ঢাকা ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

সংকোচনের পথে চলনবিল: কমে গেছে অতিথি পাখির কলতান

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৩২:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৪৫৮ বার পড়া হয়েছে

চলববিলের অতিথি পাখি-ছবি সংগৃহিত

বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শামছুর রহমান শিশির:

এক সময় নাম শুনলেই গাঁ ছমছম করে ওঠা অজানা ভীতি সৃষ্টিকারী অঞ্চল, অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত এবং অভয়ারণ্য ‘চলনবিল’ কালের চক্রে সময়ের পরিধিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ বহুমূখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সংকোচনের পথে! আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বায়ুমন্ডলে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব ও দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ফলে দিগন্ত ছোঁয়া বিস্তৃত জলসীমা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে একদিকে যেমন ছোট আকার ধারণ করছে; অন্যদিকে এক সময়ের অতিথি পাখির অভয়ারণ্য  চলনবিল হারাতে বসেছে তার চিরচেনা ঐতিহ্য। চলনবিলের বুকে প্রমোদতরী ভাসিয়ে কত রাজা বাদশা, পাঠান মোগল নিরুত্তাপ ক্লান্তি ঝেড়েছেন, তার খবর কে রাখে! চলনবিলের বিশালত্ব ও দিগন্তছোঁয়া বিস্তৃর্ণ জলরাশির নৈসর্গিক দৃশ্য এবং বিদেশ থেকে আসা দৃষ্টিনন্দন অতিথি পাখি দেখে বিষ্ময়ে অবিভূত হয়ে কত পর্যটক, কত লেখক, কত কবি যে বিচিত্র কাহিনী লিখেছেন; তার হিসাব কে রাখে! কালাবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তলদেশে পলি জমাসহ বহুবিধ কারণে যেমন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে চলনবিল, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাষকের ব্যাবহার, খাদ্যের অভাব, শৌখিন শিকারীর আগ্রাসনে চলনবিলাঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমনের হার ও উপস্থিতিও কমে গেছে বহুগুণে। তার পরেও এ অঞ্চলে শীত পড়তে শুরু করায় ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। চলনবিলাঞ্চলের তীর এলাকার বিভিন্ন গাছে ও বিলাঞ্চলে ওইসব অতিথি পাখির আনাগোনা ও কলতান পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে অতীতের তুলনায় কম পরিমানে অতিথি পাখির আগমন ঘটলেও বিভিন্ন শৌখিন ও অসাধু শিকারীর ফাঁদে ওইসব পাখির জীবনও বিপন্ন হতে চলেছে।

জানা গেছে, এক সময় রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার তিন-চতুর্থাংশ, নওগাঁ মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, বেড়া থানা, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও তাড়াশ থানা ও বগুড়া জেলার শেরপুর, নন্দীগ্রাম এলাকার বেশ কিছু এলাকা জুড়ে চলনবিলের অস্তিত্ব ছিল বলে ইতিহাস আজও স্বাক্ষ্য বহন করে। আব্দুল হামিদের লেখা চলনবিলের ইতিকথা বইয়ে চলনবিলের উক্ত পরিধি ছাড়াও এক সময়ের পাবনা মহকুমার সিরাজগঞ্জ অংশ পুরোটাই চলনবিলের মধ্যে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ধীরে ধীরে চলনবিলের জমিতে পলি পড়তে থাকায় বিল এলাকা সরে আসতে আসতে বর্তমানে অনেক সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

