ঢাকা ১২:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी
আজকের সেহরি ও ইফতার ::
ঢাকায় সেহেরি ৪:৩৩ মি. ইফতার ৬:১৭ মি.:: চট্টগ্রামে সেহেরি ৪:২৮ মি. ইফতার ৬:১১ মি. :: রাজশাহীতে সেহেরি ৪:৩৯ মি. ইফতার ৬:২৪ মি. :: খুলনায় সেহেরি ৪:৩৭ মি. ইফতার ৬:২০ মি. :: বরিশালে সেহেরি ৪:৩৪ মি. ইফতার ৬:১৭ মি. :: সিলেটে সেহেরি ৪:২৬ মি. ইফতার ৬:১১ মি. :: রংপুরে সেহেরি ৪:৩৭ মি. ইফতার ৬:২২ মি. :: ময়মনসিংহে সেহেরি ৪:৩২ মি. ইফতার ৬:১৭ মি. ::::

পাবনায় গার্মেন্ট ঝুটে তৈরি পোষাক যাচ্ছে ভারতের ৫ রাজ্যে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:০৯:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ ২০২৩
  • / ৪৫১ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি :

পাবনার হোসিয়ারি কারখানাগুলোতে ঝুঁটের (গার্মেন্ট কারখানার নমুনা কাটিং, মিল ডিফেক্টসহ পরিত্যক্ত কাপড়) তৈরি পেষাক চাহিদা দিন দিন দেশে বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লিতে পোষাক রফতানি হচ্ছে। ভারতের এই পাঁচ রাজ্যের আমদানিকারকরা পাবনা থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের ৬০ লাখ ৪৮ হাজার পিস ঝুটের তৈরি পোষাক ক্রয় করছেন। এতে জেলার বন্ধ হোসিয়ায়ারি শিল্প ফিরে পেয়েছে হারানো ঐতিহ্য। সেই সাথে এ শিল্পে হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ঝুটের তৈরি পেষাক পাবনা থেকে ভারতে রফতানি শুরু হয়। তখন প্রতি মাসে এক ট্রাক পোষাক (৭২ হাজার পিস) রফতানি হতো। ধীরে ধীরে চাহিদা ও রফতানি পরিমান বাড়তে থাকে। বর্তমানে (২০১৯ সালে) ভারতের মালদাহর অজিত দত্ত, পাটনার তানভির আলম, শিলিগুড়ির সেলিম খাঁন, মুর্শিদাবাদের বাবু মিয়াসহ ১২ জন আমদানিকারক পাবনা থেকে প্রতিমাসে গড়ে (সাত ট্রাক) পাঁচ লাখ চার হাজার পিস, সেই হিসেবে বছরে (৮৪ ট্রাক) প্রায় ৬০ লাখ ৪৮ হাজার পিস পোষাক ক্রয় করে নিজ দেশে নিচ্ছেন।

এছাড়া ঢাকা, গাজিপুর, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাং থেকে প্রতি বছর আরো এক হাজার ২০০ ট্রাক অর্থৎ আট কোটি ৬৪ লাখ পিস ঝুটের তৈরি পোষাক ভারতের আমদানিকারকরা ক্রয় করছেন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। পরে আমদানিকারকরা এসব পোষাক পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, দিল্লি ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন জেলার নামিদামি শপিংমল, বিপনী বিতানসহ ছোট-বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। হাওড়া জেলার হাওড়াহাটে পাবনার ঝুট পোষাকের বিশাল পাইকারী বাজার গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন, মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত।

ব্রিটিশ আমল থেকে হোসিয়ারি শিল্প পাবনার অর্থনীতিকে ধরে রেখেছিল। ষাট দশক পর্যন্ত এ শিল্প ভালোভাবে চলে, কিন্তু সত্তর দশকে কিছুটা ভাটা পড়ে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে হোসিয়ারি শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাবনার হোসিয়ারিতে তৈরি গেঞ্জির যথেষ্ট কদর ছিল। পাবনার তৈরি গেঞ্জি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হতো। ফলে ধীরে ধীরে পাবনায় বড় বড় গেঞ্জির কারখানা গড়ে ওঠে। মোমেনা হোসিয়ারি, সুলতান হোসিয়ারি, খাঁন হোসিয়ারিসহ বিভিন্ন হোসিয়ারি কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতো। হোসিয়ারি শিল্প থেকে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো, অপরদিকে এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক তাদের জীবিকা নির্বাহ করত।

বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান আদমজী অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার আদম খাঁন প্রথম পাবনাতে সুতার ব্যবসা শুরু করেন। তাদের কাছ থেকে সুতা খরিদ করে পাবনার হোসিয়ারি কারখানার মালিকরা গেঞ্জি উৎপাদন করতো। নৌপথে রফতানি সুবিধার কারনে উৎপাদিত পণ্য রফতানির সহজ উপায় হিসেবে এক সময় তাদের ব্যবসা নারায়নগঞ্জে স্থানান্তর করে। পাবনার ব্যবসা সীমিত আকারে থাকে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আদম খাঁনের পাবনার হোসিয়ারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সুতার অভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা ব্যবসা পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে থাকেন। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে হোসিয়ারি শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পাবনার অর্থনীতিতে ধস নামে। বেকার হয়ে পড়ে এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার দক্ষ অদক্ষ শ্রমিক। ঝুট ব্যবসার প্রচলন হওয়ায় হোসিয়ায়ারি শিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পায়। এ শিল্পে হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

১৯৯৫ সালের দিকে পাবনায় ঝুট ব্যবসার প্রচলন ঘটে। প্রথমদিকে সীমিত আকারে পরীক্ষামূলকভাবে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিয়ে ঝুট শিল্পের ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসায় কিছু শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কাপড়ের ও গার্মেন্ট কারখানা থেকে নমুনা কাটিংয়ের কাপড়, মিল ডিফেক্টসহ পরিত্যক্ত কাপড় মিল থেকে কম দামে কিনে এনে কাটাছেঁড়া বাদ দিয়ে নানা রকম পোষাক তৈরি শুরু করেন। এক সময় এসব কাটিং ঝুঁট আবর্জনা হিসেবে ফেলে বা পুড়িয়ে দেয়া হতো। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব গার্মেন্ট ঝুটের পোষাক জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে ফেরি করে বিক্রি করা হতো। অন্যান্য পোষাকের তুলনায় ঝুঁটের তৈরি পোষাক রুচিশীল টেকসই, গুনেমানে ভাল ও দাম অনেকটা কম হওয়ায় এই পোষাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।।

দাম কম হওয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষেরা এসব পণ্যের ক্রেতা ছিল। ধীরে ধীরে পাবনার গন্ডি পেরিয়ে ঝুট পণ্য পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ভালো সাফল্যের ফলে অন্য ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। সম্ভাবনা জেগে ওঠে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক নতুন শিল্পের। এক সময়ে ঝুটের তৈরি পোষাক গরিব শিশু কিশোরদের পোশাক হিসেবে পরিচিত হলেও আজ নানা বৈচিত্রের কারণে বিভিন্ন শ্রেনীর শিশু, কিশোর ও যুবকদের গায়ে শোভা পাচ্ছে।

