ঢাকা ০৪:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পাহাড়জুড়ে বইছে বৈসাবি উৎসবের আমেজ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:৩৬:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ এপ্রিল ২০২৩
  • / ৪৫৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাঙ্গামাটি সংবাদদাতা: চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করতে পাহাড়ে এখন বৈসাবি উৎসবের আমেজ বইছে। পাহাড়ীদের এই উৎসব তিনটি আলাদা নামে হলেও সমতলের মানুষের কাছে তা বৈসাবি নামে পরিচিত।

পাহাড়ের মানুষের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি তথা বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক পালন করা হচ্ছে এবার সারম্বরে। আলাদা নামে হলেও চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা জাতিগোষ্ঠির মানুষ একযোগে পালন করে এ উৎসব। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই আর তংচঙ্গ্যারা বিষু নামে এ সামাজিক উৎসব পালন করে। তবে বাংলা ভাষাভাষি মানুষ এ উৎসবকে বৈসাবি নামেই চেনে।

উৎসবকে ঘিরে নানান আয়োজন শুরু হয়েছে পাহাড়ি গ্রামে। সপ্তাহ জুড়ে চলবে এ উৎসব। আর এই বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে সকল ক্ষুদ্র জাতিকে এক কাতারে নিয়ে আসে প্রতিবছর।

আগামী ১২ এপ্রিল নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে মূল উৎসব শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাহাড়ে বৈসাবির উৎসব শুরু হয়। গ্রামে-গ্রামে চলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহবাহী নানা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। হাট-বাজারগুলোতে চলছে কেনাকাটার ধুম।

এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান পর্যাক্রমে আনন্দ র‌্যালি, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টটিভ্যাল বা পানি খেলা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় গড়িয়া নৃত্য’র আয়োজন করেছে। এবার উৎসব মুখর পরিবেশে বৈসাবি পালিত হবে এমনি প্রত্যাশা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর।

রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিষু-বিহু নামে পালন করে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রনে বৈসাবি এক বৈচিত্রময় রূপ ধারণ করেছে।

এটা মূলত পুরোন বছরকে বিদায় দেওয়া আর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের এ বৈসাবি উৎসব। এই উৎসবটি বয়ে আনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন হয়। থাকেনা কোন হিংসা-বিদ্বেষ। আশা করি বৈসাবির আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। পাহাড়ে বয়ে আসছে শান্তি ও সম্প্রীতি এক মিলনমেলা।

বিজু ১ : পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানকে বৈসু উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করে। এরা যদিওবা হিন্দুধর্মাবলম্বী তারা কিন্তু এদিনে অনাগত দিন যাতে সুখের হয়, দেশ সমৃদ্ধি লাভ করে, এ কামনায় মন্দিরে গিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে বিশেষ প্রার্থনায়রত থাকেন। শিশু-কিশোরের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে এবং তরুণ-তরুণীরা তাদের প্রিয়জনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজুকে তিন পর্বে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। এগুলো হলো- হারি বিজু, বিষুমা বিজু ও বিসিকাতাল বিজু। এ উৎসব পালনকালীন সময়ে তারা জাতিভেদ হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছু পরিত্যাগ করে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক সুখের বাতাবরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এদিনে তারা পাচন, সেমাই, পিঠা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে। গরু-মহিষের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তারা ফসলসহ নানা দ্রব্যাদি উৎপাদন করে বিধায় গরু-মহিষকে স্নান করিয়ে এদের গলায় পাহাড়ি কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এভাবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজু উৎসব বছরের শেষ দিনে মহাসমারোহে উদযাপন করে।

বিজু ২ : বিজু হলো চাকমা ভাষা, বৈসু ত্রিপুরা ভাষা, সাংগ্রাই মারমা ভাষা। চাকমা সম্প্রদায় বিজু উৎসবকে তিন ভাগে ভাগ করে পালন করে থাকে। বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুল বিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূল বিজু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে ‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ নামে রকমারি উৎসব পালন করে।

