ঢাকা ০৬:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी
আজকের সেহরি ও ইফতার ::
ঢাকায় সেহেরি ৪:৩৩ মি. ইফতার ৬:১৭ মি.:: চট্টগ্রামে সেহেরি ৪:২৮ মি. ইফতার ৬:১১ মি. :: রাজশাহীতে সেহেরি ৪:৩৯ মি. ইফতার ৬:২৪ মি. :: খুলনায় সেহেরি ৪:৩৭ মি. ইফতার ৬:২০ মি. :: বরিশালে সেহেরি ৪:৩৪ মি. ইফতার ৬:১৭ মি. :: সিলেটে সেহেরি ৪:২৬ মি. ইফতার ৬:১১ মি. :: রংপুরে সেহেরি ৪:৩৭ মি. ইফতার ৬:২২ মি. :: ময়মনসিংহে সেহেরি ৪:৩২ মি. ইফতার ৬:১৭ মি. ::::

শাহজাদপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-০১ ‘নবরত্ন মন্দির ও জমিদার বাড়ি’

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:২০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪৯৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মো: শামছুর রহমান শিশিরঃ
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চিরসবুজের সমারোহ সমৃদ্ধগাঁথা ঐতিহাসিক একটি গ্রাম পোতাজিয়া। প্রাচীন প্রত্নতত্ব নিদর্শন ছাড়াও সবুজের সমারোহ এ গ্রামে রয়েছে হাকিমিয়া আফছারিয়া খানকাহ শরীফ, ইউপি বোর্ড, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,উচ্চ বিদ্যালয়, শত শত গরুর খামার। পোতাজিয়া গ্রামটি খন্ড খন্ড দ্বীপের মতো। এক একটি খন্ড খন্ড দ্বীপ এলাকায় কয়েকটি পরিবারের বসবাস আর তার চারদিক পানি দিয়ে ঘেরা। বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের শাহজাদপুর উপজেলার দিলরুবা বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় নেমে রিক্সায় যেতে পারবেন এ গ্রামে। এ গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মোহনের বাড়ীর কিছু পশ্চিমে পদব্রজে গেলেই দেখা মিলবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তি নবরত্ন মন্দিরের ভগ্নাংশ যা কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এর আশেপাশের বহু শিব মন্দির, দ্বো-চালা মন্দির থাকলেও তা ভেঙ্গে বসতভিটা নির্মাণ করেছে অনেকেই। নবরত্ন মন্দিরের ভগ্নবিশেষের সামনে দাঁড়ালেই পরিলক্ষিত হয় এক সময়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক এ তীর্থস্থান ।

কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, শপ্তাদশ শতাব্দীর কোন এক সময় নির্মাণ করা হয়েছিল এ মন্দিরটি। এই মন্দিরের আদলে পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমড়–ল এলাকায় রয়েছে আরও একটি মন্দির।এলাকাবাসীর ধারনা উল্লাপাড়ার নবরত্ন মন্দিরের চেয়ে পোতাজিয়ার নবরত্ন মন্দিরটি আরও অনেক পুরানো। এ মন্দিরটির কক্ষ, দরজা, জানালা বর্তমানে কিছুই নেই। মন্দিরটির ভগ্নাংশ কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিপট থেকে। মন্দিরটির ৯টি কক্ষে পূঁজা অর্চনা করার ফলে এ মন্দিরটির নামকরণ করা হয়েছিল নবরত্ন মন্দির। মন্দিরটি চুন সুড়কির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছিল। পোড়া মাটির ইট দ্বারা তৈরি মন্দিরের ফলকে ছিল হিন্দুদের অবতার রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য, রাবণের রথ চালনা, গদা হাতে বিষনু, অবতার হনুমানের বীরত্ব ও কিন্নরীর চিত্র দরজার পিলারগুলোতে কারুকাজ করা ছিল যা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত প্রায়। এছাড়া পোড়ামাটির অপরূপ শিল্পকর্মের মধ্যে ছিল গ্রামীণ নারীর অসংযত যৌবন, মাতৃত্ব এবং লোকজ নানা চিত্র, ফুল ও লতাপাতার নকশা যা দীর্ঘ সময় ধরে অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা গুপ্তধনের আশায় আশেপাশে ও ভিতরের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। এছাড়া বট পাকুড়ের গাছ ও শেওলা জন্মিয়েছে ভগ্নাংশে। পাকিস্থান শাষনামলে মন্দিরটি পুরাকীর্তি হিসাবে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরবর্তীতে কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় ঐতিহাসিক এ স্মৃতিচিহ্নটি বিলুপ্তির পথে।এ গ্রামে একাধিক শিব মন্দির, দ্বো-চালা মন্দির ছিল। পর্যায়ক্রমে তা ভেঙ্গে বসতবাড়ী নির্মিত হয়েছে। তবে আজও ওইসব যায়গায় অনুসন্ধান করলে অসংখ্য পুরাকীর্তির অস্তিত্ব মিলবে।

শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত সুপ্রাচীন কালের চাকী জমিদার বাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় ক্রমেই ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এর অধিকাংশ জায়গাজমি দেখা শোনার অভাবে বেহাত হয়ে পড়েছে। এলাকার প্রভাবশালীরা বাড়িটির অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। ঝোঁপ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে জমিদার বাড়িটির একতলার ভবন। প্রায় ৩শ’ বছরের পুরানো এ বাড়িটি ১৮১৫ সালের দিকে তৎকালীন জমিদার দ্বারকানাথ চাকী এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। এ বাড়িটির দক্ষিণে শানবাধা বিশালাকৃতির পুকুর ছিল। এ ছাড়া পূর্ব প্রান্তে লক্ষী, নারায়ণ ও কালি মন্দিরের পাশে বিশাল আকৃতির আট চালা নাট মন্দির ছিল। এই নাট মন্দিরে প্রতি বছর লীলাকীত্তন, নাম কীত্তন, বেহুলা পালা, রামায়ন, মহাভারত, গাজীর গান, জারিগান, রাধাকৃষ্ণর পালা পরিবেশন করা হত। ১৯ বিঘা জমির উপরে নির্মিত এ বাড়িটির চারধারে আম কাঁঠালের বাগান ছিল। বাড়িটির সামনের অংশে বিশালাকৃতির একটি হল ঘর ছিলো। এ ডানে বামে ছোট ছোট দুটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া বাড়ির চারপাশে থাকার বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। এ সব কক্ষের দরজা জানালার অলঙ্কারিক কাজ দর্শনার্থীদের সহজেই মন কাড়তো। এছাড়া ভবটির কার্নিশের পেরাপেট অলঙ্কার এবং লতাপাতা খচিত অলঙ্করন কাজ সবাইকে মুগ্ধ করতো। ভবনটির দুপাশে বিশাল আকৃতির দুটি বারান্দা রয়েছে। বারান্দার থাম গুলি সুদৃশ্য নকশায় নির্মিত। বর্তমানে মূল ভবন বাদে আর সমস্ত জায়গায়ই বেদখল হয়ে গেছে। প্রত্নতাত্বিক এই নির্দশনটি কি করে লিজ দেওয়া হল তা কেউ বলতে পারেনি। দ্বারকানাথ চাকীর জমিদারিটি খুব একটা বড় ছিল না। পারকোলা, যুগ্নিদহ, বাচামারা ও বাতিয়া গ্রাম নিয়ে অবস্থিত ছিল। তার মৃত্যুর পর বাড়িটি উত্তরাধিকার সূত্রে তার দুইছেলে তারকনাথ চাকী ও অর্ধেন্দুনাথ চাকীর হস্তগত হয়। এরপর ১৯৩৫ সালে তারকনাথ চাকীর মৃত্যুর পর বাড়িটি তার ছেলে বাচ্চু চাকীর হস্তগত হয়। এছাড়া অর্ধেন্দুনাথ চাকী ছিলেন একজন ডাক্তার। ১৯৪৭ সালের দিকে তার সবাই পেশাগত কারণেকলকাতার শিলিগুরী চলে যান। তখন থেকে এ বাড়িটিতে তারকনাথের স্ত্রী ও বাচ্চু চাকী বাস করেন। এরপর ১৯৬৫ সালের দিকে বাচ্চু চাকী অসুস্থ হয়ে পড়লে তারাও কলকাতা চলে যান। এরপর বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব পান তারকনাথের ফুফাত ভাই অখিল চাকী। তার মৃত্যুর পরে বাড়িটি অবিভাবক শূন্য হয়েপড়ে। সেই থেকে এ বাড়িটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় দিন দিন বাড়িটির আশপাশ এলাকা প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। কালি মন্দির, লক্ষী মন্দির ও নাট মন্দিরের জায়গায় মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া আশপাশের জায়গা দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরশাদ সরকারের শাসন আমলে এ বাড়িটির সামনের অংশ দখল করে গুচ্ছ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২২ টি পরিবারকে সেখানে বসবাস করতে দেয়া হয়। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির অধিগ্রহণ করে সংরক্ষনের ব্যবস্থা না করায় কালের স্বাক্ষী এ জমিদার বাড়িটিও ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, শাহজাদপুরের শুধু চাকী জমিদার বাড়ি নয় এমন বহু জমিদার বাড়ি ও বহু পুরাতন স্থাপনা সংস্কারের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের আগ্রাসনে ওইসব স্থাপনার স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। অনেকে গায়ের জোড়ে আবার অনেকে দখলদারিত্বের মাধ্যমে আবার কেউ বা লিজ নিয়ে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ওইসব প্রাচীন স্থান দখল করে চলেছে। ইতিহাসের স্বাক্ষী বহনকারী ওইসব বহু পুরাতন স্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন কারুশৈলী পরিলক্ষিত হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়ায় দখলদারদের কবলে তা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে,গোহালে নেই’-এ অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে।