প্রতি বছরেই হিমালয়, সাইবেরিয়া, ভারত, চীনসহ বর্হিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীতের তীব্রতা ও তুষারাপাত সহ্য করতে না পেরে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে চলনবিলে। শীত মৌসুমে চলনবিলে জলকুটকুট, পচার্ড, নর্দান, পিনটেল, সরালি, গাগেনি, কোম্বডাক, মুরগ্যারি, বামুনিয়া, কাস্তেচারা, সোনাজিরিয়া, হুডহুড, খয়রাসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ও তাদের কলতানে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত থাকতো চলনবিল। কালের চক্রে সময়ের পরিধিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ বহুবিধ কারণে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য চলনবিলের বিস্তৃত জলরাশীর পরিধি সংকোচনের পাশাপাশি শীত মৌসুমে বর্হিঃবিশ্ব থেকে অতিথি পাখির আগমন কমে গেছে। বর্তমানে চলনবিল সংকুচিত হয়ে এতটাই পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছে যে ওই অঞ্চলে অবাধে বিচরণের ক্ষেত্র বিস্তুৃর্ণ জলসীমা ও সার্বিক পরিবেশ রীতিমতো অতিথি পাখির জন্য দিনে দিনে বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর চলনবিল দ্বি-খন্ডিত হয়ে পড়ে। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া থেকে জানা যায়, পদ্মা তীরের লালপুর থানা ছাড়া নাটোর মহকুমার বাকি এলাকাই ছিল বিলময়। তন্মদ্ধে চলনবিল ছিল সব চেয়ে বড় জলাশয় যার আয়তন ছিল প্রায় আটশ’ বর্গমাইল। এসময় চলনবিলের নাম শুনলেই ভয়ে গাঁ ছমছম করে উঠতো। প্রায় একশ’ বছর আগে জনবসতি এলাকা বাদে চলনবিলের জলসীমার আয়তন ছিল প্রায় পাঁচশ’ বর্গমাইলের ওপরে। এসময় চলনবিলে শীত মৌসুমে বর্হিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমানে অতিথি পাখির আগমন ঘটতো বলে অতীত সাক্ষ্য দেয়। পূর্ববঙ্গ রেলওয়ের প্রচার বিভাগ থেকে গত ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমন’ বইয়ে প্রকাশ, চলনবিলের আয়তন ছিল চারশ’ একচল্লিশ বর্গমাইল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের রেভিনিউ সার্ভে নকশায় উত্তর-পশ্চিমে কলম গ্রাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে সিধুলী, দক্ষিণে হরিপুর ও গুনাইগাছা, পূর্বে হান্ডিয়াল ও তাড়াশের মাঝে দেখানো হয়েছিল চলনবিলকে। হান্ডিয়ালের পর নবীন, ছাইকোলা ও বরদানগর নামের এলাকাগুলোতে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। জনবসতির পাশাপাশি বনজঙ্গল অঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য, বন্য পশুপ্রাণির সাথে অবির্ভাব হয় দস্যু তস্করের এবং মোঘল আমলে দুঃসাহসী ডাকাত বেণী রায়ের। ডাকাত বেণী রায়কে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী চলনবিল অঞ্চলে এখনো প্রচলিত রয়েছে। এসময় সলপের জোয়ারীর বিশী ও সান্যাল জমিদার বংশের পূর্ব পুরুষদের ডাকাতির অনেক কাহিনীও এ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। ডাকাতি ঠেকাতে ১৮১৩ সালে রাজশাহীকে ভেঙ্গে মালদহ, ১৮২১ সালে বগুড়া ও ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা গঠন করা হয়।

