ঢাকা ০৩:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পাবনার ১৬ নদীর মধ্যে ১২টি মাছের খামার ও ফসলী জমি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:২০:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৪৬১ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম :

পাবনার ১৬টি নদীর মধ্যে ১২টি মৎস্য খামার ও ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। ৪টি নদীতে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সঙ্কট। ১৬টি নদীর প্রায় ৫০০ কিলোমিটার নৌপথ ক্রমাগত পলি জমে ভরাট হয়ে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়েছে। এক সময় এ অঞ্চলের নদ-নদীতে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াতো প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আবার অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলার দক্ষিণে পদ্মা, পূর্বে যমুনা উত্তরপ্রান্ত দিয়ে বড়াল ও হুরাসাগর এই ৪টি নদী প্রবাহিত। এসব নদীতে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সঙ্কট। কাকেশ্বরী, সুতিখালী নদী এখন নিষ্কাশন খাল, ইছামতি ও আত্রাই নদী সেচ খালসহ রেগুলেটর নির্মাণ করায় চিকনাই নদী, বাদাই ও অন্যান্য নদী হাইব্রিড মাছের খামার ও ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। এসব নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কাজ ভূগর্ভ নির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। প্রকৃতিতে বিরাজ করছে মরুর রুক্ষতা।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন নৌরুটে লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করত। এখন জেলার নদীপথ বছরব্যাপী সচল থাকে না। নাব্যতা ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্পর্কে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি পর্যায়ে জেলার নদীগুলো সম্পর্কে একটা অদ্ভূত উদাসীন মনোভাব পোষণের কারণে আজ বিপর্যস্ত নৌপথ। প্রায় আট বছর হয়ে গেল কাজীরহাট ঘাটে ফেরি ভিড়ে না। পন্টুন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বেড়ায় নৌবন্দর পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়নের পর পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
নদী পথে যাতায়াত আগের মতোই এখনো সুলভ। প্রতি লিটার জ্বালানীতে নৌপথে ২১৭ টন মালামাল পরিবাহিত হয় এক কিলোমিটার পথ। অথচ সড়ক পথে ডিজেল চালিত ট্রাকে এক লিটার জ্বালানীতে এক টন মালামাল এক কিলোমিটার বহন করা যায়। নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করায় নৌপথ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জেলায় সারা বছর কতটুকু নৌপথ চালু থাকে তারও জরিপ করা হয় না। ১২ মাস পানি থাকে এমন নদী পদ্মা ও যমুনাতে নাব্যতা সঙ্কটে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে মালবাহী জাহাজ।
পাবনা জেলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায় পদ্মা নদীর ৭৫ কিলোমিটার, পূর্ব দিকে যমুনা নদীর ২০ কিলোমিটার, উত্তর দিরে হুরাসাগর নদের আট কিলোমিটার এবং বড়াল নদীর ২৫ কিলোমিটার নদীপথ কোনোমতে টিকে আছে। সামান্য নৌপথ রয়েছে গুমানী নদীতে। রত্নাই, আত্রাই, সুতিখালী, চিকনাই, চন্দ্রাবতী, কাকেশ্বরী, বাদাই ও ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়। শুস্ক মৌসুমে বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসন এসব নদী ইজারা দিয়ে থাকে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে রুকনাই, বারনাই, ট্যাপাগাড়ী, গোহালা, শালিকা, শুটকিদহ ও ভাঙ্গুড়ার ইছামতি নদী। ইছামতি নদীতে ৫০ কিলোমিটার নৌপথ ছিল। চিকনাই ৩৮ কিলোমিটার ও আত্রাই ৩০ কিলোমিটার। এখন এসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বড়াল ও ইছামতি নদীর খাত সাঁথিয়ার বোয়ালমারীর কাছে দ্বিখন্ডিত হয়ে আত্রাই নামে পূর্ব দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে মিলিত হয়। এক সময় আত্রাই নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। বিপুল পলিমাটির অবক্ষেপণে আত্রাই নদী ভরাট হয়ে যায়। জেলায় যাতায়াতের ও একমাত্র উপায় ছিল নদী পথ। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকালে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মান করায় নদী পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার ১২টি নদীপথ ভরাট হয়ে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শুস্ক মৌসুমে বিরাজ করে মরুভূমির মতো অবস্থা।
ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা মিলে বড়াল নদী রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে পানি থাকে না। এ নদীর গভীরতা বর্তমানে তিন মিটার দাঁড়িয়েছে। চার মাসও নৌকা চলে না। গোমানী নদীর নাব্যতা থাকেনা পাঁচটি ঋতুতে। বাঘাবাড়ীর কাছে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুরাসাগর নদ নামে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। বড়াল নদী পথে মিল্কভিটার সদস্যরা দুধ সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে নৌপথ অচল হয়ে পড়ায় তরল দুধ সরবরাহে তাদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে গোহালা নদীকে মধ্যবর্তী একটি চর বিভক্ত করে রাখে। কিন্তু বর্ষাকালে এই চর তলিয়ে গেলে নদী তখন বিভক্ত থাকে না, একত্র হয়ে যায়। তখন নৌযান যাতায়াত বাড়ে।
বর্ষাকালে পাবনার পাট, মাছ, গুড়, গবাদীপশুসহ বিভিন্ন পণ্য এখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একমাত্র বেড়া থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নদী পথের নাব্যতা রক্ষা ও উন্নয়নে কাজীরহাট ঘাট, বাঘাবাড়ীর ভাটিতে হুরাসাগর ও যমুনা নদী ছাড়া আর কোথাও ড্রেজিং করা হয় না। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে নৌপথ কমে যাওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে নৌযানের।
দেশে নৌপথ উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ গঠণের মাধ্যমে। এ সময় ৩১ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতায় প্রায় ৭০০ মাইল নৌপথ জরিপ করা হয়। তখন দেশে নদী পথের দৈর্ঘ্য পাঁচ হাজার ৪৮৪ মাইল। ১৯৬৪ সালে নৌ চলাচলের উপযোগী নদী পথের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ হাজার মাইলের বেশি। এ সময় আরিচা-গোয়ালন্দ ও আরিচা-নগরবাড়ী ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। এর পরে পাবনা জেলায় ইছামতি ছাড়া নদী উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি।
১৯৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর সুজানগর ও রাজবাড়ীর মধ্যে ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জৌকুড়া ঘাটের অবস্থা সঙ্কীর্ণ। ১৯২৩ সালে জেনারেল নেভিগেশন রেলওয়ে কোম্পানি পরিচালিত স্টিমার সার্ভিস প্রতিদিন পাবনা ও পাকশীর মধ্যে চলাচল করত। গোয়ালন্দ থেকে ভারতের বিহারের পাটনা পর্যন্ত যে স্টিমার চলাচল করত সেটা বাজিতপুর হয়ে যেত। অপর দিকে যমুনা নদী বেয়ে বেড়ার নগরবাড়ী, ভারেঙ্গা, নাকালিয়া, স্থলচর, সিরাজগঞ্জ ও কালীগঞ্জ হয়ে আসাম প্রদেশে চলে যেত। এই সার্ভিস ছিল নিয়মিত। বাজিতপুর ঘাট থেকে পশ্চিম বাংলার দীঘা পর্যন্ত স্টিমার যাতায়াত করত। পাবনা শহরে বিশ্বাস মোটর সার্ভিস চালু হওয়ায় ঈশ্বরদী সাঁড়াঘাট ও কুষ্টিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রথম ধাক্কা আসে নৌ পরিবহন খাতে।
যমুনা নদী জেলার পূর্ব প্রান্তে ৮০ মাইল সীমান্ত রচনা করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাকে আলাদা করেছে। বর্তমানে অগ্রহায়ণ মাসে যমুনায় বিশাল বিশাল চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। এ নদীতে বার মাস নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিঘ্ন ঘটে। নদীতে নাব্যতা থাকে না বলে স্থানে স্থানে ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হয়। বছরের সব সময় এ নদী দিয়ে বড় মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করতে পারে না। যমুনা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইছামতির ৩০ কিলোমিটার পথ পরিত্যাক্ত হয়ে আছে। আগে বেড়া থেকে ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল কাজীরহাট পাটুরিয়া। জেলার বড়াল, গুমানী ও চন্দ্রাবতীতে বর্ষাকালে মালবাহী নৌকা চলাচল করে। কিন্তু অন্যান্য সময়ে নদীতে পানি থাকে না। ভরাট হয়ে গেছে আত্রাই নদী।
পদ্মা নদী পাবনায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে প্রবাহিত। এ নদীতে আগে স্টিমার, মালবাহী বড় বড় নৌকা যাতায়াত করত। পানির স্তর কমে যাওয়ায় এ নদীতে লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করে না। জেলার বিরাট এলাকাজুড়ে বছরের বেশির ভাগ সময় পানিমগ্ন থাকত। বর্ষাকালে স্বভাবতই প্রায় সব রাস্তাঘাট ডুবে যেত। ১৯৮০ দশকে নৌপথই সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সড়ক পথের তুলনায় নৌপথই জনপ্রিয় ছিল। পদ্মার শাখা নদী ও বিলের ওপর দিয়ে সারা বছর পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। এখন কেবল বর্ষাকালে পণ্যবাহী পানসি, কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করে।

