ঢাকা ০৩:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

সহস্রাব্দী প্রাচীনতম মসজিদ ও সুলতানী আমলের অনুপম নিদর্শন দেখতে ভক্তদের আগমন

হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৩:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ১৫৮৬ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
// শামছুর রহমান শিশির ‍ও মামুন রানা //
বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর এলাকার দরগাহপাড়া গ্রামে করতোয়া নদীর তীরে সমাধিস্থ জগৎ বরেণ্য অলী ইয়ামেন শাহাজাদা হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.)’র গায়েবী মসজিদ খ্যাত মখদুমিয়া জামে মসজিদ ও তাঁর মাজারে ব্যাপক ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটছে। ভক্তদের মধ্যে অনেকেই মহান অলীর দরবার ও হাজারো বছরের পুরাতন সুলতানী আমলে উৎকৃষ্ট নিদর্শন ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ’ একনজর নিজ চোখে দেখার উদ্দেশ্যে, অনেকে আবার তবারক রান্না করতে ও মহান ওই অলীর কবর জিয়ারত করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর মাজারে আসছেন। গতকাল শুক্রবারও মহান ওই অলীর মাজারে ভক্তবৃন্দের ব্যাপক সমাগম দেখা যায়।
 হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়
কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, ইয়ামেনের শাসনকর্তা মোয়াজ-ইব্নে জাবাল এর বংশধর হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ:) সুদূর ইয়ামেন থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা জন্য ১২৯২ থেকে ১২৯৬ সালের কোন এক সময় ইয়ামেন ত্যাগ করেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ভাগ্নে খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.), খাজা নূর (রহ.), খাজা আনওয়ার (রহ.), তাঁর বোন, বারোজন প্রসিদ্ধ দরবেশ এবং কিছু সংখ্যক সহচরবৃন্দ্র। তাঁরা সবাই ৭ টি জাহাজ মতান্তরে ৪০ টি জাহাজ যোগে নদীপথে রওয়ানা হয়ে বোখারা শরীফে পৌছে তথাকার সাধক সুফী জালালউদ্দিন বোখারী (রহ:)  এর সাথে সাক্ষাত করে কিছু সময় অতিবাহিত করে বাংলার এই অঞ্চলে আগমন করেন। হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ:)  তাঁকে একজোড়া কবুতর উপহার দেন যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রমের পর অভিযাত্রী দলটির জাহাজ একস্থানে এসে ঠেকে যায়। যার বর্তমান নাম পোতাজিয়া । পোত আউজিয়া গিয়েছিল জন্যই স্থানটির নামকরন করা হয়েছে পোতাজিয়া। স্থানটি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.)’র মাজার ও মসজিদের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমগ্র স্থানটি তখন ছিল পানির নীচে। কোনদিকেই স্থলভাগের চিহ্ন ছিলনা। বোখারী কবুতরগুলি সকালে জাহাজ ত্যাগ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। কয়েকদিন পরে জাহাজের লোকজন কবুতরের পায়ে পলিমাটি ও বালির দেখতে পেয়ে অদূরে কোথাও চর জেগেছে ধারনায় কয়েকজন একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে কবুতরকে অনুসরণ করে একটি চরে পৌঁছান। পানি ক্রমশঃ সরে যেতে থাকায় চরটি প্রশস্ত হতে থাকে এবং সেই চর এলাকাটিই পরবর্তীতে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর নামানুসারে শাহজাদপুর নাম ধারন করে। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুরে বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী তাঁর আগমনে ভীত সন্ত্রস্থ ও শংকিত হয়ে সৈন্যবাহিনী প্রেরন করেন। রাজা বিক্রম কেশরী পরপর বেশ কয়েকবার সৈনবাহিনী প্রেরন করে প্রতি বারই পরাস্ত হন। শেষ ধর্ম যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের একজন গুপ্তচর হিসাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর অত্যন্ত নিকটে স্থানলাভ করেন। একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) আছরের নামাজ আদায়কালে সিজদারত অবস্থায় তাঁর মস্তক মোবারক ওই গুপ্তচর দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে সুরে বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোট মতান্তরে মহলকোটে রাজার নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর মস্তক মোবারক রাজার সামনে উপস্থিত করার পর দেখা যায় যে তাঁর ওষ্ঠাধর হতে অলৌকিকভাবে ’সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ উচ্চারিত হচ্ছে। এ ঘটনা দেখার পর রাজা ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে তাঁর মস্তক মোবারক সমাহিত করার নির্দেশ দেন। রাজার প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তক মোবারক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ নএম পরিচিত। অন্যদিকে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর মস্তকবিহীন দেহ মোবারক শাহজাদপুরে মখদুমিয়া জামে মসজিদের দশরশি দক্ষিণে তাঁর জীবিত ভাগ্নে শাহ নূর (রহ.) এবং অন্যান্য অনুচরগন দাফন করা হয় পাথরের কফিনের মধ্যে। পরে কফিনটি সরিয়ে বর্তমান স্থানে সমাহিত করা হয়েছে। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) ও তাঁর ভাগ্নেদের মাজার ছাড়াও শাহজাদপুরে আরও ১৮ টি মাজার রয়েছে। সেগুলোর ১২ টি মাজার দরবেশগনের নাম জগৎ বরেণ্য মহান অলী সূফী সাধক হযতর মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর এবং হযরত জালাল উদ্দিন রুমীর মহান ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরেজি (রহ.) , হযরত শাহ ইউসুফ (রহ.), হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ.) , হযরত শাহ আজমত (রহ.), হযরত হাসিলা পীড় (রহ.), হযরত শাহ বাদলা (রহ.) , হযরত শাহ আহমেদ (রহ.) , হযরত শাহ মাহমুদ (রহ.) এবং অপর চারজনের নাম জানা যায়নি। এ মাজারগুলি ছাড়াও আরও ৬ জনের মাজার এখানে দেখা যায় যারা সেখানে বেশ কিছুকাল বসবাসের পর মারা যান। তাঁরা হচ্ছেন, শাহ মাস্তন (র.), শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ.) (এই মাজারটি করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত), শাহ মাফাত (রহ.), হাদী সাহেব ও অপর দুই জনের নাম জানা যায়নি। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) -এর এক ভাগ্নে শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.) এর মাজার তাঁর মাজারের ডান পাশে, অপর ভাগ্নে এবং দরবেশগণের মাজার নিকটেই অবস্থিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.), শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.)  এবং দরবেশ শাহ ইউসুফ (রহ.) এর মাজার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যার উপরে অষ্টভূজাকৃতির টিনের চালা ছিলো যেখানে বর্তমানে পাঁকা সৌধ নির্মান করা হয়েছে। হযরত শাহ্ শামসুদ্দিন তাবরেজি (রহ.)  ছিলেন মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.) -এর মহান ওস্তাদজী। হযরত শাহ শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ.)  এর ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি দেয়াল বেষ্টিত মাজার মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর ওপরেও সৌধ নির্মান করা হয়েছে। হযরত শাহ ইউসুফ (রহ.) একজন সাহাবা ছিলেন। হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ.) এর আস্তানায় বাতি দেয়া এবং তত্বাবধানের জন্য একজন বেতনভূক্ত খাদেম রয়েছেন। উপরোক্ত মাজারসমূহ ছাড়া এখানে আরও ২টি করবস্থান আছে, একটি মসজিদ সংলগ্ন এবং অপরটি মসজিদ থেকে দশরশি দক্ষিণে যেখানে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কে প্রথম দাফন করা হয়েছিল। এই কবরস্থান দুটি ’গঞ্জে শহীদ’ নামে খ্যাত ছিল। এ সকল কবরের কোন ফলক নেই। মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি জলাশয় ছিল যা ‘সতী বিবির খাল’ নামে পরিচিত। এই জলাশয়েই হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর বোন শত্রুর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাবার তাগিদে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজারো ভক্তবৃন্দ মনসা পূরনের জন্য এখানে চিনি, বাতাসা নিক্ষেপ করে থাকে । করতোয়া নদী গ্রাস করায় জলাশয়টির এখন চিহ্ন নেই। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর নির্দেশে মখদুমিয়া জামে মসজিদটি নির্মান করা হয়। ওই মসজিদের ভিতরের মাপ দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি ও উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি এবং বাইরের মাপ দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা প্রতিটির উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি। মসজিদটির মোট গুম্বুজের সংখ্যা ১৫ টি। মেঝে হতে গুম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ইট এবং চুনা দ্বারা মসজিদটি নির্মান করা হয়। মসজিদটি ধারন করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪ টি স্তম্ভ। মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়াল সংলগ্ন রয়েছে ৭ টি ধাপসহ ছাদ বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের সামনে একটি পাঁকা চত্বর যা মসজিদের মেজের চাইতে এক ইঞ্চি নীচে। মসজিদের বাইরে এবং ভিতরে কারুকার্য আছে যা প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার।
 হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়
এই মখদুমিয়া জামে মসজিদটি এলাকায় গায়েবী মসজিদ নামে পরিচিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নির্মান কাজ সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। শোনা যায়, মসজিদের বৃহৎ পাথরের স্তম্ভগুলি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.)’র নির্দেশে আরবদেশ থেকে পানির উপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়।এইরুপ জনশ্রুতি অবাস্তব মনে হলেও মসজিদটি নির্মানে অলৌকিকতার বেশ ছাপ পাওয়া যায়। যে ২৪ টি স্তম্ভের ওপর মসজিদটি দন্ডায়মান ওই স্তম্ভগুলির এক একটি পাথরের ওজন আনুমান ৫০ হতে ১০০ মণ। স্তম্ভগুলোর অধিকাংশই গোলাকার নকশা বিশিষ্ট।এই পাথরের স্তম্ভগুলি কোথা হতে কিভাবে আনা হলো?  কেমন করে পাহাড় হতে এত বড় পাথরের স্তম্ভ বের করা হলো তা ধারনাতীত। আমাদের দেশে এরূপ কোন পাথরের পাহাড় নেই যেখান থেকে স্তম্ভগুলি জোগাড় করা যায়। দ্বিতীয়ত স্তম্ভগুলির মাপ মতো তৈরি, যথাস্থানে স্থাপন এবং একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর মতো যন্ত্রপাতি এবং উন্নত প্রযুক্তির তখন অভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি মসজিদকে অক্ষত রাখার মালমশলা যোগাড় করাও তখন অত্যন্ত দূরহ ছিল। রাজা বাদশাগণের পক্ষে এটা সম্ভব হলেও কতিপয় ধর্ম প্রচারক যাদের ধর্ম প্রচার ছাড়া কোন কারিগরী যোগ্যতা, দক্ষতা বা অর্থের প্রাচুর্যতা ছিল না। ওই সময়ে তাঁদের  দ্বারা এইরূপ একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন মোটেও সম্ভব নয়। এতএব হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কর্তৃক একটি উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ শহস্রাব্দী  প্রাচীন এই মসজিদ নির্মানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে বিশেষ গায়েবী সাহায্য ছিল তা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।  আল্লাহপাকের নৈকট্যলাভ, মানত পূরণ, দোয়া খায়ের ও সহস্রাব্দী প্রাচীনকালের ইসলামী ঐতিয্যের অনুপম নিদর্শনগুলি বাস্তবে স্বচক্ষে একবার দেখার জন্য ওলী আউলিয়া সূফী সাধক দরবেশের শহর শাহজাদপুরের হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ.) এর মাজার ও গায়েবী মসজিদে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে উঠেছে মাজার প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