প্রতি বছর বন্যার পানির সাথে পলিমাটি জমে চলনবিলের জলরাশীর বিস্তৃতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় ১৯০৯ সালে চলনবিল অঞ্চলকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ সময় থেকেই এ অঞ্চলে জলকুটকুট, পচার্ড, নর্দান, পিনটেল, সরালি, গাগেনি, কোম্বডাক, মুরগ্যারি, বামুনিয়া, কাস্তেচারা, সোনাজিরিয়া, হুডহুড, খয়রাসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ও কলতান হ্রাস পেতে থাকে। এ অঞ্চলে গৃহিত পরিকল্পনার আলোকে পাবলিক ওর্য়াকস্ ডিপার্টমেন্ট পৃথক চলনবিল সাব-ডিভিশন গঠন করে। এরপর থেকে চলনবিলে চলছে বহুমূখী উন্নয়ন। শুধু বিদেশ থেকে শীত মৌসুমে আগত অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য ধরে রাখতে আজ অবধি নেয়া হয়নি কোন পরিকল্পনা । মৎস্য সম্পদকে ঘিরে এ অঞ্চলে বহু জেলেরা গড়ে তোলে বসতি। দেশে সর্ববৃহৎ মাছের খনি চলনবিল এখন শষ্য ভান্ডারে পরিণত হওয়ায় শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। ইতিপূর্বে  সরকার গৃহীত বন্যা নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনা পথিমধ্যে ভেস্তে যাওয়ায় এ অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল এখনও ফসলি জমি হিসেবে বিবেচিত হলেও অকাল বন্যাতে সে ফসলও নষ্ট হয়। এক সময়ের অতিথি পাখির অভয়ারণ্য চলনবিলের ভৌগলিক ও অবস্থানগত পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক কাঠামোরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দস্যু তস্কর ও বেণী রায় না থাকলেও নানা দুর্বৃত্তরা সে স্থান দখলে রেখেছে। প্রতি বছর নদ-নদীর ঘোলা পানি চলনবিলে ফেলে যায় পলি। ফলে এখানে প্রচুর খাদ্যশষ্য উৎপাদিত হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ইতিপূর্বে প্রায় দুইশ’ আশি কোটি টাকা ব্যয়ে চলনবিলের উন্নয়নে বহুমূখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এজন্য রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় ব্যাপক জরিপ চালানো হয়। ওই জরিপ সূত্রে জানা গেছে, চলনবিলের মোট এলাকা পাঁচ লাখ ষিষট্টি হাজার একশ’ ছয়চল্লিশ হেক্টর। তন্মদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনায় পড়েছে পাঁচ লাখ আটত্রিশ হাজার বায়ান্নো হেক্টর। চাষযোগ্য জমির পরিমান চার লাখ বাইশ হাজার পাঁচশ’ ষাট হেক্টর। এর মধ্যে সেঁচ সুবিধার আওতায় রয়েছে তিন লাখ ঊনসত্তর হাজার সাতশ’ একান্ন হেক্টর জমি। চলনবিলে রয়েছে করতোয়া, বড়াল, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাই নামের বেশকিছু নদনদী। বর্ষাকালে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র দুই লাখ নয় হাজার তিনশ চোদ্দ হেক্টর এলাকা। মাছ সংগৃহিত হচ্ছে পয়ষট্টি হাজার ছয়শ’ চোদ্দ টন। এ অঞ্চলে বায়ান্নো লাখ চুরাশি হাজার নারী পুুরুষ শিশু কিশোর বসবাস করছে। চলনবিলাঞ্চলবাসীদের সিংহভাগই এখন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে জনবসতি বাড়তে থাকায় চাষযোগ্য জমি, বিল এলাকা ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করা হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের আয়তন বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ায় জলসীমার আয়তন ও পরিধিও কমেছে যা অতিথি পাখিদের অবাধে নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র এলাকাও কমে গেছে। ফলে অতীতের মতো চলনবিলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেয়া পরিকল্পনাটি অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখলে কৃষিনীর্ভর চলনবিলাঞ্চলবাসী বছরে দুইবার এমনকি তিনবারও ফসল ঘরে তুলতে পারতো।

অতীতের চলনবিলের কথা মনে উঠলেই অক্ষিপটে ভেসে ওঠে বিপদ সঙ্কুল ভয়ার্ত এক অঞ্চলের দৃশ্য! বিশাল এ জলাশয়কে কেন চলনবিল নামকরণ করা হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আজও মেলেনি। তবে প্রায় দুই হাজার বছর আগে চলনবিলের কোন অস্তিত্ব ছিল না বলে অতীত থেকে জানা যায়। তখন এ অঞ্চলটি ছিল সমুদ্রগর্ভে। কালাবর্তনে সমুদ্র সরে যেতে থাকে দক্ষিণে। দেশের অন্যান্য বিলের মতো চলনবিল স্থির নয়, হয়তো অতীতে নদীর স্রোতের মতো চলনবিলের স্রোত ছিল বলেই এর নামকরণ করা হয়েছিলো চলনবিল। অনেক নদ-নদীর মিলনস্থল চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পলি জমে চর জেগে উঠতে শুরু করে। এভাবে কালের আবর্তনে সময়ের ব্যবধানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধীরে ধীরে স্থলভাগ থেকে বিলাঞ্চল সংকোচিত হয়ে বিলাঞ্চলের আকার এখনো ক্রমাগত হ্রাস পেতে পেতে ঐহিত্য হারাতে বসেছে। অতিথি পাখির আগমনও কমে যাচ্ছে বিল অঞ্চলে নিরাপদ বিচরণক্ষেত্রের অভাবে। দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল এখন গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। সময় আবর্তনের সাথে সাথে এ অঞ্চলের আকার সংকোচনের পাশাপাশি পরিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাহিত্য, লোকজ সংস্কৃতিসহ স্থানীয়দের আচার-আচরণ। সার্বিক দিক বিবেচনায়, কালাবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তলদেশে পলি জমাসহ বহুবিধ কারণে সংকুচিত হয়ে যেমন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে চলনবিল, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাষকের ব্যাবহার, খাদ্যের অভাব, শৌখিন শিকারীর আগ্রাসনে চলনবিলাঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমনের হার ও উপস্থিতি কমে গেছে বহুগুণে।

