ঢাকা ০৪:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

অতীত স্মৃতি বহন করে টিকে আছে ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:০২:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই ২০২৩
  • / ৭৬৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

// শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি //

তাড়াশের জমিদার বনওয়ারী লাল রায় নৌভ্রমনের সময় নদীবেষ্টিত ছায়া সুনিবিড় আম্রকাননের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার নাম অনুসারে বনওয়ারী নগর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে জায়গাটির নাম ছিল ফরিদপুর। হজরত শাহ শেখ ফরিদ (র:) নাম অনুসারে ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়। জমিদার বনমালী রায় বাহাদুর নিজের নামে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেই সমাপ্ত করেননি, তাড়াশের জমিদার বাড়ির অনুরুপ আরো একটি বাড়ি তৈরি করেন। চারদিকে দিঘিবেষ্টিত একটি মাত্র প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট ছায়া ঘেরা আমবাগানের মধ্যে মনোরম এ বাড়িটিই ফরিদপুর রাজবাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি নামে পরিচিত।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসন আমল থেকে ভূমধ্যকারীদের জমিদার উপাধি দেওয়া হয়। এর আগে জমিদাররা ভূঁইয়া বা ভূমিয়া বলে পরিচিত ছিলেন। ভূইয়া বা জমিদারের অধিকার বৃহৎ আকারের হলে যথাক্রমে চৌধুরী, রায়চৌধুরী এবং রাজা উপাধি দেওয়া হতো। সে-সময়ের ভূস্বামী পরিবারগণই জমিদার-বংশীয় বলে অভিহিত।

জমিদার বংশের অর্থানুক্যুল্যে নির্মিত উভয়বঙ্গের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউট বর্তমানে (শিল্পকলা কেন্দ্র ) গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলছে। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে (ঢাকা রোডে) বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ বিল্ডিং এখন পর্যন্ত প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের আতঙ্কে এ জমিদার-পরিবার তাঁদের পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক তাড়াশ বিল্ডিং-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাড়াশ রাজবাড়ি অনেক আগে থেকে সরকারি দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এখন পর্যন্ত সমসাময়িককালে নির্মিত অন্যান্য জমিদারবাড়ি থেকে ভাল অবস্থায় আছে।

বর্তমানে বনমালী বায়ের বিশাল বাড়িটি বনওয়ারী নগর ফরিদপুর উপজেলার বিভিন্ন অফিসের কার্যালয়। রাণীর ঘাট খ্যাত আম্রকাননে বনমালীর বাসভবন এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসা। যেখানে বিচার কার্যসম্পাদন হতো সেটি এসিল্যান্ডের অফিস। হাওয়া খানার এক পাশে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, অন্য পাশে অফিসার্স ক্লাব। মন্দিরটি এখন টয়লেটে পরিনত হয়েছে। বাড়ির প্রশেব পথের সামনে পাহারাদারদের রুমটি উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরি। একটু এগিয়ে দ্বি-তল একটি ভবন যেখনে আনসার ভিডিপির অফিসের সাইনবোর্ড পরিলক্ষিত হয়। বাড়িটির চারদিকে পুকুর সদৃশ্য পরিখা বেষ্টিত। প্রবেশপথের ডান পাশের পরিখা লাল পদ্মে পরিপূর্ন। বনওয়ারী নগরের এই বাড়িটি রাজবাড়ি নামে সমাধিক পরিচিত। এটি অকল্পনীয় সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি।

১৯২৪ সালের ৫ মার্চ রায়বাহাদুর ক্ষিতিশ ভূষণ রায় ও বায় বাহাদুর রাধিকা ভূষণ বাবার স্মৃতিকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য ৩৯ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ’বনমালী ইনস্টিউট। এ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক খ্যাতিমান বরণ্য শিল্পীর নাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী স্বনামধন্য সূচিত্রা (রমা) সেন ছোটবেলায় বনমালীতে অভিনয় করেছেন। পল্লীগীতি সম্রাট আবাস উদ্দিন আহমেদ এখানে গান গেয়েছেন। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের এবং বহু উঁচুমানের কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্রিয়া কান্ড উপলক্ষে আগমন করেছেন।

 

অতীত স্মৃতি বহন করে টিকে আছে ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি

 

