ঢাকা ০৩:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পাবনার হাট-বাজারে বোরো ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষক উৎকন্ঠায়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৪৬:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ মে ২০২৩
  • / ৫০১ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

// শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি //

পাবনা অঞ্চলে বোরো ধান কাটা মাড়াই চলছে পুরোদমে। ধানই কৃষকের জীবন; অথচ সেই ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষকের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা ও উৎকন্ঠা। প্রতিবিঘা (৩৩শতাংশ) জমিতে ধান উৎপাদনে এলাকাভেদে খরচ পড়েছে ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় গড় ফলন হয়েছে ১৮ থেকে ২০ মন। বর্তমানে হাট-বাজারে প্রতিমণ ধানের দাম ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা দরে। মওসুমের শুরুতে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়।

চলতি মওসুমে বোরো ধান আবাদ করে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। আগাম দাদন নিয়ে ধান আবাদ করায় টাকা পরিশোধের তাগাদায় কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। তাই বাম্পার ফলনে হাঁসি নেই কৃষকের মুখে। অপরদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। প্রতিদিন ৭০০ টাকা মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় এবার প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন দুই দশমিক সাত মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসেবে এবছর জেলায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও এক লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রচন্ড খরা ও দাবদাহের পরও জেলায় বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এ অঞ্চলে এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। এদিকে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দেয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে। স্থানীয় হাট-বাজারে প্রচুর ধান আমদানি হচ্ছে। ধানের ক্রেতা, চাহিদা ও দাম কম। বাজারদর নিয়ন্ত্রন করছে ফড়িয়া ও দালালেরা। এ অঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ কৃষক পরিবার বোরো আবাদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাবনা অঞ্চলের কৃষকদের বোরো ধানের দামই ছিল ভরসা। উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। এ অঞ্চলের গ্রামীন অর্থনীতিতে বিরাজ করছে মন্দাভাব। ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন কৃষক। বেশির ভাগ কৃষক চড়া সুদে দাদন নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। বোরো ধান আবাদ করে বর্গাচাষি ও লিজ গ্রহীতাদের উৎপাদন খরচ উঠা তো দুরের কথা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কৃষক পরিবারের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেরা ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে।

বাঘাবাড়ি থেকে ফরিদপুর যেতে সড়কের পাশে “ক্ষেতে বাতাসে দুলছে ধানের যৌবন/ঘরে ঘরে পুরছে ——-?” অচেনা এই গান শুনে তাকাতেই চোখে পড়ল জমির ধান কাটতে কাটতে আনমনে গান গাইছেন ১২ জন ক্ষেতমজুর। এ গান আঞ্চলিক কিনা জানতে চাইলে সিএনজি চালক আব্দুল মালেক জানালেন স্যার বুঝলেন না, এটা ক্ষেতমজুরদের গান। কৃষক প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে ধান আবাদ করে বিক্রি করছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। কিন্তু ধানের দরপতনে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, দাদনের টাকা পরিশোধ করতেই সব শেষ। অথচ ঘরে ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে। কৃষকের ধানই সব। অথচ সেই ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সর্বনাশ। ক্ষেতে ধান রেখেই গ্রামের কৃষকেরা অনেক স্বপ্ন বোনেন। ধান বিক্রি করে কেউ মেয়ের বিয়ে দেবেন, কেউ বছরের জামা-কাপড়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার যোগান দেবেন, ধার-দেনা দেবেন, স্ত্রীর শখ মেটাবেন।

জানা যায়, কেউ ধার-দেনা করে, কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম টাকা নিয়ে জমিতে ধান বুনেছিলেন। ফলন হয়েছে বাম্পার। কিন্তু বাজারে ধানের দরপতনে সব স্বপ্নই শেষ। এক মন ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে জমি ভেদে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা। অথচ এলাকাভেদে ব্রী-২৮ ধান এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, ব্রী-২৯ ধান এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, ব্রী-৯০ ধান এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০, ব্রী-৩৬ ধান এক হাজার ২২০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, চার ক্যাটাগীভোগ ধান এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, মিনিকেট এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে। এবার মওসুমের শুরুতে প্রকারভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়। বর্তমানে একজন ক্ষেত মজুরের প্রতিদিনের মজুরি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কৃষকের কপাল পুরছে অথচ ক্ষেতমজুরেরা আনন্দে গান গাইছে। পাবনার ফরিদপুর যাওয়ার পথে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, নাগডেমরা, বড়ডেমরা, কালিয়ানি, মাজাট গ্রামে চোখে পড়ে এ দৃশ্য।