নিউজটি শেয়ার করুন

সংকোচনের পথে চলনবিল: কমে গেছে অতিথি পাখির কলতান

আপডেট সময় : ০৬:৩২:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২

শামছুর রহমান শিশির:

এক সময় নাম শুনলেই গাঁ ছমছম করে ওঠা অজানা ভীতি সৃষ্টিকারী অঞ্চল, অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত এবং অভয়ারণ্য ‘চলনবিল’ কালের চক্রে সময়ের পরিধিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ বহুমূখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সংকোচনের পথে! আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বায়ুমন্ডলে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব ও দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ফলে দিগন্ত ছোঁয়া বিস্তৃত জলসীমা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে একদিকে যেমন ছোট আকার ধারণ করছে; অন্যদিকে এক সময়ের অতিথি পাখির অভয়ারণ্য  চলনবিল হারাতে বসেছে তার চিরচেনা ঐতিহ্য। চলনবিলের বুকে প্রমোদতরী ভাসিয়ে কত রাজা বাদশা, পাঠান মোগল নিরুত্তাপ ক্লান্তি ঝেড়েছেন, তার খবর কে রাখে! চলনবিলের বিশালত্ব ও দিগন্তছোঁয়া বিস্তৃর্ণ জলরাশির নৈসর্গিক দৃশ্য এবং বিদেশ থেকে আসা দৃষ্টিনন্দন অতিথি পাখি দেখে বিষ্ময়ে অবিভূত হয়ে কত পর্যটক, কত লেখক, কত কবি যে বিচিত্র কাহিনী লিখেছেন; তার হিসাব কে রাখে! কালাবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তলদেশে পলি জমাসহ বহুবিধ কারণে যেমন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে চলনবিল, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাষকের ব্যাবহার, খাদ্যের অভাব, শৌখিন শিকারীর আগ্রাসনে চলনবিলাঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমনের হার ও উপস্থিতিও কমে গেছে বহুগুণে। তার পরেও এ অঞ্চলে শীত পড়তে শুরু করায় ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। চলনবিলাঞ্চলের তীর এলাকার বিভিন্ন গাছে ও বিলাঞ্চলে ওইসব অতিথি পাখির আনাগোনা ও কলতান পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে অতীতের তুলনায় কম পরিমানে অতিথি পাখির আগমন ঘটলেও বিভিন্ন শৌখিন ও অসাধু শিকারীর ফাঁদে ওইসব পাখির জীবনও বিপন্ন হতে চলেছে।

জানা গেছে, এক সময় রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার তিন-চতুর্থাংশ, নওগাঁ মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, বেড়া থানা, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও তাড়াশ থানা ও বগুড়া জেলার শেরপুর, নন্দীগ্রাম এলাকার বেশ কিছু এলাকা জুড়ে চলনবিলের অস্তিত্ব ছিল বলে ইতিহাস আজও স্বাক্ষ্য বহন করে। আব্দুল হামিদের লেখা চলনবিলের ইতিকথা বইয়ে চলনবিলের উক্ত পরিধি ছাড়াও এক সময়ের পাবনা মহকুমার সিরাজগঞ্জ অংশ পুরোটাই চলনবিলের মধ্যে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ধীরে ধীরে চলনবিলের জমিতে পলি পড়তে থাকায় বিল এলাকা সরে আসতে আসতে বর্তমানে অনেক সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

