ঢাকা ০২:৩৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

রবীন্দ্র স্মরণ…

মোঃ শামছুর রহমান শিশির
  • আপডেট সময় : ০৮:০০:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ মে ২০২৪
  • / ৪৮২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাঙালির কাছে দু’টি দিন স্মরণীয়। এক হল পয়লা বৈশাখ, আর দুই হল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশে বৈশাখের দিনটিকে উপলক্ষ্য করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাণিজ্য হতে পারে- এমন ভাবাটা দুস্কর। সংস্কৃতিবান সেইসব রবীন্দ্র-প্রেমীদের কথা বলছি রবীন্দ্রনাথের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উৎসব পালনের সেই পঁচিশে বৈশাখেই। কারণ, এটি একটি মৌসুমী দাওয়াই। যাতে মিথ্যাচার ও ভন্ডামির রোগটা সারে। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, ইন্ডাস্ট্রি রবীন্দ্রনাথে পরিণত হয়েছেন অনেক আগেই। হয়তো বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ একটু অসস্তষ্টই হতেন তাঁকে নিয়ে তাঁর ভক্তদের এই রমরমা বাণিজ্য দেখে। ইতিমধ্যেই বিনোদনের মশলায় পরিণত হয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র ভাবনা এবং রবীন্দ্র স্বপ্ন। যে রবীন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়ন শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীদ্দশাতেই, সেই রবীন্দ্র-মূল্যায়ন আজও চলছে নিত্য নতুন গবেষকদের হাতে। তারা রবীন্দ্র জীবনের অনাবিস্কৃত দিক এমনকি তার শোবার ঘর পর্যন্ত দৌঁড়ে গেছে গবেষকদের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যেখান থেকে তারা উদঘাটন করেছেন এক অনন্য রবীন্দ্রনাথকে। পাঠকরা মুখ টিপে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হেঁসেছেন, বা রবীন্দ্রনাথ তো বেশ রসিক লোক ছিলেন। প্রতিভা তাঁর ছিল বহুমুখি। তরুণ গবেষকরা আত্মতৃপ্তির হাঁসি হেঁসেছেন অনাবিস্কৃত রবীন্দ্রনাথের থিসিস জমা দিয়ে পিএইচডি যোগ করেছেন পদবীর পাশের ব্রাকেটে। অনেক তরুণ গবেষক আখের ছিবড়ে চুষে রস বের করার মত করে পূর্বতন কোন রবীন্দ্র-গবেষকদের একই বিষয় নিয়ে কচলে গিয়েছেন বা যাচ্ছেন যদি এর মধ্য থেকে অন্য কোন তথ্য বেড়িয়ে পড়ে। হয়তো নতুন কিছু বেরোয়নি, তবু রবীন্দ্র জীবন নিয়ে সেই একই গান বাজনা শুনিয়েছেন রবীন্দ্র-প্রেমীদের। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আরেও জটিল। পাকিস্তান শাসনামলে হিন্দু বলে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিল। পূর্বপাকিস্তানের বাঙালীরা মেনে নেয়নি। বংলা ভাষার কবি বাঙালির কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর প্রানে ও অন্তরের সান্নিদ্ধে ছিলেন। এ কারণেই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বোধের জায়গা থেকেই বাঙালীর জাতীয় চেতনাবোধের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গণে নানা শোষন, বঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন, অসামঞ্জস্যতা থেকে মুক্তির দাবীতে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে বাঙালি জাতির অংশগ্রহন, লাখ লাখ মানুষের আত্মবলিদান ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের প্রথা চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় অনুষ্ঠান হিসেবে দিনটিকে স্মরণ করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীক অনুষ্ঠানটি পালিত হতো।

পরে ৯০ দশকে এসে স্থানীয় রবীন্দ্র-প্রেমী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবীর মুখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পদচারণায় মুখরিত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি ও নওগার পতিসর রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে জাতীয় কর্মসূচি অংশ হিসেবে এ তিনটি স্থানে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উৎসব পালনের সরকারী সিন্ধান্ত হয়। ১৯৯২ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর সরকারী কলেজ মাঠে আয়োজিত এক বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানে কবির ১৩১তম জন্মজয়ন্তী উৎসব জাতীয় কর্মসূচীর আলোকে প্রথম এ প্রথার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। সেই থেকে দেশের ওই তিনটি স্থানে জেলা প্রশাসনের তত্বাবধায়নে পঁচিশে বৈশাখ জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ অনুষ্ঠান পালনের পূর্বে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গঠন করা হয় নানা পর্যায়ের কমিটি। সকল কমিটির প্রধান করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের। নামকাওয়াস্তে কমিটির সদস্য করা হয় স্থানীয় কতিপয় ব্যাক্তিদের।