পাবনার প্রাসাদ্যোপম ইউরোপীয় রেনেসাঁ-রীতির প্রভাবে নির্মিত তাড়াশ রাজবাড়িটির সন্মুখ প্রাসাদ দ্বিতল বিশিষ্ট এবং চারটি সুডৌল বৃত্তাকার স্তÍম্ভসহযোগে প্রাসাদের দ্বিতলের কক্ষটি নির্মিত। প্রাসাদের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে প্রবেশ-ফটকটি দু পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধ-বৃত্তাকার খিলান। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথটি সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। ভবনটি আয়তাকৃতির এবং এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩০.৪০ মি;(১০০ ফুট) প্রস্থ ১৮.২৮মি; (৬০ ফুট) । চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভের ওপরে আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি-বারান্দা নির্মিত হয়েছে তাড়াশ ভবনে। ভবনটির দুই পাশে বর্ধিত অঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে এবং সর্বত্র অর্ধ-বৃত্তাকৃতির খিলান সুষমভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ ভবনটি ১,৫৯ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।

জানা যায়, বাসুদেব রায় ওরফে নারায়নদেব চৌধুরী তৎকালে ঢাকার নবাব ইসলাম খাঁর অধিনে চাকরি করতেন। বাসুদেব রায়ের দুই পুত্র । বড় জয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরী, ছোট রামনাথ রায় চৌধুরী। বড় ছেলে জয়কৃষ্ণ রায চৌধুরীর সাত ছেলের মধ্যে পঞ্চম পুত্র বলরাম রায় বাংলার সুবেদার আজিমশ্মানে দেওয়ানে কাজ করতেন। তিনি অর্থবিত্তের মালিক হয়ে রাজকার্য পরিত্যাগ পূর্বক পৈত্রিক বিষয়াদি দেখাশোনায় মনোনিবেশ করেন। তার তিন পুত্র রঘুরাম, হরিরাম ও জগন্নাথ রায়। বড় পুত্র রঘুরাম রায়ের দুই পুত্র। রামচন্দ্র রায় ও রামকেশর রায়। রামচন্দ্র রায়ের তিনপুত্র যথাক্রমে রামরুদ্র, রামলোচন ও রামসুন্দর রায়। প্রথম দুজন নিঃসন্তান। রামসুন্দর রায়ের পুত্র কৃষ্ণসুন্দর এবং কৃষ্ণসুন্দর রায়ের পুত্র গৌরসুন্দর রায় নিঃসন্তান হওয়ায় বনওয়ারী লালকে পোষ্যপুত্র গ্রহন করেন।

বনওয়ারী লাল রায়ের দুই স্ত্রী ছিলেন। তাদের কারও সন্তানাদি না থাকায় রঘুনাথ রায়ের ভাই হরিনাথ রায়ের বংশের বনমালী রায়কে বনওয়ারী লাল রায়ের প্রথম স্ত্রী পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহন করেন। ১৮৬২ খিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে বনমালী রায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালে দত্তক পিতা বনওয়ারী লাল রায় মৃত্যুবরণ করলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর এস্টেট ছিল প্রায় ২০০ মৌজা নিয়ে। পিতা-পুত্র দুজনেই ধার্মিক প্রজাহিতৈষী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ বনওয়ারী লাল হাই স্কুল ( বিএল হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।

পাবনা জেলা জজকোর্টের পশ্চিম পাশে ইছামতি নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করেন। বনমালী রায়ও বাবার ন্যায় শিক্ষা বিস্তারে বনওয়ারী নগরে করনেশন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১২ সালে) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি টমসন হল, ইলিয়ট শিল্প বিদ্যালয়, হাসপাতাল, টাউন হল, দূর্ভিক্ষ ভান্ডার, জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। এডওয়ার্ড কলেজের বিজ্ঞানাগার নির্মাণের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৯৪ সালে ইংরেজ সরকার তাকে ”রায় বাহাদুর” উপাধীতে ভূষিত করেন। তিনি গৌরাঙ্গের ভক্ত ছিলেন। শেষ জীবন তিনি নবদ্বীপ ধামে কাটিয়েছেন। ১৯১৪ সালে বনমালী রায় বাহাদুর রায় মৃত্যু বরণ করেন। বৃহত্তর পাবনার জমিদারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ।