প্রতি বছরেই হিমালয়, সাইবেরিয়া, ভারত, চীনসহ বর্হিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীতের তীব্রতা ও তুষারাপাত সহ্য করতে না পেরে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে চলনবিলে। শীত মৌসুমে চলনবিলে জলকুটকুট, পচার্ড, নর্দান, পিনটেল, সরালি, গাগেনি, কোম্বডাক, মুরগ্যারি, বামুনিয়া, কাস্তেচারা, সোনাজিরিয়া, হুডহুড, খয়রাসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ও তাদের কলতানে মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত থাকতো চলনবিল। কালের চক্রে সময়ের পরিধিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ বহুবিধ কারণে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য চলনবিলের বিস্তৃত জলরাশীর পরিধি সংকোচনের পাশাপাশি শীত মৌসুমে বর্হিঃবিশ্ব থেকে অতিথি পাখির আগমন কমে গেছে। বর্তমানে চলনবিল সংকুচিত হয়ে এতটাই পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছে যে ওই অঞ্চলে অবাধে বিচরণের ক্ষেত্র বিস্তুৃর্ণ জলসীমা ও সার্বিক পরিবেশ রীতিমতো অতিথি পাখির জন্য দিনে দিনে বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর চলনবিল দ্বি-খন্ডিত হয়ে পড়ে। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া থেকে জানা যায়, পদ্মা তীরের লালপুর থানা ছাড়া নাটোর মহকুমার বাকি এলাকাই ছিল বিলময়। তন্মদ্ধে চলনবিল ছিল সব চেয়ে বড় জলাশয় যার আয়তন ছিল প্রায় আটশ’ বর্গমাইল। এসময় চলনবিলের নাম শুনলেই ভয়ে গাঁ ছমছম করে উঠতো। প্রায় একশ’ বছর আগে জনবসতি এলাকা বাদে চলনবিলের জলসীমার আয়তন ছিল প্রায় পাঁচশ’ বর্গমাইলের ওপরে। এসময় চলনবিলে শীত মৌসুমে বর্হিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমানে অতিথি পাখির আগমন ঘটতো বলে অতীত সাক্ষ্য দেয়। পূর্ববঙ্গ রেলওয়ের প্রচার বিভাগ থেকে গত ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমন’ বইয়ে প্রকাশ, চলনবিলের আয়তন ছিল চারশ’ একচল্লিশ বর্গমাইল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের রেভিনিউ সার্ভে নকশায় উত্তর-পশ্চিমে কলম গ্রাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে সিধুলী, দক্ষিণে হরিপুর ও গুনাইগাছা, পূর্বে হান্ডিয়াল ও তাড়াশের মাঝে দেখানো হয়েছিল চলনবিলকে। হান্ডিয়ালের পর নবীন, ছাইকোলা ও বরদানগর নামের এলাকাগুলোতে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। জনবসতির পাশাপাশি বনজঙ্গল অঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য, বন্য পশুপ্রাণির সাথে অবির্ভাব হয় দস্যু তস্করের এবং মোঘল আমলে দুঃসাহসী ডাকাত বেণী রায়ের। ডাকাত বেণী রায়কে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী চলনবিল অঞ্চলে এখনো প্রচলিত রয়েছে। এসময় সলপের জোয়ারীর বিশী ও সান্যাল জমিদার বংশের পূর্ব পুরুষদের ডাকাতির অনেক কাহিনীও এ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। ডাকাতি ঠেকাতে ১৮১৩ সালে রাজশাহীকে ভেঙ্গে মালদহ, ১৮২১ সালে বগুড়া ও ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা গঠন করা হয়।

