ঢাকা ০৬:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

খোদাবক্স বাংলাদেশের বীমা ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩
  • / ৪৬৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
// মোহাম্মদ নান্নু মৃধা, শরীয়তপুর প্রতিনিধি //
খোদাবক্স নতুন প্রজম্মের কাছে একটি অপরিচিত নাম হলেও বাংলাদেশের ইন্সুরেন্সের ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় নাম। বাংলাদেশের ইন্সুরেন্সের পথপ্রদর্শক ও ইন্সুরেন্সের যাদুকর  হিসাবে  তিনি পরিচিত।
খোদাবক্স ১৯১২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যাতে জন্মগ্রহন করেছিলেন। বাবা  সোনাবুদ্দিন হাওলাদার, মায়ের নাম আর্জুদা খাতুন। পাঁচ ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার পিতা পাট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রামের স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। স্কুল জীবন থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুপরিচিতি ছিল তার। স্কুলজীবনে তার সহপাঠীদের অভাব অনটনে তাদের সাহায্য করাকে তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। তখনকার দিনে যার স্কুলে আসত তাদের অধিকাংশই ছিল অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। সহপাঠীদের মাঝে যারা এধরনের অসুবিধার মধ্যে যারা লেখাপড়ায়  উৎসাহী ছিলেন তাদেরকে কিশোর খোদাবক্স তার নিজের বই দিয়ে সহযোগিতা করতেন। সহপাঠীদের প্রতি এ ধরনের সমমর্মী আচরনে তার বাবা তাকে  উৎসাহিত করতেন।
১৯২৯ সালে কনেশ্বর শ্যামা চরন এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে অংকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩২ সালে  আই.এ পাশ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন।
কর্মজীবনের প্রথমে তিনি ১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে খন্ডকালীন লাইব্রেরিয়ান হিসাবে ৬ মাস কাজ করেন। সমাজসেবার মানসিকতা থেকে ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতা ওয়েরিয়েন্টাল গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বীমা এজেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। মানুষকে উৎসাহিত ও জয়করার ক্ষমতা এবং দক্ষতার কারণে তিনি ১৯৪৬সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ইন্সপেক্টর হন। দেশ বিভাগের পূর্বেই তিনি প্রথম শ্রেণির জীবন বীমা কর্মীতে পরিণত হন।
দেশ বিভাগের পর তিনি ১৯৫২ সালে ইষ্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্সুরেন্স কোম্পানি (ইফু) পূর্ব পাকিস্তান শাখায় লাইফ ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। সতের বছরের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিরলস, নিষ্ঠাবান, সৎ, সমাজহিতৈষী ও উন্নত মানসিকতার কারনে তিনি ৮ বছরের মধ্যে গোটা পাকিস্তানের লাইফ সেকশনের লাইফ ম্যানেজার (১৯৬০-১৯৬৩), পরবর্তীতে ডেপুটি ম্যানেজার (১৯৬৩-১৯৬৬) ও জেনারেল ম্যানেজার (১৯৬৬-১৯৬৯) হন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি শত শত এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বীমাকর্মী হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। এ প্রশিক্ষণ জীবন বীমার ব্যবসা উন্নয়নে দারুন ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ এ সময় কোন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৬৬ সালে তার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম পেশাদার বীমা এজেন্সি প্রশিক্ষণ চালু হয়। ইফুকে ভূমিশয্যা হতে পাকিস্তানের ৩৭ টি কোম্পানির মধ্যে শীর্ষস্থানে তুলে আনার জন্য তিনি ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। কেবল তাই নয় ইফুকে জাপান বাদে আফ্রো-এশিয়ার মধ্যে শীর্ষ কোম্পানি হিসাবে গণ্য করা হতো।
পূর্ব -পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিনিয়োগ বৈষম্য এবং বাঙালি প্রীতির কারণে তাকে ইফু কর্তৃপক্ষের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয়। তিনি কোম্পানি হতে পদত্যাগ করে বাঙালি শিল্পপতিদের নিয়ে এক মাসের মধ্যে নতুন কোম্পানি ফেডারেল লাইফ এন্ড জেনারেল এসুরেন্স কোম্পানি গড়ে তোলেন; যেটি স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সফলতা লাভ করে।