বৃটিশ আমলের পুরাকীর্তি হিসাবে জমিদার নীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ীটি আজও পুরাতন ঐহিত্য বহন করে চলেছে। ১৯৭৬ সালে জমিদার নীরেন্দ্রনাথ রায় সরকার পাড়ায় মৃত জুলমত শেখ বরাবর পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ এ বাড়িটি উইল করে দিয়ে স্বপরিবারে ভারতে যান বলে জানা যায়। জমিদারবাবুর ঐহিত্যবাহী পুরাতন জমিদার বাড়ী আজও বুকে আগলে রেখেছেন মৃত জুলমত শেখের বংশধর আব্দুর রহমান। বাড়িটির পূর্ব দিকের অংশ ধ্বসে গেছে। কোন রকমে সংস্কার করে ঝুঁকি নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন আব্দুর রহমান। এ বাড়িটিও চুন সুড়কি দিয়ে তৈরি। এর ভেতরে রয়েছে বেশ কটি কক্ষ। বাড়িটির দিকে তাকালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম আজও সবাইকে মুগ্ধ করে। পোতাজিয়ার সরকার পাড়ায় থাকতেন জমিদার নীর্মল চক্রবর্তীর উত্তর বংশধর। বৃটিশ শাষনামলে তৈরি এ বাড়িটির বিভিন্ন স্থানের কারুশৈলী সবাইকে মুগ্ধ করে। ০.৬৯ একর জমির ওপর নির্মিত এ জমিদার বাড়িটি ১৯৬৯ সালে জমিদারবাবু এ গ্রামের লালচাঁদ প্রামানিকের চার ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যান বলে এলাকাবাসী জানায়। বর্তমানে আবুল হোসেনের বংশধর আব্দুল কাদের পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এ বাড়িটি বুকে আগলে আজও সেখানে বসবাস করছেন।এ জমিদারবাড়ীটির পোড়ামাটির শিল্পকর্ম বেশ দৃষ্টিনন্দন। শাহজাদপুর পৌরসদরের সরকারি কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত ভবাণী চরণ পালের জমিদারবাড়ীও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শাহজাদপুরের দ্বারিয়াপুর মৌজার এসএস দাগঃ ৫৬৭২, এসএ খতিয়ানঃ ১৯০৫ সম্পত্তি জমিদার ভবাণী চরন পাল মারা গেলে তার পুত্র নরেশ চন্দ্র পালসহ তার ওয়ারিশদের নামে এসএ রেকর্ডভুক্ত হয়। পরে জমিদার নরেশ চন্দ্র পাল স্বপরিবারে ভারত চলে গেছে তার এ সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের নামে রেকর্ডভূক্তির মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্তি হয়। পাল জমিদারবাড়ীর মূল ভবনটি সোনালী ব্যাংকের অনূকুলে স্থায়ী বন্দোবস্তো এবং কতিপয় লেছীগণের মধ্যে বন্দোবস্তো দেওয়া হয়। এ জমিদার বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলে সেখানে সোনালী ব্যাংকের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব জমিদারবাড়ী ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রত্নত্তাত্বিক নানা নিদর্শন যা সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে স্মৃতিাপট থেকে।

