ঢাকা ০৪:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

চলনবিল হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:০০:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ৪৪৯ বার পড়া হয়েছে

চলবিলের তাড়াশের হযরত শাহ শরীফ জিন্দানী (রহ.) এর মাজার

বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

দেশের উত্তর জনপদের এক বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদ চলনবিলের অবয়ব আর ঐতিহ্য যেমন বিরাট তেমনি এর কিংবদন্তির ভান্ডারও বিশাল। চলনবিল জনপদের মানুষের মুখে মুখে কত যে উপকথা ছড়িয়ে আছে তার হিসাব করা দুরূহ। উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী চলনবিল হতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুরে অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা মরহুম অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের হাতে গড়া চলনবিল জাদুঘর এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। জাদুঘরে আছে সুলতান নাসির উদ্দিনের নিজ হাতে লেখা কুরআন শরীফ। গাছের ছালে বাংলায় লেখা প্রাচীন পুঁথিসহ অসংখ্য সামগ্রী। প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজার। এখানে প্রতি শুক্রবার হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।

এখানে আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার। রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমাম বাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি। হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির। রায়গঞ্জের জয়সাগর মৎস্য খামার। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়ীতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।

চলনবিলের জনপদে অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, মাজার জলা রয়েছে আর সেগুলো ঘিরে রয়েছে নানা ইতিকথা, বিশ্বাস। বিলপাড়ের তারাশ উপজেলার নবগ্রামে নওগাঁ শাহি মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। মামার মসজিদটির পাশেই হজরত শাহ শরিফ জিন্দানির (রহ.) মাজার অবস্থিত।

অনেকেই বলেন, মসজিদটি তিনিই নির্মান করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাগদাদ থেকে এ দেশে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। রাজা ভানসিংহের সময় তার আগমন হয় বলে জানা যায়।

রাজা ভানসিংহের পরিষদবর্গ ও তার ঠাকুরেরা দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় তিনি তার খিড়কি পুকুরে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দেন বলে কথিত আছে। এখনো ভানসিংহের খিড়কি পুকুর রয়েছে। মামার মসজিদের পাশে ভাগ্নের মসজিদ নিয়ে নানা উপকথা শোনা যায়। কোন এক ভাগ্নে মামার সাথে পাল্লা দিয়ে এক রাতে নাকি মসজিদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাতের মধ্যে ছাদ দেয়া সম্ভব হয়নি, তাই সেটি ছাদবিহীন অবস্থায় ছিল। কেউ বলে, সেই ভাগ্নে ওই রাতেই মারা যাওয়ায় মসজিদটির নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকে।

বিলপাড়ের চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজো ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। শোনা যায়, ১২৯২ বাংলা সনে গঙ্গাধর সরকার নামক একজন সরকারি সার্ভেয়ার বুড়াপীরের নিস্কন্টক জমি বাজেযাপ্ত করতে চাওয়ায় তার রক্তবমি শুরু হয়। শেষে বুড়াপীরের দরগায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করেন।

চাটমোহরের সমাজ গ্রামের সমাজ মসজিদ নির্মান নিয়ে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। শেরশাহর ছেলে সলিম মসজিদটি নির্মান করেন বলে শোনা যায়। সলিমের জন্মের আগেই তার মাকে শেরশাহ ভুল বুঝে দিল্লি চলে যান। পরে পুত্র সলিমকে স্বীকৃতি দেন এবং তাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। লোকজন আজো বিশ্বাস করেন, হজরত আশরাফ জিন্দানি (রহ.)-এর দোয়ায় শেরশাহের ভুল ভাঙে।

বিলপাড়ের সিরাজগঞ্জ জেলার নিমগাছিতে ফকির দলের আস্তানা ছিল। শোনা যায়, বিদ্রোহী ফকিরদল মুক্তাগাছার মহারাজার পূর্বপুরুষ চন্দ্রশেখর আচার্যকে ময়মনসিংহ থেকে বন্দি করে নিমগাছিতে আটক রেখেছিল। নিমগাছির হাটখোলার পশ্চিমে ভোলা দেওয়ান নামে এক কামেলের মাজার রয়েছে। মাজারের পাশে একটি মসজিদ আছে। মাজারের ওপরে একটি বটগাছে সারা বছর মৌচাক থাকতো বলে হিন্দুরা কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে মাজারে তেল-সিঁদুর দিত।