পুঁজি বিনিয়োগের তুলনায় আয় বেশি হওয়ার কারণে বর্তমানে পাবনায় এক হাজার ৯০০ ছোট-বড় ঝুট শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। কয়েকটি মেশিন, একটি শো রুম ও সামান্য পুঁজি হলেই এ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা যায়। পাবনার তৈরি গেঞ্জির চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন এ ব্যবসায়ে। প্রতি সপ্তাহে নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা পাবনা থেকে ঝুটের তৈরি পোষাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাবনায় হোসিয়ারী শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। হাজার হাজার দক্ষ অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভারতের মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, তিনি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার পৌর সদরের কর্মকারপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। বেড়াতেই তার বেড়ে ওঠা। প্রথমে ছোটখাট ব্যবসা করতেন। পরে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। ভারত থেকে চাল, গমসহ ভূসিমাল আমদানি করতেন। প্রায় ২০ বছর আগে ভারতে পাড়ি জমান। পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসা শুরু করেন। পরে মাদাহ জেলায় ব্যবসা সম্প্রসারিত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আমাদানি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এম এম ইন্টারন্যাশনাল। অজিত দত্ত ১৯৯৮ সালে প্রথম পাবনা থেকে ঝুটের তৈরি পোষাক ভারতে রফতানি শুরু করেন। তখন প্রতি মাসে এক ট্রাক করে পোষাক নিতেন। এখন ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক প্রতি মাসে পাবনা থেকে ছয় ট্রাক গাজিপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাং থেকে ১০০ ট্রাক গার্মেন্ট ঝুটে তৈরি পেষাক ভারতে পাঠাচ্ছেন। সেখানে তারা এ পণ্য বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দামে বিক্রি করছেন।

তিনি বলেন, গাজিপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাংয়ের উন্নতমানের গেঞ্জি ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লি রাজ্যের বিভিন্ন নামিদামি শপিংমল ও বিপনি বিতানগুলোতে বিক্রি হয়। কলকাতা, ডালখোলা, খড়কপুর, মাদাহ, মুর্শিদাবাদ, ভগবানগোলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট ছোট পাইকার ও খুচরা দোকানিদের কাছে পাবনার ঝুটের তৈরি পেষাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাবনার ঝুঁটের তৈরি পোষাক গুনেমানে ভাল, মোলায়েম ও দামে কম হওয়ায় ভারতের মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেনীর শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হাওড়া জেলার হাওড়াহাটে পাবনার ঝুটের তৈরি পেষাকের বিশাল পাইকারী বাজার রয়েছে বলে অজিত দত্ত জানান।

পাবনার ঝুট ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ জানান, সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় শ্রমিক দ্বারা তৈরি এ পণ্যটির চাহিদা দিন দিন দেশে বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুট শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে বহিবির্শ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে কমমুল্যে এ পন্য রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের আমদানিকারকরা পাবনা থেকে এ পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণীর লোকের মাঝে ঝুটের তৈরি পোষাকের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশে বিদেশে চাহিদার ফলে জেলার অন্য ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসায়ে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।

বা/খ: এসআর।

The short URL of the present article is: https://banglakhaborbd.com/tj1a

নিউজটি শেয়ার করুন

পাবনায় গার্মেন্ট ঝুটে তৈরি পোষাক যাচ্ছে ভারতের ৫ রাজ্যে

আপডেট সময় : ১২:০৯:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ ২০২৩

শফিউল আযম, বিশেষ প্রতিনিধি :

পাবনার হোসিয়ারি কারখানাগুলোতে ঝুঁটের (গার্মেন্ট কারখানার নমুনা কাটিং, মিল ডিফেক্টসহ পরিত্যক্ত কাপড়) তৈরি পেষাক চাহিদা দিন দিন দেশে বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লিতে পোষাক রফতানি হচ্ছে। ভারতের এই পাঁচ রাজ্যের আমদানিকারকরা পাবনা থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের ৬০ লাখ ৪৮ হাজার পিস ঝুটের তৈরি পোষাক ক্রয় করছেন। এতে জেলার বন্ধ হোসিয়ায়ারি শিল্প ফিরে পেয়েছে হারানো ঐতিহ্য। সেই সাথে এ শিল্পে হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ঝুটের তৈরি পেষাক পাবনা থেকে ভারতে রফতানি শুরু হয়। তখন প্রতি মাসে এক ট্রাক পোষাক (৭২ হাজার পিস) রফতানি হতো। ধীরে ধীরে চাহিদা ও রফতানি পরিমান বাড়তে থাকে। বর্তমানে (২০১৯ সালে) ভারতের মালদাহর অজিত দত্ত, পাটনার তানভির আলম, শিলিগুড়ির সেলিম খাঁন, মুর্শিদাবাদের বাবু মিয়াসহ ১২ জন আমদানিকারক পাবনা থেকে প্রতিমাসে গড়ে (সাত ট্রাক) পাঁচ লাখ চার হাজার পিস, সেই হিসেবে বছরে (৮৪ ট্রাক) প্রায় ৬০ লাখ ৪৮ হাজার পিস পোষাক ক্রয় করে নিজ দেশে নিচ্ছেন।

এছাড়া ঢাকা, গাজিপুর, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাং থেকে প্রতি বছর আরো এক হাজার ২০০ ট্রাক অর্থৎ আট কোটি ৬৪ লাখ পিস ঝুটের তৈরি পোষাক ভারতের আমদানিকারকরা ক্রয় করছেন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। পরে আমদানিকারকরা এসব পোষাক পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, দিল্লি ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন জেলার নামিদামি শপিংমল, বিপনী বিতানসহ ছোট-বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। হাওড়া জেলার হাওড়াহাটে পাবনার ঝুট পোষাকের বিশাল পাইকারী বাজার গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন, মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত।

ব্রিটিশ আমল থেকে হোসিয়ারি শিল্প পাবনার অর্থনীতিকে ধরে রেখেছিল। ষাট দশক পর্যন্ত এ শিল্প ভালোভাবে চলে, কিন্তু সত্তর দশকে কিছুটা ভাটা পড়ে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে হোসিয়ারি শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাবনার হোসিয়ারিতে তৈরি গেঞ্জির যথেষ্ট কদর ছিল। পাবনার তৈরি গেঞ্জি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হতো। ফলে ধীরে ধীরে পাবনায় বড় বড় গেঞ্জির কারখানা গড়ে ওঠে। মোমেনা হোসিয়ারি, সুলতান হোসিয়ারি, খাঁন হোসিয়ারিসহ বিভিন্ন হোসিয়ারি কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতো। হোসিয়ারি শিল্প থেকে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো, অপরদিকে এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক তাদের জীবিকা নির্বাহ করত।

বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান আদমজী অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার আদম খাঁন প্রথম পাবনাতে সুতার ব্যবসা শুরু করেন। তাদের কাছ থেকে সুতা খরিদ করে পাবনার হোসিয়ারি কারখানার মালিকরা গেঞ্জি উৎপাদন করতো। নৌপথে রফতানি সুবিধার কারনে উৎপাদিত পণ্য রফতানির সহজ উপায় হিসেবে এক সময় তাদের ব্যবসা নারায়নগঞ্জে স্থানান্তর করে। পাবনার ব্যবসা সীমিত আকারে থাকে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আদম খাঁনের পাবনার হোসিয়ারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সুতার অভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা ব্যবসা পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে থাকেন। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে হোসিয়ারি শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পাবনার অর্থনীতিতে ধস নামে। বেকার হয়ে পড়ে এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার দক্ষ অদক্ষ শ্রমিক। ঝুট ব্যবসার প্রচলন হওয়ায় হোসিয়ায়ারি শিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পায়। এ শিল্পে হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

১৯৯৫ সালের দিকে পাবনায় ঝুট ব্যবসার প্রচলন ঘটে। প্রথমদিকে সীমিত আকারে পরীক্ষামূলকভাবে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিয়ে ঝুট শিল্পের ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসায় কিছু শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কাপড়ের ও গার্মেন্ট কারখানা থেকে নমুনা কাটিংয়ের কাপড়, মিল ডিফেক্টসহ পরিত্যক্ত কাপড় মিল থেকে কম দামে কিনে এনে কাটাছেঁড়া বাদ দিয়ে নানা রকম পোষাক তৈরি শুরু করেন। এক সময় এসব কাটিং ঝুঁট আবর্জনা হিসেবে ফেলে বা পুড়িয়ে দেয়া হতো। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব গার্মেন্ট ঝুটের পোষাক জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে ফেরি করে বিক্রি করা হতো। অন্যান্য পোষাকের তুলনায় ঝুঁটের তৈরি পোষাক রুচিশীল টেকসই, গুনেমানে ভাল ও দাম অনেকটা কম হওয়ায় এই পোষাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।।