সরকারিভাবে উদ্যোগে নেয়া হলে ঐতিহাসিক এসব পূরাকীর্তির অংশবিশেষ এখনও উদ্ধার এবং সংরক্ষণ সম্ভব বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন।

 

 

The short URL of the present article is: https://banglakhaborbd.com/0mcd

নিউজটি শেয়ার করুন

শাহজাদপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-০১ ‘নবরত্ন মন্দির ও জমিদার বাড়ি’

আপডেট সময় : ০৯:২০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ অক্টোবর ২০২২

মো: শামছুর রহমান শিশিরঃ
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চিরসবুজের সমারোহ সমৃদ্ধগাঁথা ঐতিহাসিক একটি গ্রাম পোতাজিয়া। প্রাচীন প্রত্নতত্ব নিদর্শন ছাড়াও সবুজের সমারোহ এ গ্রামে রয়েছে হাকিমিয়া আফছারিয়া খানকাহ শরীফ, ইউপি বোর্ড, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,উচ্চ বিদ্যালয়, শত শত গরুর খামার। পোতাজিয়া গ্রামটি খন্ড খন্ড দ্বীপের মতো। এক একটি খন্ড খন্ড দ্বীপ এলাকায় কয়েকটি পরিবারের বসবাস আর তার চারদিক পানি দিয়ে ঘেরা। বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের শাহজাদপুর উপজেলার দিলরুবা বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় নেমে রিক্সায় যেতে পারবেন এ গ্রামে। এ গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মোহনের বাড়ীর কিছু পশ্চিমে পদব্রজে গেলেই দেখা মিলবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তি নবরত্ন মন্দিরের ভগ্নাংশ যা কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এর আশেপাশের বহু শিব মন্দির, দ্বো-চালা মন্দির থাকলেও তা ভেঙ্গে বসতভিটা নির্মাণ করেছে অনেকেই। নবরত্ন মন্দিরের ভগ্নবিশেষের সামনে দাঁড়ালেই পরিলক্ষিত হয় এক সময়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক এ তীর্থস্থান ।

কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, শপ্তাদশ শতাব্দীর কোন এক সময় নির্মাণ করা হয়েছিল এ মন্দিরটি। এই মন্দিরের আদলে পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমড়–ল এলাকায় রয়েছে আরও একটি মন্দির।এলাকাবাসীর ধারনা উল্লাপাড়ার নবরত্ন মন্দিরের চেয়ে পোতাজিয়ার নবরত্ন মন্দিরটি আরও অনেক পুরানো। এ মন্দিরটির কক্ষ, দরজা, জানালা বর্তমানে কিছুই নেই। মন্দিরটির ভগ্নাংশ কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিপট থেকে। মন্দিরটির ৯টি কক্ষে পূঁজা অর্চনা করার ফলে এ মন্দিরটির নামকরণ করা হয়েছিল নবরত্ন মন্দির। মন্দিরটি চুন সুড়কির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছিল। পোড়া মাটির ইট দ্বারা তৈরি মন্দিরের ফলকে ছিল হিন্দুদের অবতার রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য, রাবণের রথ চালনা, গদা হাতে বিষনু, অবতার হনুমানের বীরত্ব ও কিন্নরীর চিত্র দরজার পিলারগুলোতে কারুকাজ করা ছিল যা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত প্রায়। এছাড়া পোড়ামাটির অপরূপ শিল্পকর্মের মধ্যে ছিল গ্রামীণ নারীর অসংযত যৌবন, মাতৃত্ব এবং লোকজ নানা চিত্র, ফুল ও লতাপাতার নকশা যা দীর্ঘ সময় ধরে অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা গুপ্তধনের আশায় আশেপাশে ও ভিতরের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। এছাড়া বট পাকুড়ের গাছ ও শেওলা জন্মিয়েছে ভগ্নাংশে। পাকিস্থান শাষনামলে মন্দিরটি পুরাকীর্তি হিসাবে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরবর্তীতে কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় ঐতিহাসিক এ স্মৃতিচিহ্নটি বিলুপ্তির পথে।এ গ্রামে একাধিক শিব মন্দির, দ্বো-চালা মন্দির ছিল। পর্যায়ক্রমে তা ভেঙ্গে বসতবাড়ী নির্মিত হয়েছে। তবে আজও ওইসব যায়গায় অনুসন্ধান করলে অসংখ্য পুরাকীর্তির অস্তিত্ব মিলবে।

শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত সুপ্রাচীন কালের চাকী জমিদার বাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় ক্রমেই ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এর অধিকাংশ জায়গাজমি দেখা শোনার অভাবে বেহাত হয়ে পড়েছে। এলাকার প্রভাবশালীরা বাড়িটির অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। ঝোঁপ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে জমিদার বাড়িটির একতলার ভবন। প্রায় ৩শ’ বছরের পুরানো এ বাড়িটি ১৮১৫ সালের দিকে তৎকালীন জমিদার দ্বারকানাথ চাকী এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। এ বাড়িটির দক্ষিণে শানবাধা বিশালাকৃতির পুকুর ছিল। এ ছাড়া পূর্ব প্রান্তে লক্ষী, নারায়ণ ও কালি মন্দিরের পাশে বিশাল আকৃতির আট চালা নাট মন্দির ছিল। এই নাট মন্দিরে প্রতি বছর লীলাকীত্তন, নাম কীত্তন, বেহুলা পালা, রামায়ন, মহাভারত, গাজীর গান, জারিগান, রাধাকৃষ্ণর পালা পরিবেশন করা হত। ১৯ বিঘা জমির উপরে নির্মিত এ বাড়িটির চারধারে আম কাঁঠালের বাগান ছিল। বাড়িটির সামনের অংশে বিশালাকৃতির একটি হল ঘর ছিলো। এ ডানে বামে ছোট ছোট দুটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া বাড়ির চারপাশে থাকার বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। এ সব কক্ষের দরজা জানালার অলঙ্কারিক কাজ দর্শনার্থীদের সহজেই মন কাড়তো। এছাড়া ভবটির কার্নিশের পেরাপেট অলঙ্কার এবং লতাপাতা খচিত অলঙ্করন কাজ সবাইকে মুগ্ধ করতো। ভবনটির দুপাশে বিশাল আকৃতির দুটি বারান্দা রয়েছে। বারান্দার থাম গুলি সুদৃশ্য নকশায় নির্মিত। বর্তমানে মূল ভবন বাদে আর সমস্ত জায়গায়ই বেদখল হয়ে গেছে। প্রত্নতাত্বিক এই নির্দশনটি কি করে লিজ দেওয়া হল তা কেউ বলতে পারেনি। দ্বারকানাথ চাকীর জমিদারিটি খুব একটা বড় ছিল না। পারকোলা, যুগ্নিদহ, বাচামারা ও বাতিয়া গ্রাম নিয়ে অবস্থিত ছিল। তার মৃত্যুর পর বাড়িটি উত্তরাধিকার সূত্রে তার দুইছেলে তারকনাথ চাকী ও অর্ধেন্দুনাথ চাকীর হস্তগত হয়। এরপর ১৯৩৫ সালে তারকনাথ চাকীর মৃত্যুর পর বাড়িটি তার ছেলে বাচ্চু চাকীর হস্তগত হয়। এছাড়া অর্ধেন্দুনাথ চাকী ছিলেন একজন ডাক্তার। ১৯৪৭ সালের দিকে তার সবাই পেশাগত কারণেকলকাতার শিলিগুরী চলে যান। তখন থেকে এ বাড়িটিতে তারকনাথের স্ত্রী ও বাচ্চু চাকী বাস করেন। এরপর ১৯৬৫ সালের দিকে বাচ্চু চাকী অসুস্থ হয়ে পড়লে তারাও কলকাতা চলে যান। এরপর বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব পান তারকনাথের ফুফাত ভাই অখিল চাকী। তার মৃত্যুর পরে বাড়িটি অবিভাবক শূন্য হয়েপড়ে। সেই থেকে এ বাড়িটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় দিন দিন বাড়িটির আশপাশ এলাকা প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। কালি মন্দির, লক্ষী মন্দির ও নাট মন্দিরের জায়গায় মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া আশপাশের জায়গা দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরশাদ সরকারের শাসন আমলে এ বাড়িটির সামনের অংশ দখল করে গুচ্ছ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২২ টি পরিবারকে সেখানে বসবাস করতে দেয়া হয়। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির অধিগ্রহণ করে সংরক্ষনের ব্যবস্থা না করায় কালের স্বাক্ষী এ জমিদার বাড়িটিও ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, শাহজাদপুরের শুধু চাকী জমিদার বাড়ি নয় এমন বহু জমিদার বাড়ি ও বহু পুরাতন স্থাপনা সংস্কারের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের আগ্রাসনে ওইসব স্থাপনার স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। অনেকে গায়ের জোড়ে আবার অনেকে দখলদারিত্বের মাধ্যমে আবার কেউ বা লিজ নিয়ে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ওইসব প্রাচীন স্থান দখল করে চলেছে। ইতিহাসের স্বাক্ষী বহনকারী ওইসব বহু পুরাতন স্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন কারুশৈলী পরিলক্ষিত হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়ায় দখলদারদের কবলে তা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে,গোহালে নেই’-এ অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে।