সহস্রাব্দী প্রাচীনতম মসজিদ ও সুলতানী আমলের অনুপম নিদর্শন দেখতে ভক্তদের আগমন

হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়

আপডেট সময় : ০৩:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
// শামছুর রহমান শিশির ‍ও মামুন রানা //
বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর এলাকার দরগাহপাড়া গ্রামে করতোয়া নদীর তীরে সমাধিস্থ জগৎ বরেণ্য অলী ইয়ামেন শাহাজাদা হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.)’র গায়েবী মসজিদ খ্যাত মখদুমিয়া জামে মসজিদ ও তাঁর মাজারে ব্যাপক ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটছে। ভক্তদের মধ্যে অনেকেই মহান অলীর দরবার ও হাজারো বছরের পুরাতন সুলতানী আমলে উৎকৃষ্ট নিদর্শন ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ’ একনজর নিজ চোখে দেখার উদ্দেশ্যে, অনেকে আবার তবারক রান্না করতে ও মহান ওই অলীর কবর জিয়ারত করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর মাজারে আসছেন। গতকাল শুক্রবারও মহান ওই অলীর মাজারে ভক্তবৃন্দের ব্যাপক সমাগম দেখা যায়।
 হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়
কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, ইয়ামেনের শাসনকর্তা মোয়াজ-ইব্নে জাবাল এর বংশধর হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ:) সুদূর ইয়ামেন থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা জন্য ১২৯২ থেকে ১২৯৬ সালের কোন এক সময় ইয়ামেন ত্যাগ করেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ভাগ্নে খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.), খাজা নূর (রহ.), খাজা আনওয়ার (রহ.), তাঁর বোন, বারোজন প্রসিদ্ধ দরবেশ এবং কিছু সংখ্যক সহচরবৃন্দ্র। তাঁরা সবাই ৭ টি জাহাজ মতান্তরে ৪০ টি জাহাজ যোগে নদীপথে রওয়ানা হয়ে বোখারা শরীফে পৌছে তথাকার সাধক সুফী জালালউদ্দিন বোখারী (রহ:)  এর সাথে সাক্ষাত করে কিছু সময় অতিবাহিত করে বাংলার এই অঞ্চলে আগমন করেন। হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ:)  তাঁকে একজোড়া কবুতর উপহার দেন যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রমের পর অভিযাত্রী দলটির জাহাজ একস্থানে এসে ঠেকে যায়। যার বর্তমান নাম পোতাজিয়া । পোত আউজিয়া গিয়েছিল জন্যই স্থানটির নামকরন করা হয়েছে পোতাজিয়া। স্থানটি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.)’র মাজার ও মসজিদের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমগ্র স্থানটি তখন ছিল পানির নীচে। কোনদিকেই স্থলভাগের চিহ্ন ছিলনা। বোখারী কবুতরগুলি সকালে জাহাজ ত্যাগ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। কয়েকদিন পরে জাহাজের লোকজন কবুতরের পায়ে পলিমাটি ও বালির দেখতে পেয়ে অদূরে কোথাও চর জেগেছে ধারনায় কয়েকজন একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে কবুতরকে অনুসরণ করে একটি চরে পৌঁছান। পানি ক্রমশঃ সরে যেতে থাকায় চরটি প্রশস্ত হতে থাকে এবং সেই চর এলাকাটিই পরবর্তীতে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর নামানুসারে শাহজাদপুর নাম ধারন করে। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুরে বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী তাঁর আগমনে ভীত সন্ত্রস্থ ও শংকিত হয়ে সৈন্যবাহিনী প্রেরন করেন। রাজা বিক্রম কেশরী পরপর বেশ কয়েকবার সৈনবাহিনী প্রেরন করে প্রতি বারই পরাস্ত হন। শেষ ধর্ম যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের একজন গুপ্তচর হিসাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর অত্যন্ত নিকটে স্থানলাভ করেন। একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) আছরের নামাজ আদায়কালে সিজদারত অবস্থায় তাঁর মস্তক মোবারক ওই