ফুল বিজু : ফুল বিজুর দিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নানা রকমের ফুলের সন্ধানে শিশু-কিশোরের দল সবুজ পাহাড়ি গহিন অরণ্যে বিচরণ শুরু করে দেয়। ফুল সংগ্রহ শেষে এরা বাড়িতে ফিরে এসে ফুলগুলোকে চার ভাগে ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে নিজের মনের মতো করে ঘরবাড়ি সাজায়। দ্বিতীয় ভাগ ফুল নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে যায়। বুদ্ধের উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ করে সমবেত প্রার্থনায় রত হয়। পঞ্চশীলে সকলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক দেয় ধর্মীয় দেশনা শ্রবণ করে। তৃতীয় ভাগ ফুল ছড়া, নদী বা পুকুরের পাড়ে পূজামন্ডপ তৈরি করে, সেখানে প্রার্থনা করে যেন সারা বছর পানির ন্যায় অর্থাৎ পানি যেমন শান্তশিষ্ট, ধীরে প্রবাহমান, সে ধরনের জীবনযাপন সকলে যেন করতে পারে। চতুর্থ ভাগ ফুল তারা প্রিয়জনকে ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

মূল বিজু : মূল বিজু হচ্ছে বিজুর প্রথম দিন। ফুল বিজুর দিনে মূল বিজুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। এদিনে ঘরের মহিলারা খুবই ব্যস্ত থাকে। ত্রিশ-চল্লিশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও অধিক কাঁচা তরকারির সংমিশ্রণে পাচন বা ঘন্ড তৈরি করা হয়। পাচন ছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, পায়েস, মাছ-মাংসের আয়োজনও থাকে। বছরের ঐতিহ্য হিসেবে থাকে বিন্নি ধানের খই, নাড়–, সেমাইয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি মদও পরিবেশন করা হয় আগত মেহমানদের।

আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সকলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং নানা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘরের দরজায়, উঠানে, গো-শালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়।

গজ্যাপজ্যা বিজু : নববর্ষের প্রথম দিনকে চাকমারা গজ্যাপজ্যা বিজু হিসেবে উদযাপন করে। এদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চাকমারা বিশ্রাম করে দিন অতিবাহিত করে। ছোটরা বড়দের নমস্কার করে এবং স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সবাই স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে মশগুল থাকে। ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক ধর্ম দেশনা শুনে অনাগত দিন সুখেশান্তিতে কাটানোর জন্য বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে। এভাবে গজ্যাপজ্যা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সাংগ্রাই : সাংগ্রাই, এটি মারমা ভাষা। মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনে নানা অনুষ্ঠান পালন করে। যার কারণে এ দিনটিকে সাংগ্রাই নামে অভিহিত করা হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে সাংগ্রাই পালন করে থাকে মারমা সম্প্রদায়। সেমাই, পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা সম্প্রদায়। একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশলবিনিময় করে এবং আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকে। উল্লেখ্য যে, মারমা সম্প্রদায়ের এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ‘জলোৎসব’। জলকেলি দৃশ্য বেশ উপভোগ্য বলে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে উৎসবস্থলে। মারমা ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘রিলংপোয়ে’। জলখেলার জন্য এরা আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে। ওই প্যান্ডেলে যুবক-যুবতীরা একে অপরের প্রতি জল ছিটিয়ে মেরে কাবু করার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়। বয়স্করা এদিনে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক ধর্ম অনুশীলনে রত থাকে। শিশু-কিশোররা জল ছিটিয়ে আনন্দ-উল্লাস পালন করার পাশাপাশি দড়ি টানাটানি, হাডুডু ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে সাংগ্রাই উৎসবকে বিদায় জানায়।

সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রাঙ্গামাটিসহ পাহাড়ের সর্বত্র বিজু বৈসুক সাংগ্রাই উৎসব আনন্দঘন পরিবেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি আর সৌহাদ্য বাড়বে এমন প্রত্যাশা সকলের।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে বসবাসরত ১৩ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে বিজু, সাংগ্রাইং, সাংক্রান, সাংক্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, জল উৎসব ও বাংলা নববর্ষ উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্যদিয়ে পালন করা হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