সরকারী বরাদ্দ  অর্থে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারী আমলা ও তাদের পরিরবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত হয় অনুষ্ঠান। বুকিং দেয়া হয় আশেপাশের ভিআইপি রেষ্ট হাউজগুলো। সেখানে উন্নতমানের উপাদেয় খাদ্যে পরিতৃপ্ত হয়ে তারা ধন্য ধন্য করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথকে। জমকালো উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে, সংগীত, নাটক, নাচ, কবিতা আবৃতি ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে তারা হয়ে যান শিরোমণি। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ব্যক্তি ও দলবাজীর কূহেলিকায় মুখরিত থাকে অনুষ্ঠানগুলি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রবীন্দ্র স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। স্মরনিকা বিতরনের গন্ডীও সীমাবদ্ধ। ওই স্মরণিকা সাধারন পাঠকের হাতে কোনদিনই পৌঁছে না। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও দেয়া হয় না।  এদের সাথে মিলেমিশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ করেই বনে যান রবীন্দ্র প্রেমী, রবীন্দ্র ভক্ত ও রবীন্দ্র গবেষক (স্থান ভেদে ভিন্ন চিত্র)। তারা তাদের নিজেদের সুবিধা আদায়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ এবং রবীন্দ্রনাথের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের পূতপবিত্র করার অভিপ্রায় অনেকটাই উলঙ্গ। এরা রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র ভাবনা এবং রবীন্দ্র স্বপ্নকে আপন গন্ডীর সাথে মিলেয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথকে বিকৃত করে বাণিজ্যিক উপকরণের স্তরে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের শেষ আছে কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর শেষ নেই। রবীন্দ্র সঙ্গীত যেন ত্রাতার ভূমিকা গ্রহন করেছে। বিয়ের বাজারে, বাসর ঘরে, পাড়ার জালসায়, সার্কাস ও যাত্রার প্যান্ডেলে, পুতুল নাচ-জুয়ার আসরে, এমনকি রেডিও টেলিভিশনে গাইবার সার্টিফিকেটের কাজ করছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। এ যেন অনেকটা জামবাক মলম যা ভাঙ্গা, মচকানোতে, কাজ দেয় আবার কাটা ফাটায় বা চোখের ব্যাথায়, কানের ব্যথায় কষ্ট পেলে তাতেও কাজ দেয়। শয়নে স্বপনে, মননে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী। সুপক্ক রবীন্দ্রনাথকে দরকচ্চা রবীন্দ্রনাথে পরিণত করতে আমাদের মত আঁতেলদের বেশি সময় লাগেনি। রবীন্দ্র নাথের স্বপ্নকে আমরা পৌঁছে দিয়েছি ঘর থেকে দুয়ারে, দুয়ার থেকে আঙ্গিনায়, সেখান থেকে বিশ্ব অঙ্গণে। ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক’ খুব সাধ ছিল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রসাধের পরিপূর্ণতার বাস্তবায়ন করতে আমাদের বেশী সময় লাগেনি। তবে এই বাস্তবায়নের রূপকার বলে আমরা যারা দাবি করি তাদের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ছিল না বা এখনও নেই। কথাটা এ কারণেই বলছি যে, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার প্রয়াস সেটা নিছক ভন্ডামি মাত্র, কেননা আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কতবড় রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে নাম কেনা যায় বা কতবড় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নাম কেনা যায় বা কতবড় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়- সেটাই মূল লক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ব্যাখ্য, অপব্যাখ্যা-খন্ডন-তস্য খন্ডন পারস্পরিক বিদগ্ধ রবীন্দ্র গবেষকদের তরতাজার লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের হয়েছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা’।

একসময়ে যারা তাঁকে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বা দারিদ্রবিলাসী মহাপুরুষ অভিধায় ভূষিত করেছেন-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তারাই যখন আবার মাথায় তুলে নাচছেন, তখন তাদের কর্মকান্ডকে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। রবীন্দ্রনাথকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা আমরা কোনকালেই করিনি হয়তো করার চেষ্টা করবো না। চেষ্টা করলে অসুবিধা হয়ে যেতে পারে এই ভেবেই হয়তো এই অপপ্রয়াস। আজকে রবীন্দ্র বাণিজ্য যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে অনেকে যে করেকম্মে খাচ্ছেন-এটা রবীন্দ্র ব্যবসায়ীদের আঁতে ঘা লাগলেও আমাদের কাছে অনভিপ্রেত। রবীন্দ্রনাথ যে এত সস্তা জিনিসে পরিণত হবেন এটা অভিপ্রেত নয় কারও কাছে। শুধু একটা দিন বা দুই তিন দিন রবীন্দ্র স্মরণ করার নাম করে এমন রবীন্দ্র বাণিজ্য বন্ধ হোক। আপনমহিমায়, কীর্তিতে চির জাগরিত থাকুক রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র দর্শণ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

