় বস্ত্র বাজারের অনুকূলে থাকায় শাহজাদপুরসহ পাবনা- সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীতে উৎপাদিত তাঁতের শাড়ির কদর ও চাহিদা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমশই বাড়ছে। ভারতসহ বহিঃবিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভিত্তিতে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রফতানি করতে পেরে তাঁতীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালীতে তৈরি তাঁতবস্ত্র ইতোমধ্যে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় তৈরি করছেন তাঁত কারখানার মালিকরা। কাপড়ের উৎপাদন বৃ্দ্ধিতে কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকেরা। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহল আর তাঁতের খট্খট্ শব্দে সরব হয়ে উঠেছে এবং প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, চৌহালী, সুজানগর ও ঈশ্বরদীসহ বৃহত্তর পাবনার তাঁতপল্লী। কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে  নলি ভরা, সুতা পারি করা, মাড় দেয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননোর কাজ ও হ্যান্ড থাইজিংয়েও সহযোগিতা করছে ওই এলাকার নারী শ্রমিকরা। বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে দাম। এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন তাঁত ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন শাহজাদপুর কাপড়ের হাট পরিদর্শন করে ও অসংখ্য তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ, নরসিংন্দী, ঢাকার মিরপুরের বেনারসী, সোঁনারগাঁ’র জামদানী, যশোরের মোমিননগর নওদ গ্রামে তৈরি হস্তচালিত ও বৈদ্যুতিক পাওয়ারলুলে উৎপাদিত তাঁতের শাড়িসহ দেশের তাঁতসমৃদ্ধ প্রায় সকল এলাকা থেকে শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে তাঁতের শাড়ি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য শত শত ব্যাপারী পাইকারেরা সপ্তাহের দুটি হাটে শাহজাদপুরে আসছেন। ঐহিত্যবাহী শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের লালমিয়া সুপার মার্কেটের আকন্দ টেক্সটাইল পরিদর্শনকালে তাঁতবস্ত্র রফতানিকারক লুৎফর রহমান লিটন আকন্দ জানান, ‘ঐহিত্যবাহী শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সিজনের প্রতি হাটে অসংখ্য ভারতীয় ক্রেতা শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে শাড়ি কাপড় ক্রয়ে আসছেন। তারা একেকজন কমপক্ষে ২ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়ি থেকে শুরু করে ১৫ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়িও ক্রয় করছেন।

পাবনার সুজানগর উপজেলার দোগাছির তাঁত কারখানা মালিক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক মানের এবং সময় উপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় দেশীয় তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাঁতীরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসাবে দেখছেন না। মানন্ধাত্তার আমলের বুনোন শৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছেন। ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সাথে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময় উপযোগী করে বুনোন শৈলী নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা আর রঙের এর মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলের তাঁতের কাপড়।

এ অঞ্চলের তাঁতপল্লীতে উন্নতমানের সিল্ক জামদানী, সুতি, কাতান, চোষা, সুতী জামদানী, বেনারশী, মিষ্টি পরী ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিছ ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব তাঁতবস্ত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বুটিক হাউজ কে-ক্রাফট তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে কানাডা ও আমেরিকায় এবং নগরদোলা বুটিক হাউজ ইংল্যান্ডে বাজারজাত করছে। এদিকে ঈদের বাজারে সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, চাচকিয়া, ওয়েষ্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্রান্ডের লুঙ্গির চাহিদা বেড়েছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ৩৮০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

শাহজাদপুর হাটে ভারতীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিমদিনাজপুর, উত্তরদিনাজপুর, দক্ষিণদিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামী শপিংমল ও বিপণী বিতানগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন ব্রান্ডের শাড়ী বিক্রি হয়। রমজানের ঈদ ও বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানে বাংলাদেশি শাড়ীর বাজার জমে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাংগাইল, ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলার তাঁত কারখানাগুলোতে তৈরি সিল্ক জামদানী, সুতি জামদানী, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারশী, চোষা, শেড, স্বর্ণলতা, কটন শাড়ী ভারতে রফতানি হচ্ছে। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি উন্নতমান, টেকসই, রুচিশীল শাড়ীর দাম কম হওযায় পশ্চিমবাংলার মহিলাদের বেশি পছন্দ বাংলাদেশি শাড়ী। শাহজাদপুর একটি উপজেলা শহর হলেও উত্তরাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবসায় সফল এলাকা হওয়ায় এখানে সরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা’র পাশাপাশি বেসরকারি ডাচবাংলা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাক, আল আরাফা ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংকসহ বিভিন্ন তফশীলি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। ফলে সব ধরনের ব্যাংকিং লেদনের সুযোগ থাকায় ব্যাপারী পাইকারদের তাঁতবস্ত্রের ব্যাবসা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তবে, দেশের হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুমে উৎপাদিত বিশ্বমানের তাঁতবস্ত্র বিশ্বের প্রতিটি দেশে রফতানির জন্য সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের তাঁতের শাড়ি তৈরিতেও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগীতা সরকারের কাছে চেয়েছেন এ অঞ্চলের প্রান্তিক তাঁতী ও মহাজনেরা।

পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ির আমদানিকারক সেলিম খাঁন জানান, রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বাজার ধরা জন্য পশ্চিমবাংলার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে আতাইকুলা, শাহজাদপুরহাট, এনায়েতপুরহাট, করোটিয়াহাট, বাবুরহাট ও ডেমরাহাট থেকে শাড়ী কিনছেন। এছাড়া রাজশাহীর সিল্ক, গরদ, পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারশি কাতান, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহাজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়ার স্বর্ণলতা, চোষা ও শেড শাড়ী, টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলসুধা, চিনাখোলা, দেওজান, নলুয়া, হিঙ্গানগর, এলাসিন, বাতুলি, বাজিদপুর, বল্লা, রামপুরের সুতি জামদানি, সিল্ক জামদানি ঢাকার মিরপুরের বেনারশি কাতান ও নারায়নগঞ্জের ডেমরার জামদানি তাঁত কারখানাগুলোতে গিয়ে পছন্দমতো শাড়ী কিনে নিচ্ছেন।

তাঁতীদের নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে শাড়ী তৈরি করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ এক হাজার থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা দামে কিনছেন। পরে সেই কাপড় সড়ক পথে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলার শপিংমল, বিপণীবিতানগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।

শাহজাদপুরের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা রমজানের ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রয় হচ্ছে। সে দেশের চেয়ে এদেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকশই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন।

বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলা সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিক্স তৈরি করা হচ্ছে  তাঁত পল্লীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরণের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতীরা উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ আর ফতুয়া তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ আড়াই হাজার থেকে  সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০  টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

শাহজাদপুর পৌর এলাকার থানারঘাট সংলগ্ন মুকুল উইভিং ফ্যাক্টরির সত্ত্বাধিকারী হাজী আব্দুর রউফ (বুলবুল) জানান, মানন্ধাতা আমলের বুনোন শৈলী বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এ শিল্প সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এবারের ঈদে বিশেষ আকর্ষন হচ্ছে শতভাগ কটন শাড়ি। উন্নতমানের কটনে তৈরী এ শাড়ির দুই দিকেই সদর। দাম হাতের নাগালের মধ্যে অর্থাৎ এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা। ইতোমধ্যে এই কটন শাড়ির ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কারখানায় শাড়ী উৎপাদনের সাথে সাথে বিক্রি হচ্ছে। আর কয়েকদিন পর অর্ডারের শাড়ী তৈরীর কাজ শুরু হবে বলে হাজী আব্দুর রউফ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড পাওয়ারলুম এন্ড হ্যান্ডলুম ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড এর উত্তরাঞ্চলের সাবেক পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এ্যান্ড পাওয়ারলুম ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ হায়দার আলী জানান, ‘শাহজাদপুরসহ বৃহত্তর পাবনার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকায় রোজার ঈদ ও বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে বর্তমানে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী তাঁতের কাপড়ের উৎপাদনের মোট অংশের শতকরা ৪০ ভাগ কাপড় শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে কেবলমাত্র ভারতেই রফতানি হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তাঁতবস্ত্রের ব্যাপক কদর থানায় ব্যাক্তি উদ্যোগে নানা দেশে রফতানি হচ্ছে। অতীতে এদেশের তাঁতীদের তৈরি বিশ্ববিখ্যাত মসলিন শাড়ি বিশ্বকজুড়ে খ্যাতি অর্জনের পর বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশের করা মন্তব্যটি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময়ের বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশ বস্ত্র উৎপাদনকারীরা ভবিষ্যতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী হবে বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমাদের দেশের তাঁতে তৈরি মসলিন শাড়ি একসময় যেমন বিশ্বখ্যাত হয়েছিল তেমনি সরকারিভাবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে ঘুরে দাঁড়াবে তাঁতশিল্প; জাতীয় অর্থনীতি হবে আরও সমৃদ্ধশালী এবং ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিশের করা ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে প্রতিফলিত হবে।

বা/খ: এসআর।