নিউজটি শেয়ার করুন

অতীত স্মৃতি বহন করে টিকে আছে ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি

আপডেট সময় : ১০:০২:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই ২০২৩

// শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি //

তাড়াশের জমিদার বনওয়ারী লাল রায় নৌভ্রমনের সময় নদীবেষ্টিত ছায়া সুনিবিড় আম্রকাননের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার নাম অনুসারে বনওয়ারী নগর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে জায়গাটির নাম ছিল ফরিদপুর। হজরত শাহ শেখ ফরিদ (র:) নাম অনুসারে ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়। জমিদার বনমালী রায় বাহাদুর নিজের নামে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেই সমাপ্ত করেননি, তাড়াশের জমিদার বাড়ির অনুরুপ আরো একটি বাড়ি তৈরি করেন। চারদিকে দিঘিবেষ্টিত একটি মাত্র প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট ছায়া ঘেরা আমবাগানের মধ্যে মনোরম এ বাড়িটিই ফরিদপুর রাজবাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি নামে পরিচিত।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসন আমল থেকে ভূমধ্যকারীদের জমিদার উপাধি দেওয়া হয়। এর আগে জমিদাররা ভূঁইয়া বা ভূমিয়া বলে পরিচিত ছিলেন। ভূইয়া বা জমিদারের অধিকার বৃহৎ আকারের হলে যথাক্রমে চৌধুরী, রায়চৌধুরী এবং রাজা উপাধি দেওয়া হতো। সে-সময়ের ভূস্বামী পরিবারগণই জমিদার-বংশীয় বলে অভিহিত।

জমিদার বংশের অর্থানুক্যুল্যে নির্মিত উভয়বঙ্গের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউট বর্তমানে (শিল্পকলা কেন্দ্র ) গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলছে। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে (ঢাকা রোডে) বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ বিল্ডিং এখন পর্যন্ত প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের আতঙ্কে এ জমিদার-পরিবার তাঁদের পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক তাড়াশ বিল্ডিং-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাড়াশ রাজবাড়ি অনেক আগে থেকে সরকারি দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এখন পর্যন্ত সমসাময়িককালে নির্মিত অন্যান্য জমিদারবাড়ি থেকে ভাল অবস্থায় আছে।

বর্তমানে বনমালী বায়ের বিশাল বাড়িটি বনওয়ারী নগর ফরিদপুর উপজেলার বিভিন্ন অফিসের কার্যালয়। রাণীর ঘাট খ্যাত আম্রকাননে বনমালীর বাসভবন এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসা। যেখানে বিচার কার্যসম্পাদন হতো সেটি এসিল্যান্ডের অফিস। হাওয়া খানার এক পাশে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, অন্য পাশে অফিসার্স ক্লাব। মন্দিরটি এখন টয়লেটে পরিনত হয়েছে। বাড়ির প্রশেব পথের সামনে পাহারাদারদের রুমটি উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরি। একটু এগিয়ে দ্বি-তল একটি ভবন যেখনে আনসার ভিডিপির অফিসের সাইনবোর্ড পরিলক্ষিত হয়। বাড়িটির চারদিকে পুকুর সদৃশ্য পরিখা বেষ্টিত। প্রবেশপথের ডান পাশের পরিখা লাল পদ্মে পরিপূর্ন। বনওয়ারী নগরের এই বাড়িটি রাজবাড়ি নামে সমাধিক পরিচিত। এটি অকল্পনীয় সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি।

১৯২৪ সালের ৫ মার্চ রায়বাহাদুর ক্ষিতিশ ভূষণ রায় ও বায় বাহাদুর রাধিকা ভূষণ বাবার স্মৃতিকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য ৩৯ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ’বনমালী ইনস্টিউট। এ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক খ্যাতিমান বরণ্য শিল্পীর নাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী স্বনামধন্য সূচিত্রা (রমা) সেন ছোটবেলায় বনমালীতে অভিনয় করেছেন। পল্লীগীতি সম্রাট আবাস উদ্দিন আহমেদ এখানে গান গেয়েছেন। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের এবং বহু উঁচুমানের কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্রিয়া কান্ড উপলক্ষে আগমন করেছেন।

 

অতীত স্মৃতি বহন করে টিকে আছে ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি

 