চোখ যেদিকে যায় দেখলে মনে হবে মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বাতাসে পাঁকা ধানের শিষ দোলা খাচ্ছে। সোনা রাঙা ধানের ওপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। সোনালি ফসলের সমারোহ; প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আবহাওয়া ভালো হওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো। কৃষাণ-কৃষাণিদের ঘরে ঘরে ধান কাটা মাড়াই চলছে। তারা ধান বিক্রি করে মেয়ে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু ধানের যে দাম তাতে স্বপ্ন পুরণ তো দুরের কথা জমি বিক্রি করে দাদনের টাকা শোধ করতে হবে।

বাঘাবাড়ী থেকে সিএনজিতে ফরিদপুর যাওয়ার সময় সড়কের পাশে পাথালিয়াহাট গ্রামে হঠাৎ চোখে পড়ল গৃহস্থের উঠানে কয়েকজন মেয়ে বাতাসে ধান (বাতাসে চিটা পাতা থেকে ধান আলাদা করা) উড়াচ্ছে। দু’জন পুরুষ হাঁকডাক করছেন। কয়েক গজ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল কয়েকজন পুরুষ বসে গল্প করছেন। ধানের দাম না থাকায় নিজেদের দুর্দশার কথা একে অন্যকে শোনাচ্ছেন। একটু দুরে এক কৃষক মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে কি যেন করছেন। কাছে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খালি গায়ের উসকো খুসকো লোকটাকে দেখেই সিএনজি চালক বললেন, স্যার দেখেন কৃষকের হাল। ধান চাষ করে এ অবস্থা হয়েছে। কফিল নামের ওই কৃষক বললেন, আমার কপাল পুরছে বাবা। কৃষকের দিকে দেখার কেউ নাই। ধানের দাম এত কম ক্যান হলো বুঝতে পারি নাই। বুঝলেন দাদনে টাকা নিয়া ধান আবাদ কইরা এখন ফতুর ওতে না হয়। মেয়ের বিয়া ঠিক ওইছে। এখন কি করমু বুঝবার পারছি না।

পাবনার হাট-বাজারে বোরো ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষক উৎকন্ঠায়

বাঘাবাড়ী দক্ষিণপাড়ের চৌরাস্তা থেকে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, বড়ডেমরা, বনওয়ারিনগর হয়ে ফরিদপুরে নামতে হলো। সিএনজি ভাঙ্গুড়া হয়ে চাটমোহর চলে যাবে। পথে কেউ নামছেন আবার কেউ উঠছেন। বিভিন্ন জনের সাথে ধানের ফলন ও দাম নিয়ে কথা হলো। সবার এক কথা ধানের দাম কৃষকের সর্বনাশ করেছে। ফলন ভালো হওয়ার পরেও উৎপাদন খরচ না ওঠায় সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে কৃষক। উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় এখন তেভাগায় বর্গা চাষি পাওয়া যায় না। পথে কিছু কিছু জমিতে দেখা গেল মরিচ, পটল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়েছে। কৃষক ছালাম, গোপাল কুন্ডু, জয়নাল, আজিবর, রতন মৃধা জানালেন, ধানের দাম না পাওয়ায় অনেকেই এখন মরিচ, পটলসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করেছেন। তারাও অন্য ফসল আবাদের কথা ভাবছেন।

ডেমরা গ্রামের কৃষক শাহেদ আলী জানালেন, রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ক্ষেতের ধানে সোনালি রঙ ধরেছে। পাকা ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক। কিন্তু বাম্পার ফলনে তাদের মুখে হাসি নেই।

সাঁথিয়ার ধুলাউরি হাটে একাধিক কৃষকের সাথে কথা হয়। এলাকার সম্ভ্রান্ত কৃষক হিসেবে পরিচিত জয়নুল আবেদীন ১৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির সেচ পাঁচ হাজার টাকা, হালচাষ-রোপণে কৃষাণ পাঁচ হাজার টাকা, সার-বীজ-নিড়ানী-কীটনাশক সাড়ে তিন হাজার টাকা, কাটা মাড়াই ছয় হাজার টাকা এবং পরিবহন বাবদ এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২০-২২ হাজার টাকা। তিনি প্রতি বিঘায় গড়ে ধান পেয়েছেন ২০ মন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৩ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা।

কশিনাথপুর হাটে ধান বিক্রি করতে আসা মাসুমদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস ছামাদ প্রামানিক জানান, তিন বিঘা জমিতে মিনিকেট ধান চাষ করে বিঘাপ্রতি ১৮ মন ফলন পেয়েছেন। বাজারে এ ধান এক হাজার ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, দাদন নিয়ে ধান আবাদ করে বাজারে এসে পানির দামে ধান বিক্রি করতে হয়। নিজের জমিতে ধান আবাদ না করে লিজ দিয়ে দেব। স্বপ্ন ছিল এবার ধান বেঁচে মেয়ের বিয়ে দেব। কিন্তু পারছি না। বাবা হিসেবে এ দুঃখ রাখি কোথায় ?