চলনবিলের কোহিত ডাকাতের কথা মানুষ এখনো বলে। কার সাধ্যি কোহিতকে আটকে রাখে। একবার নাকি পুলিশ ধরেছিল তাকে। দড়ি দিয়ে নয়, ডান্ডা বেড়ি দিয়ে বেঁধেছিল কোহিতকে। নৌকায় করে নেয়ার সময় কোহিত শুধু একটি ডুব দিতে চেয়েছিল। ডুব দেয়ার পর সে অদৃশ্য হয়ে যায়। পুলিশের হাতে পড়ে থাকল শুধু শিকল আর ডান্ড।
বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা শুনে কে না মোহিত হয়। লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর মনসা দেবীকে মানত না, তাই নিয়ে কত কান্ড। সেই চাঁদ সওদাগরের সময় চাঁদের বাজার লাগত চলনবিল পাড়ে। আজকের বস্তুল হাইস্কুলের ঠিক পাশের ভিটায়। বিনসাড়া গ্রামে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই আছে বহুলার কুয়া (কুপ)। বেহুলা চাঁদের বাজারে যে নৌপথ দিয়ে যাতায়াত করতো সেটি বেহুলার খাড়ি নামে পরিচিত। বেহুলার খাড়ি নামক এই জোলা এখনো রয়েছে। খাড়ির পাশে নৌকাসদৃশ ডিবি রয়েছে। গ্রামের লোক এখনো বিশ্বাস করে, ডিবির নিচে বেহুরার নৌকা রয়েছে।

নিমগাছি হাটের পশ্চিমে জয়সাগর নামে এক বিশাল দীঘি রয়েছে। এই দীঘি নিয়ে নানা উপকথা প্রচলিত। রাজা অচ্যুত সেন এক যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ের স্মৃতিস্বরুপ নাকি জয়সাগর খনন করেছিলেন। দীঘি ১২ বছর ধরে খনন করা পরও নাকি এ দীঘিতে পানি ওঠেনি। এক রাতে রাজাকে এক সাধু স্বপ্নে দেখায় তার ছেলেকে বিয়ে দেয়ার পর বাসর রাতে সে দীঘিতে নেমে একমুঠো মাটি তুললে পানি উঠবে। রাজার ছেলে তা করায় দীঘি পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজকুমারের সলিল সমাধি ঘটে। এরপর রাজবধুও সেখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই রাজবধু নাকি অভিশাপ দিয়ে যায় কেই এর পানি ছুঁবে না। লোকে ভয়ে এর পানি ব্যবহার না করায় জঙ্গলে ভরে যায় দীঘি। দীঘির মাঝে বেল গাছ জন্মে। সেই বেলও ভয়ে কেউ ছুঁতো না। এখন অবশ্য দীঘিটি পরিস্কার করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য কাজী গোলাম মোর্শেদ এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক হায়দার আলী তিশিখালী মাজার ঘিরে চলনবিলে একটি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রতিশ্রুতি আর আলোর মুখ দেখেনি।

চলনবিলপাড়ের নটমন্দির, তারাশ কপিলেম্বর মন্দির, মামা-ভাগ্নের মসজিদ, আনুখাঁর দীঘি, পাগলাপীর, বারুহাসের বাঙ্গালা, তিসিখালীর ঘাসি দেওয়ানের মাজার, চৌগ্রামের বুড়াপীরের মাজার, চাপিলার মসজিদ, পলশুরা পাটপাড়া মসজিদ, গুরুদাসপুর এলাকার নীলকুঠি নিয়ে কত উপকথা ছড়িয়ে আছে তার হিসাব করা দুরূহ। তবে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম এক বিরল জলসম্পদ চলনবিল হয়ে উঠতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