পাবনার প্রাসাদ্যোপম ইউরোপীয় রেনেসাঁ-রীতির প্রভাবে নির্মিত তাড়াশ রাজবাড়িটির সন্মুখ প্রাসাদ দ্বিতল বিশিষ্ট এবং চারটি সুডৌল বৃত্তাকার স্তÍম্ভসহযোগে প্রাসাদের দ্বিতলের কক্ষটি নির্মিত। প্রাসাদের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে প্রবেশ-ফটকটি দু পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধ-বৃত্তাকার খিলান। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথটি সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। ভবনটি আয়তাকৃতির এবং এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩০.৪০ মি;(১০০ ফুট) প্রস্থ ১৮.২৮মি; (৬০ ফুট) । চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভের ওপরে আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি-বারান্দা নির্মিত হয়েছে তাড়াশ ভবনে। ভবনটির দুই পাশে বর্ধিত অঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে এবং সর্বত্র অর্ধ-বৃত্তাকৃতির খিলান সুষমভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ ভবনটি ১,৫৯ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।

জানা যায়, বাসুদেব রায় ওরফে নারায়নদেব চৌধুরী তৎকালে ঢাকার নবাব ইসলাম খাঁর অধিনে চাকরি করতেন। বাসুদেব রায়ের দুই পুত্র । বড় জয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরী, ছোট রামনাথ রায় চৌধুরী। বড় ছেলে জয়কৃষ্ণ রায চৌধুরীর সাত ছেলের মধ্যে পঞ্চম পুত্র বলরাম রায় বাংলার সুবেদার আজিমশ্মানে দেওয়ানে কাজ করতেন। তিনি অর্থবিত্তের মালিক হয়ে রাজকার্য পরিত্যাগ পূর্বক পৈত্রিক বিষয়াদি দেখাশোনায় মনোনিবেশ করেন। তার তিন পুত্র রঘুরাম, হরিরাম ও জগন্নাথ রায়। বড় পুত্র রঘুরাম রায়ের দুই পুত্র। রামচন্দ্র রায় ও রামকেশর রায়। রামচন্দ্র রায়ের তিনপুত্র যথাক্রমে রামরুদ্র, রামলোচন ও রামসুন্দর রায়। প্রথম দুজন নিঃসন্তান। রামসুন্দর রায়ের পুত্র কৃষ্ণসুন্দর এবং কৃষ্ণসুন্দর রায়ের পুত্র গৌরসুন্দর রায় নিঃসন্তান হওয়ায় বনওয়ারী লালকে পোষ্যপুত্র গ্রহন করেন।

বনওয়ারী লাল রায়ের দুই স্ত্রী ছিলেন। তাদের কারও সন্তানাদি না থাকায় রঘুনাথ রায়ের ভাই হরিনাথ রায়ের বংশের বনমালী রায়কে বনওয়ারী লাল রায়ের প্রথম স্ত্রী পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহন করেন। ১৮৬২ খিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে বনমালী রায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালে দত্তক পিতা বনওয়ারী লাল রায় মৃত্যুবরণ করলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর এস্টেট ছিল প্রায় ২০০ মৌজা নিয়ে। পিতা-পুত্র দুজনেই ধার্মিক প্রজাহিতৈষী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ বনওয়ারী লাল হাই স্কুল ( বিএল হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।

পাবনা জেলা জজকোর্টের পশ্চিম পাশে ইছামতি নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করেন। বনমালী রায়ও বাবার ন্যায় শিক্ষা বিস্তারে বনওয়ারী নগরে করনেশন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১২ সালে) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি টমসন হল, ইলিয়ট শিল্প বিদ্যালয়, হাসপাতাল, টাউন হল, দূর্ভিক্ষ ভান্ডার, জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। এডওয়ার্ড কলেজের বিজ্ঞানাগার নির্মাণের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৯৪ সালে ইংরেজ সরকার তাকে ”রায় বাহাদুর” উপাধীতে ভূষিত করেন। তিনি গৌরাঙ্গের ভক্ত ছিলেন। শেষ জীবন তিনি নবদ্বীপ ধামে কাটিয়েছেন। ১৯১৪ সালে বনমালী রায় বাহাদুর রায় মৃত্যু বরণ করেন। বৃহত্তর পাবনার জমিদারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ।