ঢাকা ০৯:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

চলনবিলে ফুটেছে জলজ ফুলের রানী লাল পদ্ম

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০১:০২:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪৫৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম : জলজ ফুলের রানি পদ্ম। পদ্ম ও শাপলা ফুল দুর থেকে দেখতে প্রায় একই রকম মনে হয়, কাছে গিয়ে ধরা পড়ে পার্থক্য। শাপলা নিয়ে মানুষের মনে যতটা কৌতুহল, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতুহল পদ্ম ফুল নিয়ে। প্রকৃতিতে পদ্মের নিষ্ঠা সূর্যের সঙ্গে আর শাপলার সন্মোহন চাঁদের সঙ্গে। পদ্মের মধ্যে নীলপদ্ম জলজ ফুলের ভূবনে শীর্ষে। নীলপদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয়। তবে পদ্ম ফুল তার ৬৪টি পাঁপড়ি মেলেই নিজেকে প্রদর্শন করে স্বাগত জানায়। যে পদ্মই হোক প্রকৃতির নিসর্গের রুপ নিয়েই এসেছে ভূবনে।

প্রায় চার দশক পর চলনবিলে আবারও ফুটছে জলজ ফুলের রানি পদ্ম। পদ্ম তার আবির রাঙানো রুপের মোহনভঙ্গিমা সাজিয়ে বসেছে যেন। তার অপার্থিব বাহারি রুপে প্রকৃতি হয়েছে স্বপ্নময় বর্ণিল। পদ্ম দিনের আলোয় দ্যুতি ছড়ায়। বিলজুড়ে শত শত পদ্মের এ নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখভরে দেখতে ছুটে আসছে পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমীরা। পবিত্রতার আবেশ ছড়ানো পদ্মের রুপবৈচিত্র্য দেখে প্রকাশ করছে তাদের মুগ্ধতা।

পদ্মের ইরেজি নাম বেশ কয়েকটি লিলি নাইল, ইজিপসিয়ান লিলি, দ্য ফ্লাওয়ার অব এ্যানসিয়েন্ট ইজিপসিয়ান। বৈজ্ঞানিক নাম নিমফাইয়া কেরুলা। সাধারন পদ্মা সোদা ও গোলাপী রঙের হরহামেশাই দেখা যায়। আমাজান লিলি পদ্মেরই একটি ভিন্ন জাত। চর্যাপদে বাংলা ভাষার সাহিত্য সৃষ্টির সুচনায় আছে পদ্মের পাঁপড়ি ৬৪টি। পাঁপড়ির নিচে অনেকটা হলদেটে পাঁপড়ি আছে কয়েকটি। ফুলের মধ্যের অংশের পুষ্পরেণুর শাখা হলদেটে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দোবিলা গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তি মোঃ কাইউম সরদার (৮৫) জানান, গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে চলনবিল হতে হারিয়ে যেতে থাকে পদ্ম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোঃ জামালের গবেষণায়ও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। তিনি ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলনবিল নিয়ে গবেষণা করেন। ওই সময়টায় তিনি তাড়াশের বিলে পদ্ম দেখেছেন। কিন্তু এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞন বিভাগের গবেষকরা এ অঞ্চলে আর কোন পদ্ম দেখতে পাননি বলে জানান অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।

অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ প্রায় চার দশক পরে চলনবিলে পদ্ম ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলেন, পদ্ম একটি বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। পদ্ম ফুলের একটি পরিপক্ক বীজ এক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনুকুল পরিবেশ পেলে সে আবারও বংশ বিস্তার করে। চলনবিলে ফোটা পদ্মের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো পদ্মফুলকে বৈশিষ্ট্য অনুসারে দুটি প্রজাতিতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এশিয়ান বা ইন্ডিয়া লোটাস (পদ্ম), অন্যটি হচ্ছে আমেরিকান বা ইয়েলো লোটাস। এশীয় পদ্ম আবার দুই রঙে দেখা যায়। একটি মসৃণ সাদা, অন্যটি হালকা গোলাপি। আমাদের দেশে যেসব পদ্ম ফুল দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো এশিয়ান বা ইন্ডিয়ান লোটাস। তবে নীল পদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয় বলে জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।

পৌরাণিক থেকে কিংবদন্তি প্রকৃতির নিসর্গে আসন করে নিয়েছে এই পদ্ম। যে ফুল মানব মনে জাগায় বিস্ময়কর অনুভূতি। পৌরাণিক কাহিনীতে পদ্মকে সূর্য ও পূনর্জন্মের প্রতীক বলা হয়েছে। উপমহাদেশের বরেণ্য সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় রুপক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য প্রেমিক দুঃসাধ্য সাধন করে ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিল। রামায়নে বর্ণিত আছে দূর্গা পুজোয় দেবীকে ১০৮টি পদ্ম অঞ্জলি দিলে দেবী মুগ্ধ হন। সেই থেকে পদ্মকে সুন্দর চোখের সঙ্গেও তুলনা করা হয়।

বৌদ্ধদের কাছে পদ্ম এতটাই পবিত্র যে মহাযানী বৌদ্ধের একটি সূত্রের নাম পদ্মসূত্র। বৈদিক যুগেরও আড়াই হাজার বছর আগে প্রচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পদ্মেরই উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মনে করেন, সিদ্ধার্থের সাধনায় প্রমাণিত হয়েছে সবকিছুই আছে মণিপদ্মে। এই মণিপদ্মেরই একটি রুপ নীলপদ্ম।
অধ্যাক্ষ এম.এ হামিদ রচিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। ১৯০৯ সালে পরিচালিত চলনবিল জরিপ প্রতিবেদনে এর আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম জানান, শুস্ক মওসুমে চলনবিলের জলমগ্ন এলাকা থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার।

চলনবিল এলাকার মধ্যে বিভিন্ন নামে এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল রয়েছে। এসব বিলে পদ্ম, শাপলা, শালুক, মাখনা, সিঙ্গট, গেচু, চেচুয়াসহ বহু প্রজাতির সপুষ্পক, ফার্ন, মস ও শৈবাল পাওয়া যেত। এর অনেকটিই এখন বিপন্ন এবং বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকদের অভিমত, পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলনবিল নিয়ে এখনই চিন্তা-ভাবনা আর পদক্ষেপ নেয়ার সময়। তা না হলে হারিয়ে যাবে অনেক জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী এবং প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর ঐতিহ্যময় চলনবিল।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

চলনবিলে ফুটেছে জলজ ফুলের রানী লাল পদ্ম

আপডেট সময় : ০১:০২:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর ২০২২

শফিউল আযম : জলজ ফুলের রানি পদ্ম। পদ্ম ও শাপলা ফুল দুর থেকে দেখতে প্রায় একই রকম মনে হয়, কাছে গিয়ে ধরা পড়ে পার্থক্য। শাপলা নিয়ে মানুষের মনে যতটা কৌতুহল, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতুহল পদ্ম ফুল নিয়ে। প্রকৃতিতে পদ্মের নিষ্ঠা সূর্যের সঙ্গে আর শাপলার সন্মোহন চাঁদের সঙ্গে। পদ্মের মধ্যে নীলপদ্ম জলজ ফুলের ভূবনে শীর্ষে। নীলপদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয়। তবে পদ্ম ফুল তার ৬৪টি পাঁপড়ি মেলেই নিজেকে প্রদর্শন করে স্বাগত জানায়। যে পদ্মই হোক প্রকৃতির নিসর্গের রুপ নিয়েই এসেছে ভূবনে।

প্রায় চার দশক পর চলনবিলে আবারও ফুটছে জলজ ফুলের রানি পদ্ম। পদ্ম তার আবির রাঙানো রুপের মোহনভঙ্গিমা সাজিয়ে বসেছে যেন। তার অপার্থিব বাহারি রুপে প্রকৃতি হয়েছে স্বপ্নময় বর্ণিল। পদ্ম দিনের আলোয় দ্যুতি ছড়ায়। বিলজুড়ে শত শত পদ্মের এ নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখভরে দেখতে ছুটে আসছে পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমীরা। পবিত্রতার আবেশ ছড়ানো পদ্মের রুপবৈচিত্র্য দেখে প্রকাশ করছে তাদের মুগ্ধতা।