নিউজটি শেয়ার করুন

চলনবিল হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

আপডেট সময় : ১০:০০:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

দেশের উত্তর জনপদের এক বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদ চলনবিলের অবয়ব আর ঐতিহ্য যেমন বিরাট তেমনি এর কিংবদন্তির ভান্ডারও বিশাল। চলনবিল জনপদের মানুষের মুখে মুখে কত যে উপকথা ছড়িয়ে আছে তার হিসাব করা দুরূহ। উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী চলনবিল হতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুরে অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা মরহুম অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের হাতে গড়া চলনবিল জাদুঘর এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। জাদুঘরে আছে সুলতান নাসির উদ্দিনের নিজ হাতে লেখা কুরআন শরীফ। গাছের ছালে বাংলায় লেখা প্রাচীন পুঁথিসহ অসংখ্য সামগ্রী। প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজার। এখানে প্রতি শুক্রবার হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।

এখানে আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার। রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমাম বাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি। হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির। রায়গঞ্জের জয়সাগর মৎস্য খামার। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়ীতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।

চলনবিলের জনপদে অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, মাজার জলা রয়েছে আর সেগুলো ঘিরে রয়েছে নানা ইতিকথা, বিশ্বাস। বিলপাড়ের তারাশ উপজেলার নবগ্রামে নওগাঁ শাহি মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। মামার মসজিদটির পাশেই হজরত শাহ শরিফ জিন্দানির (রহ.) মাজার অবস্থিত।

অনেকেই বলেন, মসজিদটি তিনিই নির্মান করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাগদাদ থেকে এ দেশে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। রাজা ভানসিংহের সময় তার আগমন হয় বলে জানা যায়।

রাজা ভানসিংহের পরিষদবর্গ ও তার ঠাকুরেরা দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় তিনি তার খিড়কি পুকুরে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দেন বলে কথিত আছে। এখনো ভানসিংহের খিড়কি পুকুর রয়েছে। মামার মসজিদের পাশে ভাগ্নের মসজিদ নিয়ে নানা উপকথা শোনা যায়। কোন এক ভাগ্নে মামার সাথে পাল্লা দিয়ে এক রাতে নাকি মসজিদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাতের মধ্যে ছাদ দেয়া সম্ভব হয়নি, তাই সেটি ছাদবিহীন অবস্থায় ছিল। কেউ বলে, সেই ভাগ্নে ওই রাতেই মারা যাওয়ায় মসজিদটির নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকে।

বিলপাড়ের চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজো ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। শোনা যায়, ১২৯২ বাংলা সনে গঙ্গাধর সরকার নামক একজন সরকারি সার্ভেয়ার বুড়াপীরের নিস্কন্টক জমি বাজেযাপ্ত করতে চাওয়ায় তার রক্তবমি শুরু হয়। শেষে বুড়াপীরের দরগায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করেন।

চাটমোহরের সমাজ গ্রামের সমাজ মসজিদ নির্মান নিয়ে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। শেরশাহর ছেলে সলিম মসজিদটি নির্মান করেন বলে শোনা যায়। সলিমের জন্মের আগেই তার মাকে শেরশাহ ভুল বুঝে দিল্লি চলে যান। পরে পুত্র সলিমকে স্বীকৃতি দেন এবং তাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। লোকজন আজো বিশ্বাস করেন, হজরত আশরাফ জিন্দানি (রহ.)-এর দোয়ায় শেরশাহের ভুল ভাঙে।

বিলপাড়ের সিরাজগঞ্জ জেলার নিমগাছিতে ফকির দলের আস্তানা ছিল। শোনা যায়, বিদ্রোহী ফকিরদল মুক্তাগাছার মহারাজার পূর্বপুরুষ চন্দ্রশেখর আচার্যকে ময়মনসিংহ থেকে বন্দি করে নিমগাছিতে আটক রেখেছিল। নিমগাছির হাটখোলার পশ্চিমে ভোলা দেওয়ান নামে এক কামেলের মাজার রয়েছে। মাজারের পাশে একটি মসজিদ আছে। মাজারের ওপরে একটি বটগাছে সারা বছর মৌচাক থাকতো বলে হিন্দুরা কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে মাজারে তেল-সিঁদুর দিত।