বৃটিশ আমলের পুরাকীর্তি হিসাবে জমিদার নীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ীটি আজও পুরাতন ঐহিত্য বহন করে চলেছে। ১৯৭৬ সালে জমিদার নীরেন্দ্রনাথ রায় সরকার পাড়ায় মৃত জুলমত শেখ বরাবর পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ এ বাড়িটি উইল করে দিয়ে স্বপরিবারে ভারতে যান বলে জানা যায়। জমিদারবাবুর ঐহিত্যবাহী পুরাতন জমিদার বাড়ী আজও বুকে আগলে রেখেছেন মৃত জুলমত শেখের বংশধর আব্দুর রহমান। বাড়িটির পূর্ব দিকের অংশ ধ্বসে গেছে। কোন রকমে সংস্কার করে ঝুঁকি নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন আব্দুর রহমান। এ বাড়িটিও চুন সুড়কি দিয়ে তৈরি। এর ভেতরে রয়েছে বেশ কটি কক্ষ। বাড়িটির দিকে তাকালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম আজও সবাইকে মুগ্ধ করে। পোতাজিয়ার সরকার পাড়ায় থাকতেন জমিদার নীর্মল চক্রবর্তীর উত্তর বংশধর। বৃটিশ শাষনামলে তৈরি এ বাড়িটির বিভিন্ন স্থানের কারুশৈলী সবাইকে মুগ্ধ করে। ০.৬৯ একর জমির ওপর নির্মিত এ জমিদার বাড়িটি ১৯৬৯ সালে জমিদারবাবু এ গ্রামের লালচাঁদ প্রামানিকের চার ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যান বলে এলাকাবাসী জানায়। বর্তমানে আবুল হোসেনের বংশধর আব্দুল কাদের পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এ বাড়িটি বুকে আগলে আজও সেখানে বসবাস করছেন।এ জমিদারবাড়ীটির পোড়ামাটির শিল্পকর্ম বেশ দৃষ্টিনন্দন। শাহজাদপুর পৌরসদরের সরকারি কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত ভবাণী চরণ পালের জমিদারবাড়ীও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শাহজাদপুরের দ্বারিয়াপুর মৌজার এসএস দাগঃ ৫৬৭২, এসএ খতিয়ানঃ ১৯০৫ সম্পত্তি জমিদার ভবাণী চরন পাল মারা গেলে তার পুত্র নরেশ চন্দ্র পালসহ তার ওয়ারিশদের নামে এসএ রেকর্ডভুক্ত হয়। পরে জমিদার নরেশ চন্দ্র পাল স্বপরিবারে ভারত চলে গেছে তার এ সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের নামে রেকর্ডভূক্তির মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্তি হয়। পাল জমিদারবাড়ীর মূল ভবনটি সোনালী ব্যাংকের অনূকুলে স্থায়ী বন্দোবস্তো এবং কতিপয় লেছীগণের মধ্যে বন্দোবস্তো দেওয়া হয়। এ জমিদার বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলে সেখানে সোনালী ব্যাংকের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব জমিদারবাড়ী ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রত্নত্তাত্বিক নানা নিদর্শন যা সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে স্মৃতিাপট থেকে।

সরকারিভাবে উদ্যোগে নেয়া হলে ঐতিহাসিক এসব পূরাকীর্তির অংশবিশেষ এখনও উদ্ধার এবং সংরক্ষণ সম্ভব বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন।

 

 

The short URL of the present article is: https://banglakhaborbd.com/0mcd