প্রতি বছর বন্যার পানির সাথে পলিমাটি জমে চলনবিলের জলরাশীর বিস্তৃতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় ১৯০৯ সালে চলনবিল অঞ্চলকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ সময় থেকেই এ অঞ্চলে জলকুটকুট, পচার্ড, নর্দান, পিনটেল, সরালি, গাগেনি, কোম্বডাক, মুরগ্যারি, বামুনিয়া, কাস্তেচারা, সোনাজিরিয়া, হুডহুড, খয়রাসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ও কলতান হ্রাস পেতে থাকে। এ অঞ্চলে গৃহিত পরিকল্পনার আলোকে পাবলিক ওর্য়াকস্ ডিপার্টমেন্ট পৃথক চলনবিল সাব-ডিভিশন গঠন করে। এরপর থেকে চলনবিলে চলছে বহুমূখী উন্নয়ন। শুধু বিদেশ থেকে শীত মৌসুমে আগত অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য ধরে রাখতে আজ অবধি নেয়া হয়নি কোন পরিকল্পনা । মৎস্য সম্পদকে ঘিরে এ অঞ্চলে বহু জেলেরা গড়ে তোলে বসতি। দেশে সর্ববৃহৎ মাছের খনি চলনবিল এখন শষ্য ভান্ডারে পরিণত হওয়ায় শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। ইতিপূর্বে  সরকার গৃহীত বন্যা নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনা পথিমধ্যে ভেস্তে যাওয়ায় এ অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল এখনও ফসলি জমি হিসেবে বিবেচিত হলেও অকাল বন্যাতে সে ফসলও নষ্ট হয়। এক সময়ের অতিথি পাখির অভয়ারণ্য চলনবিলের ভৌগলিক ও অবস্থানগত পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক কাঠামোরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দস্যু তস্কর ও বেণী রায় না থাকলেও নানা দুর্বৃত্তরা সে স্থান দখলে রেখেছে। প্রতি বছর নদ-নদীর ঘোলা পানি চলনবিলে ফেলে যায় পলি। ফলে এখানে প্রচুর খাদ্যশষ্য উৎপাদিত হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ইতিপূর্বে প্রায় দুইশ’ আশি কোটি টাকা ব্যয়ে চলনবিলের উন্নয়নে বহুমূখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এজন্য রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় ব্যাপক জরিপ চালানো হয়। ওই জরিপ সূত্রে জানা গেছে, চলনবিলের মোট এলাকা পাঁচ লাখ ষিষট্টি হাজার একশ’ ছয়চল্লিশ হেক্টর। তন্মদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনায় পড়েছে পাঁচ লাখ আটত্রিশ হাজার বায়ান্নো হেক্টর। চাষযোগ্য জমির পরিমান চার লাখ বাইশ হাজার পাঁচশ’ ষাট হেক্টর। এর মধ্যে সেঁচ সুবিধার আওতায় রয়েছে তিন লাখ ঊনসত্তর হাজার সাতশ’ একান্ন হেক্টর জমি। চলনবিলে রয়েছে করতোয়া, বড়াল, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাই নামের বেশকিছু নদনদী। বর্ষাকালে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র দুই লাখ নয় হাজার তিনশ চোদ্দ হেক্টর এলাকা। মাছ সংগৃহিত হচ্ছে পয়ষট্টি হাজার ছয়শ’ চোদ্দ টন। এ অঞ্চলে বায়ান্নো লাখ চুরাশি হাজার নারী পুুরুষ শিশু কিশোর বসবাস করছে। চলনবিলাঞ্চলবাসীদের সিংহভাগই এখন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে জনবসতি বাড়তে থাকায় চাষযোগ্য জমি, বিল এলাকা ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করা হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের আয়তন বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ায় জলসীমার আয়তন ও পরিধিও কমেছে যা অতিথি পাখিদের অবাধে নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র এলাকাও কমে গেছে। ফলে অতীতের মতো চলনবিলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেয়া পরিকল্পনাটি অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখলে কৃষিনীর্ভর চলনবিলাঞ্চলবাসী বছরে দুইবার এমনকি তিনবারও ফসল ঘরে তুলতে পারতো।

অতীতের চলনবিলের কথা মনে উঠলেই অক্ষিপটে ভেসে ওঠে বিপদ সঙ্কুল ভয়ার্ত এক অঞ্চলের দৃশ্য! বিশাল এ জলাশয়কে কেন চলনবিল নামকরণ করা হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আজও মেলেনি। তবে প্রায় দুই হাজার বছর আগে চলনবিলের কোন অস্তিত্ব ছিল না বলে অতীত থেকে জানা যায়। তখন এ অঞ্চলটি ছিল সমুদ্রগর্ভে। কালাবর্তনে সমুদ্র সরে যেতে থাকে দক্ষিণে। দেশের অন্যান্য বিলের মতো চলনবিল স্থির নয়, হয়তো অতীতে নদীর স্রোতের মতো চলনবিলের স্রোত ছিল বলেই এর নামকরণ করা হয়েছিলো চলনবিল। অনেক নদ-নদীর মিলনস্থল চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পলি জমে চর জেগে উঠতে শুরু করে। এভাবে কালের আবর্তনে সময়ের ব্যবধানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধীরে ধীরে স্থলভাগ থেকে বিলাঞ্চল সংকোচিত হয়ে বিলাঞ্চলের আকার এখনো ক্রমাগত হ্রাস পেতে পেতে ঐহিত্য হারাতে বসেছে। অতিথি পাখির আগমনও কমে যাচ্ছে বিল অঞ্চলে নিরাপদ বিচরণক্ষেত্রের অভাবে। দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল এখন গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। সময় আবর্তনের সাথে সাথে এ অঞ্চলের আকার সংকোচনের পাশাপাশি পরিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাহিত্য, লোকজ সংস্কৃতিসহ স্থানীয়দের আচার-আচরণ। সার্বিক দিক বিবেচনায়, কালাবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তলদেশে পলি জমাসহ বহুবিধ কারণে সংকুচিত হয়ে যেমন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে চলনবিল, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাষকের ব্যাবহার, খাদ্যের অভাব, শৌখিন শিকারীর আগ্রাসনে চলনবিলাঞ্চলে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমনের হার ও উপস্থিতি কমে গেছে বহুগুণে।