১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্মলাভের পর ১৯৭২ সালে দেশের সকল বীমা কোম্পানিকে জাতীয়করন করে গঠিত হয় জীবন বীমা করপোরেশন। দীর্ঘ  অভিযাত্রায় সমৃদ্ধতার কারণে খোদাবক্সকে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব।
অসাধারন জনসংযোগের ক্ষমতা ছিল তার। নতুন পরিচিত মানুষকে খুব সহজেই এবং অল্প সময়েই তিনি নিকটজনে পরিণত করতে পারতেন । মাতৃভাষার সাথে সাথে ইংরেজিতে তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। বাংলাপ্রীতির কারণে তিনি বীমাশিল্পের সকল পুস্তিকা  ও প্রিমিয়ামসহ সকল ডকুমেন্ট মাতৃভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
১৯৭৩ সালের মে মাসে নীতিগত কারণে তিনি দীর্ঘ কর্মময় জীবন হতে অব্যাহতি নেন। শরীয়তপুর তথা বাংলাদেশের এ কৃতী সন্তান ১৯৭৪ সালের ১৩ই মে ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
জনাব  খোদাবক্স  প্রখ্যাত নেতা মরহুম খান এ সবুরের  ভাগ্নী জোবেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। তার ৬ ছেলে ও ১ মেয়ে। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত।  বড়  ছেলে এম,জুবাইদুর রহিম সিটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২য় ছেলে এম আতাউর রহিম  কানাডার একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা, ৩য় ছেলে এম ওবায়দুর রহিম আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক, ৪ র্থ ছেলে  এম  বজলুর রহিম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জনসংযোগ কর্মকর্তা, ৫ম ছেলে  ডাঃ জিল্লুর রহিম  ধানমন্ডীতে একটি  ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ৬ষ্ঠ ছেলে  জাভেদ  কম্পিউটার ট্রেনিংসংক্রান্ত বিষয়ে  ব্যবসা করেন। একমাত্র কন্যা  আম্বারিন সুলতানা গৃহিনী। স্বামী নিউরোলজির অধ্যাপক। আমেরিকার শিকাগোতে আছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম জিল্লুর রহমান তার এক ছেলের শ্বশুর। জাতীয় নেতা ও  সাবেক পানিসম্পদ  মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার ভাগ্নে।
ডামুড্যার খোদা বকস বিমা শিল্পের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব। একমাত্র তার স্মরণে তাহার ছেলে মেয়েরা তৈরি করেছে খোদাবক্স মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন যার বদলেতে ডামুড্যার অনেক গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা উপবৃত্তি পেয়ে থাকেন। তাদের বাৎসরিক পড়ালেখার যেই খরচ সেই খরচ ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়া হয়,  বিভিন্ন হাসপাতাল ও তাদের অবদান আছে, অনেক ছাত্র গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে।  তারা তাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে কনেশ্বর এসসি এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন।  এর মধ্যে খোদাবক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। এটা সম্পূর্ণ একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি। এখানে ফ্রিতে কম্পিউটারও শেখার ব্যবস্থা তারা করে দিয়েছে।  তাদের মিশন হল, তারা একটি শিক্ষিত জাতি দেখতে চায়। তারা যতটুকু পারবে তারা তা করে যাবে আজীবন। কারণ তারা তারা তাদের বাবার শিক্ষার, আদর্শটা ধরে রাখতে চায়। তারা যেসব স্কুলে স্কলারশিপ দিয়ে থাকেন, আলহাজ্ব আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, আলহাজ্ব ইমাম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, ডামুড্যা মুসলিম সরকারি হাই স্কুল, কনেশ্বর শ্যামাচরণ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন, চর মালগাও  উচ্চবিদ্যালয়, আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।  এসকল স্কুলে তারা প্রতিবছর গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ দিয়ে থাকেন।  তারা প্রায় এক কোটি টাকা ব্যায়ে সুন্দর একটি লাইব্রেরি করেছেন যার নাম খোদাবক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি, এটি একটি ডিজিটাল পাবলিক লাইব্রেরি।