পাহাড়জুড়ে বইছে বৈসাবি উৎসবের আমেজ

আপডেট সময় : ১২:৩৬:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ এপ্রিল ২০২৩

রাঙ্গামাটি সংবাদদাতা: চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করতে পাহাড়ে এখন বৈসাবি উৎসবের আমেজ বইছে। পাহাড়ীদের এই উৎসব তিনটি আলাদা নামে হলেও সমতলের মানুষের কাছে তা বৈসাবি নামে পরিচিত।

পাহাড়ের মানুষের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি তথা বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক পালন করা হচ্ছে এবার সারম্বরে। আলাদা নামে হলেও চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা জাতিগোষ্ঠির মানুষ একযোগে পালন করে এ উৎসব। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই আর তংচঙ্গ্যারা বিষু নামে এ সামাজিক উৎসব পালন করে। তবে বাংলা ভাষাভাষি মানুষ এ উৎসবকে বৈসাবি নামেই চেনে।

উৎসবকে ঘিরে নানান আয়োজন শুরু হয়েছে পাহাড়ি গ্রামে। সপ্তাহ জুড়ে চলবে এ উৎসব। আর এই বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে সকল ক্ষুদ্র জাতিকে এক কাতারে নিয়ে আসে প্রতিবছর।

আগামী ১২ এপ্রিল নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে মূল উৎসব শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাহাড়ে বৈসাবির উৎসব শুরু হয়। গ্রামে-গ্রামে চলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহবাহী নানা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। হাট-বাজারগুলোতে চলছে কেনাকাটার ধুম।

এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান পর্যাক্রমে আনন্দ র‌্যালি, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টটিভ্যাল বা পানি খেলা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় গড়িয়া নৃত্য’র আয়োজন করেছে। এবার উৎসব মুখর পরিবেশে বৈসাবি পালিত হবে এমনি প্রত্যাশা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর।

রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিষু-বিহু নামে পালন করে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রনে বৈসাবি এক বৈচিত্রময় রূপ ধারণ করেছে।

এটা মূলত পুরোন বছরকে বিদায় দেওয়া আর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের এ বৈসাবি উৎসব। এই উৎসবটি বয়ে আনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন হয়। থাকেনা কোন হিংসা-বিদ্বেষ। আশা করি বৈসাবির আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। পাহাড়ে বয়ে আসছে শান্তি ও সম্প্রীতি এক মিলনমেলা।

বিজু ১ : পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানকে বৈসু উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করে। এরা যদিওবা হিন্দুধর্মাবলম্বী তারা কিন্তু এদিনে অনাগত দিন যাতে সুখের হয়, দেশ সমৃদ্ধি লাভ করে, এ কামনায় মন্দিরে গিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে বিশেষ প্রার্থনায়রত থাকেন। শিশু-কিশোরের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে এবং তরুণ-তরুণীরা তাদের প্রিয়জনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজুকে তিন পর্বে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। এগুলো হলো- হারি বিজু, বিষুমা বিজু ও বিসিকাতাল বিজু। এ উৎসব পালনকালীন সময়ে তারা জাতিভেদ হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছু পরিত্যাগ করে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক সুখের বাতাবরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এদিনে তারা পাচন, সেমাই, পিঠা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে। গরু-মহিষের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তারা ফসলসহ নানা দ্রব্যাদি উৎপাদন করে বিধায় গরু-মহিষকে স্নান করিয়ে এদের গলায় পাহাড়ি কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এভাবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজু উৎসব বছরের শেষ দিনে মহাসমারোহে উদযাপন করে।

বিজু ২ : বিজু হলো চাকমা ভাষা, বৈসু ত্রিপুরা ভাষা, সাংগ্রাই মারমা ভাষা। চাকমা সম্প্রদায় বিজু উৎসবকে তিন ভাগে ভাগ করে পালন করে থাকে। বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুল বিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূল বিজু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে ‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ নামে রকমারি উৎসব পালন করে।