বা/খ:জই

নিউজটি শেয়ার করুন

পাবনার ১৬ নদীর মধ্যে ১২টি মাছের খামার ও ফসলী জমি

আপডেট সময় : ০৭:২০:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০২২

শফিউল আযম :

পাবনার ১৬টি নদীর মধ্যে ১২টি মৎস্য খামার ও ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। ৪টি নদীতে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সঙ্কট। ১৬টি নদীর প্রায় ৫০০ কিলোমিটার নৌপথ ক্রমাগত পলি জমে ভরাট হয়ে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়েছে। এক সময় এ অঞ্চলের নদ-নদীতে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াতো প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আবার অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলার দক্ষিণে পদ্মা, পূর্বে যমুনা উত্তরপ্রান্ত দিয়ে বড়াল ও হুরাসাগর এই ৪টি নদী প্রবাহিত। এসব নদীতে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সঙ্কট। কাকেশ্বরী, সুতিখালী নদী এখন নিষ্কাশন খাল, ইছামতি ও আত্রাই নদী সেচ খালসহ রেগুলেটর নির্মাণ করায় চিকনাই নদী, বাদাই ও অন্যান্য নদী হাইব্রিড মাছের খামার ও ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। এসব নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কাজ ভূগর্ভ নির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। প্রকৃতিতে বিরাজ করছে মরুর রুক্ষতা।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন নৌরুটে লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করত। এখন জেলার নদীপথ বছরব্যাপী সচল থাকে না। নাব্যতা ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্পর্কে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি পর্যায়ে জেলার নদীগুলো সম্পর্কে একটা অদ্ভূত উদাসীন মনোভাব পোষণের কারণে আজ বিপর্যস্ত নৌপথ। প্রায় আট বছর হয়ে গেল কাজীরহাট ঘাটে ফেরি ভিড়ে না। পন্টুন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বেড়ায় নৌবন্দর পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়নের পর পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
নদী পথে যাতায়াত আগের মতোই এখনো সুলভ। প্রতি লিটার জ্বালানীতে নৌপথে ২১৭ টন মালামাল পরিবাহিত হয় এক কিলোমিটার পথ। অথচ সড়ক পথে ডিজেল চালিত ট্রাকে এক লিটার জ্বালানীতে এক টন মালামাল এক কিলোমিটার বহন করা যায়। নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করায় নৌপথ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জেলায় সারা বছর কতটুকু নৌপথ চালু থাকে তারও জরিপ করা হয় না। ১২ মাস পানি থাকে এমন নদী পদ্মা ও যমুনাতে নাব্যতা সঙ্কটে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে মালবাহী জাহাজ।
পাবনা জেলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায় পদ্মা নদীর ৭৫ কিলোমিটার, পূর্ব দিকে যমুনা নদীর ২০ কিলোমিটার, উত্তর দিরে হুরাসাগর নদের আট কিলোমিটার এবং বড়াল নদীর ২৫ কিলোমিটার নদীপথ কোনোমতে টিকে আছে। সামান্য নৌপথ রয়েছে গুমানী নদীতে। রত্নাই, আত্রাই, সুতিখালী, চিকনাই, চন্দ্রাবতী, কাকেশ্বরী, বাদাই ও ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়। শুস্ক মৌসুমে বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসন এসব নদী ইজারা দিয়ে থাকে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে রুকনাই, বারনাই, ট্যাপাগাড়ী, গোহালা, শালিকা, শুটকিদহ ও ভাঙ্গুড়ার ইছামতি নদী। ইছামতি নদীতে ৫০ কিলোমিটার নৌপথ ছিল। চিকনাই ৩৮ কিলোমিটার ও আত্রাই ৩০ কিলোমিটার। এখন এসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বড়াল ও ইছামতি নদীর খাত সাঁথিয়ার বোয়ালমারীর কাছে দ্বিখন্ডিত হয়ে আত্রাই নামে পূর্ব দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে মিলিত হয়। এক সময় আত্রাই নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। বিপুল পলিমাটির অবক্ষেপণে আত্রাই নদী ভরাট হয়ে যায়। জেলায় যাতায়াতের ও একমাত্র উপায় ছিল নদী পথ। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকালে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মান করায় নদী পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার ১২টি নদীপথ ভরাট হয়ে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শুস্ক মৌসুমে বিরাজ করে মরুভূমির মতো অবস্থা।
ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা মিলে বড়াল নদী রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে পানি থাকে না। এ নদীর গভীরতা বর্তমানে তিন মিটার দাঁড়িয়েছে। চার মাসও নৌকা চলে না। গোমানী নদীর নাব্যতা থাকেনা পাঁচটি ঋতুতে। বাঘাবাড়ীর কাছে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুরাসাগর নদ নামে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। বড়াল নদী পথে মিল্কভিটার সদস্যরা দুধ সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে নৌপথ অচল হয়ে পড়ায় তরল দুধ সরবরাহে তাদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে গোহালা নদীকে মধ্যবর্তী একটি চর বিভক্ত করে রাখে। কিন্তু বর্ষাকালে এই চর তলিয়ে গেলে নদী তখন বিভক্ত থাকে না, একত্র হয়ে যায়। তখন নৌযান যাতায়াত বাড়ে।
বর্ষাকালে পাবনার পাট, মাছ, গুড়, গবাদীপশুসহ বিভিন্ন পণ্য এখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একমাত্র বেড়া থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নদী পথের নাব্যতা রক্ষা ও উন্নয়নে কাজীরহাট ঘাট, বাঘাবাড়ীর ভাটিতে হুরাসাগর ও যমুনা নদী ছাড়া আর কোথাও ড্রেজিং করা হয় না। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে নৌপথ কমে যাওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে নৌযানের।
দেশে নৌপথ উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ গঠণের মাধ্যমে। এ সময় ৩১ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতায় প্রায় ৭০০ মাইল নৌপথ জরিপ করা হয়। তখন দেশে নদী পথের দৈর্ঘ্য পাঁচ হাজার ৪৮৪ মাইল। ১৯৬৪ সালে নৌ চলাচলের উপযোগী নদী পথের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ হাজার মাইলের বেশি। এ সময় আরিচা-গোয়ালন্দ ও আরিচা-নগরবাড়ী ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। এর পরে পাবনা জেলায় ইছামতি ছাড়া নদী উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি।
১৯৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর সুজানগর ও রাজবাড়ীর মধ্যে ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জৌকুড়া ঘাটের অবস্থা সঙ্কীর্ণ। ১৯২৩ সালে জেনারেল নেভিগেশন রেলওয়ে কোম্পানি পরিচালিত স্টিমার সার্ভিস প্রতিদিন পাবনা ও পাকশীর মধ্যে চলাচল করত। গোয়ালন্দ থেকে ভারতের বিহারের পাটনা পর্যন্ত যে স্টিমার চলাচল করত সেটা বাজিতপুর হয়ে যেত। অপর দিকে যমুনা নদী বেয়ে বেড়ার নগরবাড়ী, ভারেঙ্গা, নাকালিয়া, স্থলচর, সিরাজগঞ্জ ও কালীগঞ্জ হয়ে আসাম প্রদেশে চলে যেত। এই সার্ভিস ছিল নিয়মিত। বাজিতপুর ঘাট থেকে পশ্চিম বাংলার দীঘা পর্যন্ত স্টিমার যাতায়াত করত। পাবনা শহরে বিশ্বাস মোটর সার্ভিস চালু হওয়ায় ঈশ্বরদী সাঁড়াঘাট ও কুষ্টিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রথম ধাক্কা আসে নৌ পরিবহন খাতে।
যমুনা নদী জেলার পূর্ব প্রান্তে ৮০ মাইল সীমান্ত রচনা করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাকে আলাদা করেছে। বর্তমানে অগ্রহায়ণ মাসে যমুনায় বিশাল বিশাল চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। এ নদীতে বার মাস নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিঘ্ন ঘটে। নদীতে নাব্যতা থাকে না বলে স্থানে স্থানে ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হয়। বছরের সব সময় এ নদী দিয়ে বড় মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করতে পারে না। যমুনা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইছামতির ৩০ কিলোমিটার পথ পরিত্যাক্ত হয়ে আছে। আগে বেড়া থেকে ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল কাজীরহাট পাটুরিয়া। জেলার বড়াল, গুমানী ও চন্দ্রাবতীতে বর্ষাকালে মালবাহী নৌকা চলাচল করে। কিন্তু অন্যান্য সময়ে নদীতে পানি থাকে না। ভরাট হয়ে গেছে আত্রাই নদী।
পদ্মা নদী পাবনায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে প্রবাহিত। এ নদীতে আগে স্টিমার, মালবাহী বড় বড় নৌকা যাতায়াত করত। পানির স্তর কমে যাওয়ায় এ নদীতে লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করে না। জেলার বিরাট এলাকাজুড়ে বছরের বেশির ভাগ সময় পানিমগ্ন থাকত। বর্ষাকালে স্বভাবতই প্রায় সব রাস্তাঘাট ডুবে যেত। ১৯৮০ দশকে নৌপথই সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সড়ক পথের তুলনায় নৌপথই জনপ্রিয় ছিল। পদ্মার শাখা নদী ও বিলের ওপর দিয়ে সারা বছর পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। এখন কেবল বর্ষাকালে পণ্যবাহী পানসি, কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করে।

বা/খ:জই