জনসেবায় তার অবদান অপরিসীম। তিনি নিজ গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমূদয় খরচ বহন করতেন। তার প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের বহু যুবকের বীমাশিল্পের চাকুরীতে নিয়োগ করা হয়। তিনি জীবনে অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেন নি। অনেক নিঃস্ব পরিবারকে তিনি উঠিয়েছেন। বীমাশিল্পে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। এদেশের ইন্সুরেন্সের জন্মদাতা তিনি। পলিটিক্যাল লিডাররা বিভিন্ন স্থানে গেলে কর্মীরা যেমন অপেক্ষা করে তেমনি তিনি যেখানে যেতেন সেখানে তার জন্য কর্মীরা অপেক্ষা করত।
ইন্সুরেন্স না করলেও তাকে দেখার জন্য  মানুষ বসে থাকতেন। খোদাবক্স সাহেব কে? তার নাম এতো শুনেছি  তাকে দেখতেই হবে।
তিনি ছিলেন আমাদের দেশীয় সীমারেখায় বীমাশিল্পের জনক। গত শতাব্দীর ৩য় দশকে সেই বৃটিশ যুগেই তিনি এমন একটি চ্যালেন্জিং পেশায় নিজেকে যুক্ত করে ছিলেন যেখানে তার আগমন ছিল বীমাবিমুখ বাংগালী মুসলমানদের মধ্যে এক অনন্যসাধারন ঘটনা। ব্যক্তিগত এই অভিলাষ তাকে সাহায্য করেছিল পাকিস্তান আমলে ও বর্তমান বাংলাদেশে বীমাশিল্পের ব্যাপক বিস্তারে, যার  পরিনতিই  স্বাধীন বাংলাদেশে এ শিল্পের সার্থক অভিযাত্রা সম্ভব হয়েছিল।
এ বিশ্বে যারা তিলতিল করে নিজেদের প্রস্তুত করেন, প্রায় শূন্য থেকে যাত্রাশুরু করে, মাটির কাছাকাছি থেকে মানুষকে মন দিয়ে অনুভব করেন, এ ধরনের মানুষ যখন তাদের পেশায় তাদের কর্মস্থলের শিখরে উপনীত হন নানা টানাপোড়েনের শেষে, তখন তারা আর পরিবারের সম্পদ নন, তাদের অফিসের সম্পদ নন, তারা হয়ে উঠেন দেশ ও জাতির সম্পদ। জনাব খোদাবক্স ছিলেন এই দলে। জীবন বীমার একজন সামান্য এজেন্টের  সামান্য ভূমিকা পালনের জন্য সূদুর ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন কলকাতায় এবং তারপর তিরিশ বছরের এক অনুপম জার্নি।  অবিভক্ত ভারতের কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান, সেখান থেকে সমগ্র পাকিস্তান অবশেষে বাংলাদেশ  জনাব খোদাবক্স নিজেই হয়ে উঠলেন এক প্রতিষ্ঠানে! এ মহান ব্যক্তিকে দেশ ও জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
বা/খ: এসআর।

নিউজটি শেয়ার করুন

খোদাবক্স বাংলাদেশের বীমা ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক

আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩
// মোহাম্মদ নান্নু মৃধা, শরীয়তপুর প্রতিনিধি //
খোদাবক্স নতুন প্রজম্মের কাছে একটি অপরিচিত নাম হলেও বাংলাদেশের ইন্সুরেন্সের ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় নাম। বাংলাদেশের ইন্সুরেন্সের পথপ্রদর্শক ও ইন্সুরেন্সের যাদুকর  হিসাবে  তিনি পরিচিত।
খোদাবক্স ১৯১২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যাতে জন্মগ্রহন করেছিলেন। বাবা  সোনাবুদ্দিন হাওলাদার, মায়ের নাম আর্জুদা খাতুন। পাঁচ ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার পিতা পাট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রামের স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। স্কুল জীবন থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুপরিচিতি ছিল তার। স্কুলজীবনে তার সহপাঠীদের অভাব অনটনে তাদের সাহায্য করাকে তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। তখনকার দিনে যার স্কুলে আসত তাদের অধিকাংশই ছিল অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। সহপাঠীদের মাঝে যারা এধরনের অসুবিধার মধ্যে যারা লেখাপড়ায়  উৎসাহী ছিলেন তাদেরকে কিশোর খোদাবক্স তার নিজের বই দিয়ে সহযোগিতা করতেন। সহপাঠীদের প্রতি এ ধরনের সমমর্মী আচরনে তার বাবা তাকে  উৎসাহিত করতেন।
১৯২৯ সালে কনেশ্বর শ্যামা চরন এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে অংকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩২ সালে  আই.এ পাশ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন।