গুপ্তচর দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে সুরে বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোট মতান্তরে মহলকোটে রাজার নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর মস্তক মোবারক রাজার সামনে উপস্থিত করার পর দেখা যায় যে তাঁর ওষ্ঠাধর হতে অলৌকিকভাবে ’সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ উচ্চারিত হচ্ছে। এ ঘটনা দেখার পর রাজা ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে তাঁর মস্তক মোবারক সমাহিত করার নির্দেশ দেন। রাজার প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তক মোবারক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ নএম পরিচিত। অন্যদিকে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর মস্তকবিহীন দেহ মোবারক শাহজাদপুরে মখদুমিয়া জামে মসজিদের দশরশি দক্ষিণে তাঁর জীবিত ভাগ্নে শাহ নূর (রহ.) এবং অন্যান্য অনুচরগন দাফন করা হয় পাথরের কফিনের মধ্যে। পরে কফিনটি সরিয়ে বর্তমান স্থানে সমাহিত করা হয়েছে। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) ও তাঁর ভাগ্নেদের মাজার ছাড়াও শাহজাদপুরে আরও ১৮ টি মাজার রয়েছে। সেগুলোর ১২ টি মাজার দরবেশগনের নাম জগৎ বরেণ্য মহান অলী সূফী সাধক হযতর মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর এবং হযরত জালাল উদ্দিন রুমীর মহান ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরেজি (রহ.) , হযরত শাহ ইউসুফ (রহ.), হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ.) , হযরত শাহ আজমত (রহ.), হযরত হাসিলা পীড় (রহ.), হযরত শাহ বাদলা (রহ.) , হযরত শাহ আহমেদ (রহ.) , হযরত শাহ মাহমুদ (রহ.) এবং অপর চারজনের নাম জানা যায়নি। এ মাজারগুলি ছাড়াও আরও ৬ জনের মাজার এখানে দেখা যায় যারা সেখানে বেশ কিছুকাল বসবাসের পর মারা যান। তাঁরা হচ্ছেন, শাহ মাস্তন (র.), শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ.) (এই মাজারটি করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত), শাহ মাফাত (রহ.), হাদী সাহেব ও অপর দুই জনের নাম জানা যায়নি। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) -এর এক ভাগ্নে শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.) এর মাজার তাঁর মাজারের ডান পাশে, অপর ভাগ্নে এবং দরবেশগণের মাজার নিকটেই অবস্থিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.), শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ.)  এবং দরবেশ শাহ ইউসুফ (রহ.) এর মাজার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যার উপরে অষ্টভূজাকৃতির টিনের চালা ছিলো যেখানে বর্তমানে পাঁকা সৌধ নির্মান করা হয়েছে। হযরত শাহ্ শামসুদ্দিন তাবরেজি (রহ.)  ছিলেন মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.) -এর মহান ওস্তাদজী। হযরত শাহ শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ.)  এর ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি দেয়াল বেষ্টিত মাজার মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর ওপরেও সৌধ নির্মান করা হয়েছে। হযরত শাহ ইউসুফ (রহ.) একজন সাহাবা ছিলেন। হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ.) এর আস্তানায় বাতি দেয়া এবং তত্বাবধানের জন্য একজন বেতনভূক্ত খাদেম রয়েছেন। উপরোক্ত মাজারসমূহ ছাড়া এখানে আরও ২টি করবস্থান আছে, একটি মসজিদ সংলগ্ন এবং অপরটি মসজিদ থেকে দশরশি দক্ষিণে যেখানে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কে প্রথম দাফন করা হয়েছিল। এই কবরস্থান দুটি ’গঞ্জে শহীদ’ নামে খ্যাত ছিল। এ সকল কবরের কোন ফলক নেই। মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি জলাশয় ছিল যা ‘সতী বিবির খাল’ নামে পরিচিত। এই জলাশয়েই হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর বোন শত্রুর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাবার তাগিদে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজারো ভক্তবৃন্দ মনসা পূরনের জন্য এখানে চিনি, বাতাসা নিক্ষেপ করে থাকে । করতোয়া নদী গ্রাস করায় জলাশয়টির এখন চিহ্ন নেই। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর নির্দেশে মখদুমিয়া জামে মসজিদটি নির্মান করা হয়। ওই মসজিদের ভিতরের মাপ দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি ও উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি এবং বাইরের মাপ দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা প্রতিটির উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি। মসজিদটির মোট গুম্বুজের সংখ্যা ১৫ টি। মেঝে হতে গুম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ইট এবং চুনা দ্বারা মসজিদটি নির্মান করা হয়। মসজিদটি ধারন করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪ টি স্তম্ভ। মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়াল সংলগ্ন রয়েছে ৭ টি ধাপসহ ছাদ বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের সামনে একটি পাঁকা চত্বর যা মসজিদের মেজের চাইতে এক ইঞ্চি নীচে। মসজিদের বাইরে এবং ভিতরে কারুকার্য আছে যা প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার।
 হযরত মখদুম শাহ্দৌলা (রহ.)’র মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়
এই মখদুমিয়া জামে মসজিদটি এলাকায় গায়েবী মসজিদ নামে পরিচিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নির্মান কাজ সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। শোনা যায়, মসজিদের বৃহৎ পাথরের স্তম্ভগুলি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.)’র নির্দেশে আরবদেশ থেকে পানির উপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়।এইরুপ জনশ্রুতি অবাস্তব মনে হলেও মসজিদটি নির্মানে অলৌকিকতার বেশ ছাপ পাওয়া যায়। যে ২৪ টি স্তম্ভের ওপর মসজিদটি দন্ডায়মান ওই স্তম্ভগুলির এক একটি পাথরের ওজন আনুমান ৫০ হতে ১০০ মণ। স্তম্ভগুলোর অধিকাংশই গোলাকার নকশা বিশিষ্ট।এই পাথরের স্তম্ভগুলি কোথা হতে কিভাবে আনা হলো?  কেমন করে পাহাড় হতে এত বড় পাথরের স্তম্ভ বের করা হলো তা ধারনাতীত। আমাদের দেশে এরূপ কোন পাথরের পাহাড় নেই যেখান থেকে স্তম্ভগুলি জোগাড় করা যায়। দ্বিতীয়ত স্তম্ভগুলির মাপ মতো তৈরি, যথাস্থানে স্থাপন এবং একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর মতো যন্ত্রপাতি এবং উন্নত প্রযুক্তির তখন অভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি মসজিদকে অক্ষত রাখার মালমশলা যোগাড় করাও তখন অত্যন্ত দূরহ ছিল। রাজা বাদশাগণের পক্ষে এটা সম্ভব হলেও কতিপয় ধর্ম প্রচারক যাদের ধর্ম প্রচার ছাড়া কোন কারিগরী যোগ্যতা, দক্ষতা বা অর্থের প্রাচুর্যতা ছিল না। ওই সময়ে তাঁদের  দ্বারা এইরূপ একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন মোটেও সম্ভব নয়। এতএব হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) কর্তৃক একটি উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ শহস্রাব্দী  প্রাচীন এই মসজিদ নির্মানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে বিশেষ গায়েবী সাহায্য ছিল তা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।  আল্লাহপাকের নৈকট্যলাভ, মানত পূরণ, দোয়া খায়ের ও সহস্রাব্দী প্রাচীনকালের ইসলামী ঐতিয্যের অনুপম নিদর্শনগুলি বাস্তবে স্বচক্ষে একবার দেখার জন্য ওলী আউলিয়া সূফী সাধক দরবেশের শহর শাহজাদপুরের হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ.) এর মাজার ও গায়েবী মসজিদে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে উঠেছে মাজার প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকা।