ঢাকা ১০:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৫:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩
  • / ৪৭৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ডেস্ক রিপোর্ট :

পশ্চিমা শাষকদের যাতাকলে নিরীহ বাঙালি যখন নিঃষ্পেষিত, নির্যাতিত হচ্ছে ঠিক তখনই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মোঃ আমজাদ হোসেন। তখন তার বয়স ২১ বছর। তার বাবার নাম মৃত ধনী মোল্লা। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোরজনা ইউনিয়নের বড়মহারাজপুর গ্রামে। তখন তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। তাকে সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে মুক্তির জন্য যার যা আছে তাই নেয় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। তাঁর এই ভাষণে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যুদ্ধে যাবার প্রতিজ্ঞা করেন আমজাদ হোসেন।

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাসদস্য আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে উপজেলার উল্টাডাব মাঠে ১৮ জন সহযোদ্ধার সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন। এই সময় তার সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারন সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মওলা আজম। এরপর সাবেক গণপরিষদ সদস্য এ্যাড. আব্দুর রহমানের নির্দেশে শাহজাদপুর গার্লস স্কুলে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণে বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য এ্যাড. আব্দুর রহমান। ১২ই এপ্রিল কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে নগরবাড়ী ঘাটে পাকসেনাদের সাথে তাদের যুদ্ধ হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমজাদ হোসেন যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণকালে বলেন, পাকসেনারা যখন একটি ফেরি নিয়ে আরিচা থেকে নগরবাড়ীর দিকে আসার চেষ্ট করে তখন ১৫ জন সহযোদ্ধা নিয়ে আমরা ৩টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে তাদের প্রতিহত করার চেষ্ট করি। ১৪ এপ্রিল পাকবাহিনী ৪টি বিমান নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমন করে। বিমান থেকে তারা বোমা ও গুলি নিক্ষেপ করেন। এতে আমাদের কেউ আহত বা নিহত না হলেও স্থানীয় সাধারন কিছু মানুষ নিহত হয় এবং আতংকে তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বেড়া উপজেলার ডাববাগানে অবস্থান করলে এখানে পাকিস্থানিদের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হলে আমরা ১৩ থেকে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হারাই। আমরা অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় ও গোলাবারুদের সন্ধানে সহযোদ্ধা গোলাম আজম ও আব্দুল জলিলকে নিয়ে বগুড়া বিডিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে যে সমস্ত অস্ত্রের সন্ধান পাই তার সবই ছিলো অকেঁজো এবং পাকিস্থানিদের ধ্বংশ করা। আমরা বিডিয়ার ক্যাম্প থেকে মাত্র ৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল পাই। এরপর আমরা শাহজাদপুর চলে আসি। তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দীন সাহেব আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন। ওই অস্ত্র নিয়ে আমরা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা ও এসডিও শামসুদ্দীন সাহেব বাঘাবাড়িতে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা মালিপাড়া নামক স্থানে পাকিস্থানি বাহিনীর সাথে অতি সন্নিকটে থেকে সম্মুখ যুদ্ধ করি। এই যুদ্ধে আমাদের সাথে ৭০ জন সহযোদ্ধা ছিলেন। আমরা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্থানিদের ওপর ত্রিমূখী আক্রমন শুরু করি। এ যুদ্ধে ৩ জন পাকবাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পাকবাহিনীরা হে আলী বলে গুলি চালালে আমরা জয়বাংলা বলে গুলি ছঁড়তে থাকি। আমাদের প্রতিরোধের মুখে তারা যমুনা নদী দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায়।

উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এসডিও শামসুদ্দীন সাহেবকে পাকিস্থানিরা গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীরা কুখ্যাত ও অত্যাচারী রাজাকারদের সন্ধান করতে থাকে। এসময় উল্লাপাড়ার বেশ কয়েকজন রাজাকারদের সন্ধান পান এবং তাদের মধ্যে ২ জনকে হত্যা করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি যদি নিহত হতেন তাতে তার কোন দুঃখ ছিলোনা। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে তিনি আশংকা করেন যে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বদলে সুযোগ সন্ধানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের দলে নাম লিখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে। ৭১ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন বর্তমানে রাজশাহী শহরের বিহারী কলোনীতে অবসর জীবন যাপন করছেন।

বা/খ: এসআর।

নিউজটি শেয়ার করুন

এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

আপডেট সময় : ০৬:৩৫:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩

ডেস্ক রিপোর্ট :

পশ্চিমা শাষকদের যাতাকলে নিরীহ বাঙালি যখন নিঃষ্পেষিত, নির্যাতিত হচ্ছে ঠিক তখনই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মোঃ আমজাদ হোসেন। তখন তার বয়স ২১ বছর। তার বাবার নাম মৃত ধনী মোল্লা। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোরজনা ইউনিয়নের বড়মহারাজপুর গ্রামে। তখন তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। তাকে সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে মুক্তির জন্য যার যা আছে তাই নেয় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। তাঁর এই ভাষণে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যুদ্ধে যাবার প্রতিজ্ঞা করেন আমজাদ হোসেন।

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাসদস্য আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে উপজেলার উল্টাডাব মাঠে ১৮ জন সহযোদ্ধার সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন। এই সময় তার সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারন সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মওলা আজম। এরপর সাবেক গণপরিষদ সদস্য এ্যাড. আব্দুর রহমানের নির্দেশে শাহজাদপুর গার্লস স্কুলে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণে বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য এ্যাড. আব্দুর রহমান। ১২ই এপ্রিল কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে নগরবাড়ী ঘাটে পাকসেনাদের সাথে তাদের যুদ্ধ হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমজাদ হোসেন যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণকালে বলেন, পাকসেনারা যখন একটি ফেরি নিয়ে আরিচা থেকে নগরবাড়ীর দিকে আসার চেষ্ট করে তখন ১৫ জন সহযোদ্ধা নিয়ে আমরা ৩টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে তাদের প্রতিহত করার চেষ্ট করি। ১৪ এপ্রিল পাকবাহিনী ৪টি বিমান নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমন করে। বিমান থেকে তারা বোমা ও গুলি নিক্ষেপ করেন। এতে আমাদের কেউ আহত বা নিহত না হলেও স্থানীয় সাধারন কিছু মানুষ নিহত হয় এবং আতংকে তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বেড়া উপজেলার ডাববাগানে অবস্থান করলে এখানে পাকিস্থানিদের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হলে আমরা ১৩ থেকে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হারাই। আমরা অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় ও গোলাবারুদের সন্ধানে সহযোদ্ধা গোলাম আজম ও আব্দুল জলিলকে নিয়ে বগুড়া বিডিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে যে সমস্ত অস্ত্রের সন্ধান পাই তার সবই ছিলো অকেঁজো এবং পাকিস্থানিদের ধ্বংশ করা। আমরা বিডিয়ার ক্যাম্প থেকে মাত্র ৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল পাই। এরপর আমরা শাহজাদপুর চলে আসি। তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দীন সাহেব আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন। ওই অস্ত্র নিয়ে আমরা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা ও এসডিও শামসুদ্দীন সাহেব বাঘাবাড়িতে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা মালিপাড়া নামক স্থানে পাকিস্থানি বাহিনীর সাথে অতি সন্নিকটে থেকে সম্মুখ যুদ্ধ করি। এই যুদ্ধে আমাদের সাথে ৭০ জন সহযোদ্ধা ছিলেন। আমরা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্থানিদের ওপর ত্রিমূখী আক্রমন শুরু করি। এ যুদ্ধে ৩ জন পাকবাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পাকবাহিনীরা হে আলী বলে গুলি চালালে আমরা জয়বাংলা বলে গুলি ছঁড়তে থাকি। আমাদের প্রতিরোধের মুখে তারা যমুনা নদী দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায়।

উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এসডিও শামসুদ্দীন সাহেবকে পাকিস্থানিরা গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীরা কুখ্যাত ও অত্যাচারী রাজাকারদের সন্ধান করতে থাকে। এসময় উল্লাপাড়ার বেশ কয়েকজন রাজাকারদের সন্ধান পান এবং তাদের মধ্যে ২ জনকে হত্যা করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি যদি নিহত হতেন তাতে তার কোন দুঃখ ছিলোনা। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে তিনি আশংকা করেন যে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বদলে সুযোগ সন্ধানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের দলে নাম লিখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে। ৭১ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন বর্তমানে রাজশাহী শহরের বিহারী কলোনীতে অবসর জীবন যাপন করছেন।

বা/খ: এসআর।