কর্মজীবনের প্রথমে তিনি ১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে খন্ডকালীন লাইব্রেরিয়ান হিসাবে ৬ মাস কাজ করেন। সমাজসেবার মানসিকতা থেকে ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতা ওয়েরিয়েন্টাল গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বীমা এজেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। মানুষকে উৎসাহিত ও জয়করার ক্ষমতা এবং দক্ষতার কারণে তিনি ১৯৪৬সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ইন্সপেক্টর হন। দেশ বিভাগের পূর্বেই তিনি প্রথম শ্রেণির জীবন বীমা কর্মীতে পরিণত হন।
দেশ বিভাগের পর তিনি ১৯৫২ সালে ইষ্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্সুরেন্স কোম্পানি (ইফু) পূর্ব পাকিস্তান শাখায় লাইফ ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। সতের বছরের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিরলস, নিষ্ঠাবান, সৎ, সমাজহিতৈষী ও উন্নত মানসিকতার কারনে তিনি ৮ বছরের মধ্যে গোটা পাকিস্তানের লাইফ সেকশনের লাইফ ম্যানেজার (১৯৬০-১৯৬৩), পরবর্তীতে ডেপুটি ম্যানেজার (১৯৬৩-১৯৬৬) ও জেনারেল ম্যানেজার (১৯৬৬-১৯৬৯) হন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি শত শত এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বীমাকর্মী হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। এ প্রশিক্ষণ জীবন বীমার ব্যবসা উন্নয়নে দারুন ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ এ সময় কোন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৬৬ সালে তার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম পেশাদার বীমা এজেন্সি প্রশিক্ষণ চালু হয়। ইফুকে ভূমিশয্যা হতে পাকিস্তানের ৩৭ টি কোম্পানির মধ্যে শীর্ষস্থানে তুলে আনার জন্য তিনি ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। কেবল তাই নয় ইফুকে জাপান বাদে আফ্রো-এশিয়ার মধ্যে শীর্ষ কোম্পানি হিসাবে গণ্য করা হতো।
পূর্ব -পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিনিয়োগ বৈষম্য এবং বাঙালি প্রীতির কারণে তাকে ইফু কর্তৃপক্ষের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয়। তিনি কোম্পানি হতে পদত্যাগ করে বাঙালি শিল্পপতিদের নিয়ে এক মাসের মধ্যে নতুন কোম্পানি ফেডারেল লাইফ এন্ড জেনারেল এসুরেন্স কোম্পানি গড়ে তোলেন; যেটি স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সফলতা লাভ করে।
১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্মলাভের পর ১৯৭২ সালে দেশের সকল বীমা কোম্পানিকে জাতীয়করন করে গঠিত হয় জীবন বীমা করপোরেশন। দীর্ঘ  অভিযাত্রায় সমৃদ্ধতার কারণে খোদাবক্সকে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব।
অসাধারন জনসংযোগের ক্ষমতা ছিল তার। নতুন পরিচিত মানুষকে খুব সহজেই এবং অল্প সময়েই তিনি নিকটজনে পরিণত করতে পারতেন । মাতৃভাষার সাথে সাথে ইংরেজিতে তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। বাংলাপ্রীতির কারণে তিনি বীমাশিল্পের সকল পুস্তিকা  ও প্রিমিয়ামসহ সকল ডকুমেন্ট মাতৃভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
১৯৭৩ সালের মে মাসে নীতিগত কারণে তিনি দীর্ঘ কর্মময় জীবন হতে অব্যাহতি নেন। শরীয়তপুর তথা বাংলাদেশের এ কৃতী সন্তান ১৯৭৪ সালের ১৩ই মে ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
জনাব  খোদাবক্স  প্রখ্যাত নেতা মরহুম খান এ সবুরের  ভাগ্নী জোবেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। তার ৬ ছেলে ও ১ মেয়ে। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত।  বড়  ছেলে এম,জুবাইদুর রহিম সিটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২য় ছেলে এম আতাউর রহিম  কানাডার একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা, ৩য় ছেলে এম ওবায়দুর রহিম আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক, ৪ র্থ ছেলে  এম  বজলুর রহিম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জনসংযোগ কর্মকর্তা, ৫ম ছেলে  ডাঃ জিল্লুর রহিম  ধানমন্ডীতে একটি  ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ৬ষ্ঠ ছেলে  জাভেদ  কম্পিউটার ট্রেনিংসংক্রান্ত বিষয়ে  ব্যবসা করেন। একমাত্র কন্যা  আম্বারিন সুলতানা গৃহিনী। স্বামী নিউরোলজির অধ্যাপক। আমেরিকার শিকাগোতে আছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম জিল্লুর রহমান তার এক ছেলের শ্বশুর। জাতীয় নেতা ও  সাবেক পানিসম্পদ  মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার ভাগ্নে।
