ঢাকা ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জে সরিষা চাষে বিপ্লব

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:৫০:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৫৬৮ বার পড়া হয়েছে

পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জে সরিষা চাষে বিপ্লব

বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

দেশের উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো থোকা থোকা হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রুপ। প্রান্ত জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শিশির ভেজা শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে। হলুদ রঙের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা সপরিবারে ভিড় করছেন মাঠে, তুলছেন ছবি।

বাংলাদেশে এখন চলছে শীতকাল। এই মওসুমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষিরা। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন তারা। এতে অনেকের বেকারত্ব দূর হয়েছে। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নত মানের মধূ। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মওসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালান করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে চাক বানায়। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।

পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে গত মওসুমের শুরু থেকে বাজারে সরিষার চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় কৃষকরা ব্যাপকভাবে সরিষা আবাদ করেছেন। চলতি মওসুমে তিন জেলায় প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবী জাতের সরসের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার হেক্টর বেশি। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে থোকা থোকা হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সরিষার ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ প্রকৃতি প্রেমীদের। গোটা অঞ্চল মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মৌচাষিরা মধু আহরনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে চলতি মওসুমে এ অঞ্চলে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার টন সরিষা ও দুই হাজার টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর, সিংড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তারাশ, চৌহালী, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুরসহ ২৬টি উপজেলায় চলতি রবি মওসুমে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে (প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে) দুই লাখ ৫০ হাজার টন। উল্লাপাড়া-তাড়াশ সড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। চলতি মওসুমে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় সরিষার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

পাবনার বেড়া উপজেলার যমুনা নদী বেষ্টিত ঢালরচরের কৃষক রমজান আলী জানান, এক একর জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মন সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মন সরিষার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণের বেশি লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক ছলিম খা জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। সাত বছর ধরে সরিষা চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে পৌনে দুই থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

ইউরোপিয়ান হাইব্রীড মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে  মৌবাক্সে।  চলতি মওসুমে যদি আবহাওয়া অনুকুল থাকে তাহলে তিন জেলায় দেড় থেকে দুই হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা হিসেবে ৪৩ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরিষা ক্ষেতের আলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।

পাবনা আব্দুল আজিজ জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুন মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। মধু উৎপাদনে (পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ) চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরষের ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।

বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমান প্রায় দেড় লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু অগ্রিম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানী, ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামি-দামি ব্যান্ডের প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছে। সুন্দরবনের মধুচাষিরা এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে।

বগুড়া থেকে চলনবিলের বারুহাস এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা আব্দুস ছালাম বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মধু আহরণ করছে। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছি। মনে হচ্ছে গত বারের চেয়ে অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জে সরিষা চাষে বিপ্লব

আপডেট সময় : ১২:৫০:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২২

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিবেদক :

দেশের উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো থোকা থোকা হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রুপ। প্রান্ত জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শিশির ভেজা শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে। হলুদ রঙের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা সপরিবারে ভিড় করছেন মাঠে, তুলছেন ছবি।

বাংলাদেশে এখন চলছে শীতকাল। এই মওসুমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষিরা। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন তারা। এতে অনেকের বেকারত্ব দূর হয়েছে। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নত মানের মধূ। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মওসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালান করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে চাক বানায়। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।

পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে গত মওসুমের শুরু থেকে বাজারে সরিষার চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় কৃষকরা ব্যাপকভাবে সরিষা আবাদ করেছেন। চলতি মওসুমে তিন জেলায় প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবী জাতের সরসের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার হেক্টর বেশি। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে থোকা থোকা হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সরিষার ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ প্রকৃতি প্রেমীদের। গোটা অঞ্চল মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মৌচাষিরা মধু আহরনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে চলতি মওসুমে এ অঞ্চলে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার টন সরিষা ও দুই হাজার টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর, সিংড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তারাশ, চৌহালী, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুরসহ ২৬টি উপজেলায় চলতি রবি মওসুমে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে (প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে) দুই লাখ ৫০ হাজার টন। উল্লাপাড়া-তাড়াশ সড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। চলতি মওসুমে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় সরিষার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

পাবনার বেড়া উপজেলার যমুনা নদী বেষ্টিত ঢালরচরের কৃষক রমজান আলী জানান, এক একর জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মন সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মন সরিষার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণের বেশি লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক ছলিম খা জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। সাত বছর ধরে সরিষা চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে পৌনে দুই থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

ইউরোপিয়ান হাইব্রীড মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে  মৌবাক্সে।  চলতি মওসুমে যদি আবহাওয়া অনুকুল থাকে তাহলে তিন জেলায় দেড় থেকে দুই হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা হিসেবে ৪৩ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরিষা ক্ষেতের আলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।

পাবনা আব্দুল আজিজ জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুন মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। মধু উৎপাদনে (পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ) চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরষের ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।

বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমান প্রায় দেড় লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু অগ্রিম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানী, ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামি-দামি ব্যান্ডের প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছে। সুন্দরবনের মধুচাষিরা এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে।

বগুড়া থেকে চলনবিলের বারুহাস এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা আব্দুস ছালাম বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মধু আহরণ করছে। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছি। মনে হচ্ছে গত বারের চেয়ে অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।