[ লেখক : সম্পাদক, বাংলা খবর বিডি, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ ]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নিউজটি শেয়ার করুন

রবীন্দ্র স্মরণ…

আপডেট সময় : ০৮:০০:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ মে ২০২৪

বাঙালির কাছে দু’টি দিন স্মরণীয়। এক হল পয়লা বৈশাখ, আর দুই হল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশে বৈশাখের দিনটিকে উপলক্ষ্য করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাণিজ্য হতে পারে- এমন ভাবাটা দুস্কর। সংস্কৃতিবান সেইসব রবীন্দ্র-প্রেমীদের কথা বলছি রবীন্দ্রনাথের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উৎসব পালনের সেই পঁচিশে বৈশাখেই। কারণ, এটি একটি মৌসুমী দাওয়াই। যাতে মিথ্যাচার ও ভন্ডামির রোগটা সারে। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, ইন্ডাস্ট্রি রবীন্দ্রনাথে পরিণত হয়েছেন অনেক আগেই। হয়তো বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ একটু অসস্তষ্টই হতেন তাঁকে নিয়ে তাঁর ভক্তদের এই রমরমা বাণিজ্য দেখে। ইতিমধ্যেই বিনোদনের মশলায় পরিণত হয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র ভাবনা এবং রবীন্দ্র স্বপ্ন। যে রবীন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়ন শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীদ্দশাতেই, সেই রবীন্দ্র-মূল্যায়ন আজও চলছে নিত্য নতুন গবেষকদের হাতে। তারা রবীন্দ্র জীবনের অনাবিস্কৃত দিক এমনকি তার শোবার ঘর পর্যন্ত দৌঁড়ে গেছে গবেষকদের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যেখান থেকে তারা উদঘাটন করেছেন এক অনন্য রবীন্দ্রনাথকে। পাঠকরা মুখ টিপে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হেঁসেছেন, বা রবীন্দ্রনাথ তো বেশ রসিক লোক ছিলেন। প্রতিভা তাঁর ছিল বহুমুখি। তরুণ গবেষকরা আত্মতৃপ্তির হাঁসি হেঁসেছেন অনাবিস্কৃত রবীন্দ্রনাথের থিসিস জমা দিয়ে পিএইচডি যোগ করেছেন পদবীর পাশের ব্রাকেটে। অনেক তরুণ গবেষক আখের ছিবড়ে চুষে রস বের করার মত করে পূর্বতন কোন রবীন্দ্র-গবেষকদের একই বিষয় নিয়ে কচলে গিয়েছেন বা যাচ্ছেন যদি এর মধ্য থেকে অন্য কোন তথ্য বেড়িয়ে পড়ে। হয়তো নতুন কিছু বেরোয়নি, তবু রবীন্দ্র জীবন নিয়ে সেই একই গান বাজনা শুনিয়েছেন রবীন্দ্র-প্রেমীদের। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আরেও জটিল। পাকিস্তান শাসনামলে হিন্দু বলে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিল। পূর্বপাকিস্তানের বাঙালীরা মেনে নেয়নি। বংলা ভাষার কবি বাঙালির কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর প্রানে ও অন্তরের সান্নিদ্ধে ছিলেন। এ কারণেই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বোধের জায়গা থেকেই বাঙালীর জাতীয় চেতনাবোধের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গণে নানা শোষন, বঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন, অসামঞ্জস্যতা থেকে মুক্তির দাবীতে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে বাঙালি জাতির অংশগ্রহন, লাখ লাখ মানুষের আত্মবলিদান ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের প্রথা চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় অনুষ্ঠান হিসেবে দিনটিকে স্মরণ করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীক অনুষ্ঠানটি পালিত হতো।

পরে ৯০ দশকে এসে স্থানীয় রবীন্দ্র-প্রেমী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবীর মুখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পদচারণায় মুখরিত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি ও নওগার পতিসর রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে জাতীয় কর্মসূচি অংশ হিসেবে এ তিনটি স্থানে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উৎসব পালনের সরকারী সিন্ধান্ত হয়। ১৯৯২ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর সরকারী কলেজ মাঠে আয়োজিত এক বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানে কবির ১৩১তম জন্মজয়ন্তী উৎসব জাতীয় কর্মসূচীর আলোকে প্রথম এ প্রথার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। সেই থেকে দেশের ওই তিনটি স্থানে জেলা প্রশাসনের তত্বাবধায়নে পঁচিশে বৈশাখ জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ অনুষ্ঠান পালনের পূর্বে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গঠন করা হয় নানা পর্যায়ের কমিটি। সকল কমিটির প্রধান করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের। নামকাওয়াস্তে কমিটির সদস্য করা হয় স্থানীয় কতিপয় ব্যাক্তিদের।