নিউজটি শেয়ার করুন

পাবনার হাট-বাজারে বোরো ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষক উৎকন্ঠায়

আপডেট সময় : ০৬:৪৬:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ মে ২০২৩

// শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি //

পাবনা অঞ্চলে বোরো ধান কাটা মাড়াই চলছে পুরোদমে। ধানই কৃষকের জীবন; অথচ সেই ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষকের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা ও উৎকন্ঠা। প্রতিবিঘা (৩৩শতাংশ) জমিতে ধান উৎপাদনে এলাকাভেদে খরচ পড়েছে ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় গড় ফলন হয়েছে ১৮ থেকে ২০ মন। বর্তমানে হাট-বাজারে প্রতিমণ ধানের দাম ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা দরে। মওসুমের শুরুতে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়।

চলতি মওসুমে বোরো ধান আবাদ করে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। আগাম দাদন নিয়ে ধান আবাদ করায় টাকা পরিশোধের তাগাদায় কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। তাই বাম্পার ফলনে হাঁসি নেই কৃষকের মুখে। অপরদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। প্রতিদিন ৭০০ টাকা মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় এবার প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন দুই দশমিক সাত মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসেবে এবছর জেলায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও এক লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রচন্ড খরা ও দাবদাহের পরও জেলায় বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এ অঞ্চলে এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। এদিকে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দেয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে। স্থানীয় হাট-বাজারে প্রচুর ধান আমদানি হচ্ছে। ধানের ক্রেতা, চাহিদা ও দাম কম। বাজারদর নিয়ন্ত্রন করছে ফড়িয়া ও দালালেরা। এ অঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ কৃষক পরিবার বোরো আবাদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাবনা অঞ্চলের কৃষকদের বোরো ধানের দামই ছিল ভরসা। উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। এ অঞ্চলের গ্রামীন অর্থনীতিতে বিরাজ করছে মন্দাভাব। ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন কৃষক। বেশির ভাগ কৃষক চড়া সুদে দাদন নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। বোরো ধান আবাদ করে বর্গাচাষি ও লিজ গ্রহীতাদের উৎপাদন খরচ উঠা তো দুরের কথা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কৃষক পরিবারের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেরা ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে।

বাঘাবাড়ি থেকে ফরিদপুর যেতে সড়কের পাশে “ক্ষেতে বাতাসে দুলছে ধানের যৌবন/ঘরে ঘরে পুরছে ——-?” অচেনা এই গান শুনে তাকাতেই চোখে পড়ল জমির ধান কাটতে কাটতে আনমনে গান গাইছেন ১২ জন ক্ষেতমজুর। এ গান আঞ্চলিক কিনা জানতে চাইলে সিএনজি চালক আব্দুল মালেক জানালেন স্যার বুঝলেন না, এটা ক্ষেতমজুরদের গান। কৃষক প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে ধান আবাদ করে বিক্রি করছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। কিন্তু ধানের দরপতনে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, দাদনের টাকা পরিশোধ করতেই সব শেষ। অথচ ঘরে ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে। কৃষকের ধানই সব। অথচ সেই ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সর্বনাশ। ক্ষেতে ধান রেখেই গ্রামের কৃষকেরা অনেক স্বপ্ন বোনেন। ধান বিক্রি করে কেউ মেয়ের বিয়ে দেবেন, কেউ বছরের জামা-কাপড়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার যোগান দেবেন, ধার-দেনা দেবেন, স্ত্রীর শখ মেটাবেন।

জানা যায়, কেউ ধার-দেনা করে, কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম টাকা নিয়ে জমিতে ধান বুনেছিলেন। ফলন হয়েছে বাম্পার। কিন্তু বাজারে ধানের দরপতনে সব স্বপ্নই শেষ। এক মন ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে জমি ভেদে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা। অথচ এলাকাভেদে ব্রী-২৮ ধান এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, ব্রী-২৯ ধান এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, ব্রী-৯০ ধান এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০, ব্রী-৩৬ ধান এক হাজার ২২০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, চার ক্যাটাগীভোগ ধান এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, মিনিকেট এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে। এবার মওসুমের শুরুতে প্রকারভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়। বর্তমানে একজন ক্ষেত মজুরের প্রতিদিনের মজুরি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কৃষকের কপাল পুরছে অথচ ক্ষেতমজুরেরা আনন্দে গান গাইছে। পাবনার ফরিদপুর যাওয়ার পথে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, নাগডেমরা, বড়ডেমরা, কালিয়ানি, মাজাট গ্রামে চোখে পড়ে এ দৃশ্য।