দাম কম হওয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষেরা এসব পণ্যের ক্রেতা ছিল। ধীরে ধীরে পাবনার গন্ডি পেরিয়ে ঝুট পণ্য পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ভালো সাফল্যের ফলে অন্য ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। সম্ভাবনা জেগে ওঠে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক নতুন শিল্পের। এক সময়ে ঝুটের তৈরি পোষাক গরিব শিশু কিশোরদের পোশাক হিসেবে পরিচিত হলেও আজ নানা বৈচিত্রের কারণে বিভিন্ন শ্রেনীর শিশু, কিশোর ও যুবকদের গায়ে শোভা পাচ্ছে।

পুঁজি বিনিয়োগের তুলনায় আয় বেশি হওয়ার কারণে বর্তমানে পাবনায় এক হাজার ৯০০ ছোট-বড় ঝুট শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। কয়েকটি মেশিন, একটি শো রুম ও সামান্য পুঁজি হলেই এ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা যায়। পাবনার তৈরি গেঞ্জির চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন এ ব্যবসায়ে। প্রতি সপ্তাহে নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা পাবনা থেকে ঝুটের তৈরি পোষাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাবনায় হোসিয়ারী শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। হাজার হাজার দক্ষ অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভারতের মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, তিনি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার পৌর সদরের কর্মকারপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। বেড়াতেই তার বেড়ে ওঠা। প্রথমে ছোটখাট ব্যবসা করতেন। পরে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। ভারত থেকে চাল, গমসহ ভূসিমাল আমদানি করতেন। প্রায় ২০ বছর আগে ভারতে পাড়ি জমান। পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসা শুরু করেন। পরে মাদাহ জেলায় ব্যবসা সম্প্রসারিত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আমাদানি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এম এম ইন্টারন্যাশনাল। অজিত দত্ত ১৯৯৮ সালে প্রথম পাবনা থেকে ঝুটের তৈরি পোষাক ভারতে রফতানি শুরু করেন। তখন প্রতি মাসে এক ট্রাক করে পোষাক নিতেন। এখন ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক প্রতি মাসে পাবনা থেকে ছয় ট্রাক গাজিপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাং থেকে ১০০ ট্রাক গার্মেন্ট ঝুটে তৈরি পেষাক ভারতে পাঠাচ্ছেন। সেখানে তারা এ পণ্য বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দামে বিক্রি করছেন।

তিনি বলেন, গাজিপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগাংয়ের উন্নতমানের গেঞ্জি ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লি রাজ্যের বিভিন্ন নামিদামি শপিংমল ও বিপনি বিতানগুলোতে বিক্রি হয়। কলকাতা, ডালখোলা, খড়কপুর, মাদাহ, মুর্শিদাবাদ, ভগবানগোলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট ছোট পাইকার ও খুচরা দোকানিদের কাছে পাবনার ঝুটের তৈরি পেষাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাবনার ঝুঁটের তৈরি পোষাক গুনেমানে ভাল, মোলায়েম ও দামে কম হওয়ায় ভারতের মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেনীর শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হাওড়া জেলার হাওড়াহাটে পাবনার ঝুটের তৈরি পেষাকের বিশাল পাইকারী বাজার রয়েছে বলে অজিত দত্ত জানান।

পাবনার ঝুট ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ জানান, সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় শ্রমিক দ্বারা তৈরি এ পণ্যটির চাহিদা দিন দিন দেশে বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুট শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে বহিবির্শ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে কমমুল্যে এ পন্য রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের আমদানিকারকরা পাবনা থেকে এ পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণীর লোকের মাঝে ঝুটের তৈরি পোষাকের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশে বিদেশে চাহিদার ফলে জেলার অন্য ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসায়ে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।

বা/খ: এসআর।

The short URL of the present article is: https://banglakhaborbd.com/tj1a