ফুল বিজু : ফুল বিজুর দিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নানা রকমের ফুলের সন্ধানে শিশু-কিশোরের দল সবুজ পাহাড়ি গহিন অরণ্যে বিচরণ শুরু করে দেয়। ফুল সংগ্রহ শেষে এরা বাড়িতে ফিরে এসে ফুলগুলোকে চার ভাগে ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে নিজের মনের মতো করে ঘরবাড়ি সাজায়। দ্বিতীয় ভাগ ফুল নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে যায়। বুদ্ধের উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ করে সমবেত প্রার্থনায় রত হয়। পঞ্চশীলে সকলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক দেয় ধর্মীয় দেশনা শ্রবণ করে। তৃতীয় ভাগ ফুল ছড়া, নদী বা পুকুরের পাড়ে পূজামন্ডপ তৈরি করে, সেখানে প্রার্থনা করে যেন সারা বছর পানির ন্যায় অর্থাৎ পানি যেমন শান্তশিষ্ট, ধীরে প্রবাহমান, সে ধরনের জীবনযাপন সকলে যেন করতে পারে। চতুর্থ ভাগ ফুল তারা প্রিয়জনকে ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

মূল বিজু : মূল বিজু হচ্ছে বিজুর প্রথম দিন। ফুল বিজুর দিনে মূল বিজুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। এদিনে ঘরের মহিলারা খুবই ব্যস্ত থাকে। ত্রিশ-চল্লিশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও অধিক কাঁচা তরকারির সংমিশ্রণে পাচন বা ঘন্ড তৈরি করা হয়। পাচন ছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, পায়েস, মাছ-মাংসের আয়োজনও থাকে। বছরের ঐতিহ্য হিসেবে থাকে বিন্নি ধানের খই, নাড়–, সেমাইয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি মদও পরিবেশন করা হয় আগত মেহমানদের।

আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সকলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং নানা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘরের দরজায়, উঠানে, গো-শালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়।

গজ্যাপজ্যা বিজু : নববর্ষের প্রথম দিনকে চাকমারা গজ্যাপজ্যা বিজু হিসেবে উদযাপন করে। এদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চাকমারা বিশ্রাম করে দিন অতিবাহিত করে। ছোটরা বড়দের নমস্কার করে এবং স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সবাই স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে মশগুল থাকে। ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক ধর্ম দেশনা শুনে অনাগত দিন সুখেশান্তিতে কাটানোর জন্য বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে। এভাবে গজ্যাপজ্যা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সাংগ্রাই : সাংগ্রাই, এটি মারমা ভাষা। মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনে নানা অনুষ্ঠান পালন করে। যার কারণে এ দিনটিকে সাংগ্রাই নামে অভিহিত করা হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে সাংগ্রাই পালন করে থাকে মারমা সম্প্রদায়। সেমাই, পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা সম্প্রদায়। একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশলবিনিময় করে এবং আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকে। উল্লেখ্য যে, মারমা সম্প্রদায়ের এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ‘জলোৎসব’। জলকেলি দৃশ্য বেশ উপভোগ্য বলে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে উৎসবস্থলে। মারমা ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘রিলংপোয়ে’। জলখেলার জন্য এরা আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে। ওই প্যান্ডেলে যুবক-যুবতীরা একে অপরের প্রতি জল ছিটিয়ে মেরে কাবু করার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়। বয়স্করা এদিনে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক ধর্ম অনুশীলনে রত থাকে। শিশু-কিশোররা জল ছিটিয়ে আনন্দ-উল্লাস পালন করার পাশাপাশি দড়ি টানাটানি, হাডুডু ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে সাংগ্রাই উৎসবকে বিদায় জানায়।

সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রাঙ্গামাটিসহ পাহাড়ের সর্বত্র বিজু বৈসুক সাংগ্রাই উৎসব আনন্দঘন পরিবেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি আর সৌহাদ্য বাড়বে এমন প্রত্যাশা সকলের।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে বসবাসরত ১৩ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে বিজু, সাংগ্রাইং, সাংক্রান, সাংক্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, জল উৎসব ও বাংলা নববর্ষ উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্যদিয়ে পালন করা হয়।