চোখ যেদিকে যায় দেখলে মনে হবে মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বাতাসে পাঁকা ধানের শিষ দোলা খাচ্ছে। সোনা রাঙা ধানের ওপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। সোনালি ফসলের সমারোহ; প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আবহাওয়া ভালো হওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো। কৃষাণ-কৃষাণিদের ঘরে ঘরে ধান কাটা মাড়াই চলছে। তারা ধান বিক্রি করে মেয়ে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু ধানের যে দাম তাতে স্বপ্ন পুরণ তো দুরের কথা জমি বিক্রি করে দাদনের টাকা শোধ করতে হবে।

বাঘাবাড়ী থেকে সিএনজিতে ফরিদপুর যাওয়ার সময় সড়কের পাশে পাথালিয়াহাট গ্রামে হঠাৎ চোখে পড়ল গৃহস্থের উঠানে কয়েকজন মেয়ে বাতাসে ধান (বাতাসে চিটা পাতা থেকে ধান আলাদা করা) উড়াচ্ছে। দু’জন পুরুষ হাঁকডাক করছেন। কয়েক গজ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল কয়েকজন পুরুষ বসে গল্প করছেন। ধানের দাম না থাকায় নিজেদের দুর্দশার কথা একে অন্যকে শোনাচ্ছেন। একটু দুরে এক কৃষক মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে কি যেন করছেন। কাছে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খালি গায়ের উসকো খুসকো লোকটাকে দেখেই সিএনজি চালক বললেন, স্যার দেখেন কৃষকের হাল। ধান চাষ করে এ অবস্থা হয়েছে। কফিল নামের ওই কৃষক বললেন, আমার কপাল পুরছে বাবা। কৃষকের দিকে দেখার কেউ নাই। ধানের দাম এত কম ক্যান হলো বুঝতে পারি নাই। বুঝলেন দাদনে টাকা নিয়া ধান আবাদ কইরা এখন ফতুর ওতে না হয়। মেয়ের বিয়া ঠিক ওইছে। এখন কি করমু বুঝবার পারছি না।

পাবনার হাট-বাজারে বোরো ধানের দরপতনে দেড় লাখ কৃষক উৎকন্ঠায়

বাঘাবাড়ী দক্ষিণপাড়ের চৌরাস্তা থেকে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, বড়ডেমরা, বনওয়ারিনগর হয়ে ফরিদপুরে নামতে হলো। সিএনজি ভাঙ্গুড়া হয়ে চাটমোহর চলে যাবে। পথে কেউ নামছেন আবার কেউ উঠছেন। বিভিন্ন জনের সাথে ধানের ফলন ও দাম নিয়ে কথা হলো। সবার এক কথা ধানের দাম কৃষকের সর্বনাশ করেছে। ফলন ভালো হওয়ার পরেও উৎপাদন খরচ না ওঠায় সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে কৃষক। উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় এখন তেভাগায় বর্গা চাষি পাওয়া যায় না। পথে কিছু কিছু জমিতে দেখা গেল মরিচ, পটল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়েছে। কৃষক ছালাম, গোপাল কুন্ডু, জয়নাল, আজিবর, রতন মৃধা জানালেন, ধানের দাম না পাওয়ায় অনেকেই এখন মরিচ, পটলসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করেছেন। তারাও অন্য ফসল আবাদের কথা ভাবছেন।

ডেমরা গ্রামের কৃষক শাহেদ আলী জানালেন, রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ক্ষেতের ধানে সোনালি রঙ ধরেছে। পাকা ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক। কিন্তু বাম্পার ফলনে তাদের মুখে হাসি নেই।

সাঁথিয়ার ধুলাউরি হাটে একাধিক কৃষকের সাথে কথা হয়। এলাকার সম্ভ্রান্ত কৃষক হিসেবে পরিচিত জয়নুল আবেদীন ১৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির সেচ পাঁচ হাজার টাকা, হালচাষ-রোপণে কৃষাণ পাঁচ হাজার টাকা, সার-বীজ-নিড়ানী-কীটনাশক সাড়ে তিন হাজার টাকা, কাটা মাড়াই ছয় হাজার টাকা এবং পরিবহন বাবদ এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২০-২২ হাজার টাকা। তিনি প্রতি বিঘায় গড়ে ধান পেয়েছেন ২০ মন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৩ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা।

কশিনাথপুর হাটে ধান বিক্রি করতে আসা মাসুমদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস ছামাদ প্রামানিক জানান, তিন বিঘা জমিতে মিনিকেট ধান চাষ করে বিঘাপ্রতি ১৮ মন ফলন পেয়েছেন। বাজারে এ ধান এক হাজার ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, দাদন নিয়ে ধান আবাদ করে বাজারে এসে পানির দামে ধান বিক্রি করতে হয়। নিজের জমিতে ধান আবাদ না করে লিজ দিয়ে দেব। স্বপ্ন ছিল এবার ধান বেঁচে মেয়ের বিয়ে দেব। কিন্তু পারছি না। বাবা হিসেবে এ দুঃখ রাখি কোথায় ?