পদ্মের ইরেজি নাম বেশ কয়েকটি লিলি নাইল, ইজিপসিয়ান লিলি, দ্য ফ্লাওয়ার অব এ্যানসিয়েন্ট ইজিপসিয়ান। বৈজ্ঞানিক নাম নিমফাইয়া কেরুলা। সাধারন পদ্মা সোদা ও গোলাপী রঙের হরহামেশাই দেখা যায়। আমাজান লিলি পদ্মেরই একটি ভিন্ন জাত। চর্যাপদে বাংলা ভাষার সাহিত্য সৃষ্টির সুচনায় আছে পদ্মের পাঁপড়ি ৬৪টি। পাঁপড়ির নিচে অনেকটা হলদেটে পাঁপড়ি আছে কয়েকটি। ফুলের মধ্যের অংশের পুষ্পরেণুর শাখা হলদেটে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দোবিলা গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তি মোঃ কাইউম সরদার (৮৫) জানান, গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে চলনবিল হতে হারিয়ে যেতে থাকে পদ্ম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোঃ জামালের গবেষণায়ও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। তিনি ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলনবিল নিয়ে গবেষণা করেন। ওই সময়টায় তিনি তাড়াশের বিলে পদ্ম দেখেছেন। কিন্তু এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞন বিভাগের গবেষকরা এ অঞ্চলে আর কোন পদ্ম দেখতে পাননি বলে জানান অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।

অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ প্রায় চার দশক পরে চলনবিলে পদ্ম ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলেন, পদ্ম একটি বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। পদ্ম ফুলের একটি পরিপক্ক বীজ এক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনুকুল পরিবেশ পেলে সে আবারও বংশ বিস্তার করে। চলনবিলে ফোটা পদ্মের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো পদ্মফুলকে বৈশিষ্ট্য অনুসারে দুটি প্রজাতিতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এশিয়ান বা ইন্ডিয়া লোটাস (পদ্ম), অন্যটি হচ্ছে আমেরিকান বা ইয়েলো লোটাস। এশীয় পদ্ম আবার দুই রঙে দেখা যায়। একটি মসৃণ সাদা, অন্যটি হালকা গোলাপি। আমাদের দেশে যেসব পদ্ম ফুল দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো এশিয়ান বা ইন্ডিয়ান লোটাস। তবে নীল পদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয় বলে জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।

পৌরাণিক থেকে কিংবদন্তি প্রকৃতির নিসর্গে আসন করে নিয়েছে এই পদ্ম। যে ফুল মানব মনে জাগায় বিস্ময়কর অনুভূতি। পৌরাণিক কাহিনীতে পদ্মকে সূর্য ও পূনর্জন্মের প্রতীক বলা হয়েছে। উপমহাদেশের বরেণ্য সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় রুপক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য প্রেমিক দুঃসাধ্য সাধন করে ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিল। রামায়নে বর্ণিত আছে দূর্গা পুজোয় দেবীকে ১০৮টি পদ্ম অঞ্জলি দিলে দেবী মুগ্ধ হন। সেই থেকে পদ্মকে সুন্দর চোখের সঙ্গেও তুলনা করা হয়।

বৌদ্ধদের কাছে পদ্ম এতটাই পবিত্র যে মহাযানী বৌদ্ধের একটি সূত্রের নাম পদ্মসূত্র। বৈদিক যুগেরও আড়াই হাজার বছর আগে প্রচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পদ্মেরই উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মনে করেন, সিদ্ধার্থের সাধনায় প্রমাণিত হয়েছে সবকিছুই আছে মণিপদ্মে। এই মণিপদ্মেরই একটি রুপ নীলপদ্ম।
অধ্যাক্ষ এম.এ হামিদ রচিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। ১৯০৯ সালে পরিচালিত চলনবিল জরিপ প্রতিবেদনে এর আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম জানান, শুস্ক মওসুমে চলনবিলের জলমগ্ন এলাকা থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার।

চলনবিল এলাকার মধ্যে বিভিন্ন নামে এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল রয়েছে। এসব বিলে পদ্ম, শাপলা, শালুক, মাখনা, সিঙ্গট, গেচু, চেচুয়াসহ বহু প্রজাতির সপুষ্পক, ফার্ন, মস ও শৈবাল পাওয়া যেত। এর অনেকটিই এখন বিপন্ন এবং বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকদের অভিমত, পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলনবিল নিয়ে এখনই চিন্তা-ভাবনা আর পদক্ষেপ নেয়ার সময়। তা না হলে হারিয়ে যাবে অনেক জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী এবং প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর ঐতিহ্যময় চলনবিল।