চলনবিলের কোহিত ডাকাতের কথা মানুষ এখনো বলে। কার সাধ্যি কোহিতকে আটকে রাখে। একবার নাকি পুলিশ ধরেছিল তাকে। দড়ি দিয়ে নয়, ডান্ডা বেড়ি দিয়ে বেঁধেছিল কোহিতকে। নৌকায় করে নেয়ার সময় কোহিত শুধু একটি ডুব দিতে চেয়েছিল। ডুব দেয়ার পর সে অদৃশ্য হয়ে যায়। পুলিশের হাতে পড়ে থাকল শুধু শিকল আর ডান্ড।
বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা শুনে কে না মোহিত হয়। লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর মনসা দেবীকে মানত না, তাই নিয়ে কত কান্ড। সেই চাঁদ সওদাগরের সময় চাঁদের বাজার লাগত চলনবিল পাড়ে। আজকের বস্তুল হাইস্কুলের ঠিক পাশের ভিটায়। বিনসাড়া গ্রামে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই আছে বহুলার কুয়া (কুপ)। বেহুলা চাঁদের বাজারে যে নৌপথ দিয়ে যাতায়াত করতো সেটি বেহুলার খাড়ি নামে পরিচিত। বেহুলার খাড়ি নামক এই জোলা এখনো রয়েছে। খাড়ির পাশে নৌকাসদৃশ ডিবি রয়েছে। গ্রামের লোক এখনো বিশ্বাস করে, ডিবির নিচে বেহুরার নৌকা রয়েছে।

নিমগাছি হাটের পশ্চিমে জয়সাগর নামে এক বিশাল দীঘি রয়েছে। এই দীঘি নিয়ে নানা উপকথা প্রচলিত। রাজা অচ্যুত সেন এক যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ের স্মৃতিস্বরুপ নাকি জয়সাগর খনন করেছিলেন। দীঘি ১২ বছর ধরে খনন করা পরও নাকি এ দীঘিতে পানি ওঠেনি। এক রাতে রাজাকে এক সাধু স্বপ্নে দেখায় তার ছেলেকে বিয়ে দেয়ার পর বাসর রাতে সে দীঘিতে নেমে একমুঠো মাটি তুললে পানি উঠবে। রাজার ছেলে তা করায় দীঘি পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজকুমারের সলিল সমাধি ঘটে। এরপর রাজবধুও সেখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই রাজবধু নাকি অভিশাপ দিয়ে যায় কেই এর পানি ছুঁবে না। লোকে ভয়ে এর পানি ব্যবহার না করায় জঙ্গলে ভরে যায় দীঘি। দীঘির মাঝে বেল গাছ জন্মে। সেই বেলও ভয়ে কেউ ছুঁতো না। এখন অবশ্য দীঘিটি পরিস্কার করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য কাজী গোলাম মোর্শেদ এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক হায়দার আলী তিশিখালী মাজার ঘিরে চলনবিলে একটি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রতিশ্রুতি আর আলোর মুখ দেখেনি।

চলনবিলপাড়ের নটমন্দির, তারাশ কপিলেম্বর মন্দির, মামা-ভাগ্নের মসজিদ, আনুখাঁর দীঘি, পাগলাপীর, বারুহাসের বাঙ্গালা, তিসিখালীর ঘাসি দেওয়ানের মাজার, চৌগ্রামের বুড়াপীরের মাজার, চাপিলার মসজিদ, পলশুরা পাটপাড়া মসজিদ, গুরুদাসপুর এলাকার নীলকুঠি নিয়ে কত উপকথা ছড়িয়ে আছে তার হিসাব করা দুরূহ। তবে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম এক বিরল জলসম্পদ চলনবিল হয়ে উঠতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।