সরকারী বরাদ্দ  অর্থে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারী আমলা ও তাদের পরিরবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত হয় অনুষ্ঠান। বুকিং দেয়া হয় আশেপাশের ভিআইপি রেষ্ট হাউজগুলো। সেখানে উন্নতমানের উপাদেয় খাদ্যে পরিতৃপ্ত হয়ে তারা ধন্য ধন্য করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথকে। জমকালো উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে, সংগীত, নাটক, নাচ, কবিতা আবৃতি ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে তারা হয়ে যান শিরোমণি। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ব্যক্তি ও দলবাজীর কূহেলিকায় মুখরিত থাকে অনুষ্ঠানগুলি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রবীন্দ্র স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। স্মরনিকা বিতরনের গন্ডীও সীমাবদ্ধ। ওই স্মরণিকা সাধারন পাঠকের হাতে কোনদিনই পৌঁছে না। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও দেয়া হয় না।  এদের সাথে মিলেমিশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ করেই বনে যান রবীন্দ্র প্রেমী, রবীন্দ্র ভক্ত ও রবীন্দ্র গবেষক (স্থান ভেদে ভিন্ন চিত্র)। তারা তাদের নিজেদের সুবিধা আদায়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ এবং রবীন্দ্রনাথের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের পূতপবিত্র করার অভিপ্রায় অনেকটাই উলঙ্গ। এরা রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র ভাবনা এবং রবীন্দ্র স্বপ্নকে আপন গন্ডীর সাথে মিলেয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথকে বিকৃত করে বাণিজ্যিক উপকরণের স্তরে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের শেষ আছে কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর শেষ নেই। রবীন্দ্র সঙ্গীত যেন ত্রাতার ভূমিকা গ্রহন করেছে। বিয়ের বাজারে, বাসর ঘরে, পাড়ার জালসায়, সার্কাস ও যাত্রার প্যান্ডেলে, পুতুল নাচ-জুয়ার আসরে, এমনকি রেডিও টেলিভিশনে গাইবার সার্টিফিকেটের কাজ করছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। এ যেন অনেকটা জামবাক মলম যা ভাঙ্গা, মচকানোতে, কাজ দেয় আবার কাটা ফাটায় বা চোখের ব্যাথায়, কানের ব্যথায় কষ্ট পেলে তাতেও কাজ দেয়। শয়নে স্বপনে, মননে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী। সুপক্ক রবীন্দ্রনাথকে দরকচ্চা রবীন্দ্রনাথে পরিণত করতে আমাদের মত আঁতেলদের বেশি সময় লাগেনি। রবীন্দ্র নাথের স্বপ্নকে আমরা পৌঁছে দিয়েছি ঘর থেকে দুয়ারে, দুয়ার থেকে আঙ্গিনায়, সেখান থেকে বিশ্ব অঙ্গণে। ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক’ খুব সাধ ছিল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রসাধের পরিপূর্ণতার বাস্তবায়ন করতে আমাদের বেশী সময় লাগেনি। তবে এই বাস্তবায়নের রূপকার বলে আমরা যারা দাবি করি তাদের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ছিল না বা এখনও নেই। কথাটা এ কারণেই বলছি যে, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার প্রয়াস সেটা নিছক ভন্ডামি মাত্র, কেননা আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কতবড় রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে নাম কেনা যায় বা কতবড় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নাম কেনা যায় বা কতবড় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়- সেটাই মূল লক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ব্যাখ্য, অপব্যাখ্যা-খন্ডন-তস্য খন্ডন পারস্পরিক বিদগ্ধ রবীন্দ্র গবেষকদের তরতাজার লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের হয়েছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা’।

একসময়ে যারা তাঁকে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বা দারিদ্রবিলাসী মহাপুরুষ অভিধায় ভূষিত করেছেন-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তারাই যখন আবার মাথায় তুলে নাচছেন, তখন তাদের কর্মকান্ডকে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। রবীন্দ্রনাথকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা আমরা কোনকালেই করিনি হয়তো করার চেষ্টা করবো না। চেষ্টা করলে অসুবিধা হয়ে যেতে পারে এই ভেবেই হয়তো এই অপপ্রয়াস। আজকে রবীন্দ্র বাণিজ্য যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে অনেকে যে করেকম্মে খাচ্ছেন-এটা রবীন্দ্র ব্যবসায়ীদের আঁতে ঘা লাগলেও আমাদের কাছে অনভিপ্রেত। রবীন্দ্রনাথ যে এত সস্তা জিনিসে পরিণত হবেন এটা অভিপ্রেত নয় কারও কাছে। শুধু একটা দিন বা দুই তিন দিন রবীন্দ্র স্মরণ করার নাম করে এমন রবীন্দ্র বাণিজ্য বন্ধ হোক। আপনমহিমায়, কীর্তিতে চির জাগরিত থাকুক রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র দর্শণ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

[ লেখক : সম্পাদক, বাংলা খবর বিডি, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ ]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)