ডামুড্যার খোদা বকস বিমা শিল্পের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব। একমাত্র তার স্মরণে তাহার ছেলে মেয়েরা তৈরি করেছে খোদাবক্স মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন যার বদলেতে ডামুড্যার অনেক গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা উপবৃত্তি পেয়ে থাকেন। তাদের বাৎসরিক পড়ালেখার যেই খরচ সেই খরচ ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়া হয়,  বিভিন্ন হাসপাতাল ও তাদের অবদান আছে, অনেক ছাত্র গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে।  তারা তাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে কনেশ্বর এসসি এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন।  এর মধ্যে খোদাবক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। এটা সম্পূর্ণ একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি। এখানে ফ্রিতে কম্পিউটারও শেখার ব্যবস্থা তারা করে দিয়েছে।  তাদের মিশন হল, তারা একটি শিক্ষিত জাতি দেখতে চায়। তারা যতটুকু পারবে তারা তা করে যাবে আজীবন। কারণ তারা তারা তাদের বাবার শিক্ষার, আদর্শটা ধরে রাখতে চায়। তারা যেসব স্কুলে স্কলারশিপ দিয়ে থাকেন, আলহাজ্ব আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, আলহাজ্ব ইমাম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, ডামুড্যা মুসলিম সরকারি হাই স্কুল, কনেশ্বর শ্যামাচরণ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন, চর মালগাও  উচ্চবিদ্যালয়, আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।  এসকল স্কুলে তারা প্রতিবছর গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ দিয়ে থাকেন।  তারা প্রায় এক কোটি টাকা ব্যায়ে সুন্দর একটি লাইব্রেরি করেছেন যার নাম খোদাবক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি, এটি একটি ডিজিটাল পাবলিক লাইব্রেরি।
জনসেবায় তার অবদান অপরিসীম। তিনি নিজ গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমূদয় খরচ বহন করতেন। তার প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের বহু যুবকের বীমাশিল্পের চাকুরীতে নিয়োগ করা হয়। তিনি জীবনে অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেন নি। অনেক নিঃস্ব পরিবারকে তিনি উঠিয়েছেন। বীমাশিল্পে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। এদেশের ইন্সুরেন্সের জন্মদাতা তিনি। পলিটিক্যাল লিডাররা বিভিন্ন স্থানে গেলে কর্মীরা যেমন অপেক্ষা করে তেমনি তিনি যেখানে যেতেন সেখানে তার জন্য কর্মীরা অপেক্ষা করত।
ইন্সুরেন্স না করলেও তাকে দেখার জন্য  মানুষ বসে থাকতেন। খোদাবক্স সাহেব কে? তার নাম এতো শুনেছি  তাকে দেখতেই হবে।
তিনি ছিলেন আমাদের দেশীয় সীমারেখায় বীমাশিল্পের জনক। গত শতাব্দীর ৩য় দশকে সেই বৃটিশ যুগেই তিনি এমন একটি চ্যালেন্জিং পেশায় নিজেকে যুক্ত করে ছিলেন যেখানে তার আগমন ছিল বীমাবিমুখ বাংগালী মুসলমানদের মধ্যে এক অনন্যসাধারন ঘটনা। ব্যক্তিগত এই অভিলাষ তাকে সাহায্য করেছিল পাকিস্তান আমলে ও বর্তমান বাংলাদেশে বীমাশিল্পের ব্যাপক বিস্তারে, যার  পরিনতিই  স্বাধীন বাংলাদেশে এ শিল্পের সার্থক অভিযাত্রা সম্ভব হয়েছিল।
এ বিশ্বে যারা তিলতিল করে নিজেদের প্রস্তুত করেন, প্রায় শূন্য থেকে যাত্রাশুরু করে, মাটির কাছাকাছি থেকে মানুষকে মন দিয়ে অনুভব করেন, এ ধরনের মানুষ যখন তাদের পেশায় তাদের কর্মস্থলের শিখরে উপনীত হন নানা টানাপোড়েনের শেষে, তখন তারা আর পরিবারের সম্পদ নন, তাদের অফিসের সম্পদ নন, তারা হয়ে উঠেন দেশ ও জাতির সম্পদ। জনাব খোদাবক্স ছিলেন এই দলে। জীবন বীমার একজন সামান্য এজেন্টের  সামান্য ভূমিকা পালনের জন্য সূদুর ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন কলকাতায় এবং তারপর তিরিশ বছরের এক অনুপম জার্নি।  অবিভক্ত ভারতের কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান, সেখান থেকে সমগ্র পাকিস্তান অবশেষে বাংলাদেশ  জনাব খোদাবক্স নিজেই হয়ে উঠলেন এক প্রতিষ্ঠানে! এ মহান ব্যক্তিকে দেশ ও জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
বা/খ: এসআর।