ঢাকা ০৮:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

৭১’এর আত্মত্যাগী এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা 

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৬:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩
  • / ৪৪৬ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

নিজস্ব প্রতিবেদক :

পশ্চিমা শাষকদের যাতাকলে নিরীহ বাঙালি যখন নিঃষ্পেষিত, নির্যাতিত হচ্ছে ঠিক তখনই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মোঃ আব্দুল হাই। তখন তার বয়স ২০ বছর। তিনি তার পরিবারকে না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তার বাবার নাম মৃত হাজী আব্দুল গফুর। গ্রামের বাড়ি শাহজাদপুরের উল্টাডাব গ্রামে। তিনি তখন শাহজাদপুর কলেজে মাধ্যমিকের ছাত্র।

১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ ১৫ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি পোরজনায় যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু করেন। পরবর্তীতে আরও ১৫ জন যোদ্ধাসহ মোট ৩০ জন যুবকদের নিয়ে শাহজাদপুর গার্লস হাইস্কুলের ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এ ট্রেনিংয়ে সাবেক গণপরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. আব্দুর রহমান তাকে সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করেন এবং ২৩ শে মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার নগরবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্রথমে পাকবাহিনী আকাশ থেকে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে ইপিআর, আনসার সদস্য ও সহযোদ্ধারা পালিয়ে যায়। পাকবাহিনী আরিচা ঘাট থেকে বাঘাবাড়িকে লক্ষ্য করে ব্যাপক মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। ফলে পুরো এলাকা জনশূণ্য হয়ে পড়ে। পরের দিন পাকবাহিনীর একটি বিশাল দল ফেরিতে করে বাঘাবাড়ী অবস্থান করে এবং প্রবল বেগে আক্রমন করে। বাঘাবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আব্দুল হাইসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা একটি আধাপাকা ঘরে অল্প সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান করে আক্রমন করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সামনে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে, সুযোগ বুঝে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমন চালালে পাকিস্তানিরা পিছু হটে অনেক আধুনিক অস্ত্রসন্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। কিন্তু, এসব আধুনিক অস্ত্র সেসময় সবাই চালাতে পারতো না। তখন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এ অস্ত্র চালানোর দায়িত্ব আব্দুল হাইকে দেন। ৯ মাসে মুলাডুলি, ধানাইদহ, বিড়ালদহ ও নাটোরসহ ১২ স্থানে পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন আব্দুল হাই এবং তিনি মর্টারশেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন।
১৯৭১ সালে আব্দুল হাই ভারতের বালুরঘাটে চলে যান। সেখান থেকে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার কেয়াডাঙ্গা হাইস্কুল ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ওই ক্যাম্পে অবস্থানকালে তার শরীরে থাকা মর্টারশেলের স্প্লিন্টার বের করা হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি কোলকাতা থেকে শিলিগুঁড়ি এবং সেখান থেকে বিমানে করে উত্তর প্রদেশ ও দেরাদুনে চলে এসে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে চলে আসেন এবং ১০ জনের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তিনি ধীতপুরে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করেন। তাদের সাথে জামায়াতি রাজাকারেরাও পরাজিত হয় এবং তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে একটি ক্যাম্পে রাখা হয়।

তিনি স্মৃতিচারণে বলেন, জামায়াতি রাজাকারেরা গ্রামে গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য সর্বদাই তারা ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি আক্ষেপ করেন বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বহু রাজাকারের বাড়িঘর অক্ষত থাকলেও আমার বাড়িতে ২ বার অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে আমাকে সর্বশান্ত করা হয়। তিনি স্মৃতিচারণের সময় আবেগত্বারিত হয়ে বলেন, ১৯৭০ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের একটি মিটিংয়ে তিনি নিজ হাতে ফুলের মালা পড়িয়ে দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই দেশ মাতৃকার কথা চিন্তা করে সরকারিভাবে কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহন করেননি। উপরন্তু, ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেয়ার কথা চিন্তা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি আয়কর আইনজীবী পেশাকেই বেছে নেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে বহু মুক্তিযোদ্ধা নানাভাবে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও তিনি দেশের জন্য জীবন যৌবন শেষ করে দিয়েছেন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্ট করে যাবেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়েও তিনি সংশয় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বা/খ: এসআর।

নিউজটি শেয়ার করুন

৭১’এর আত্মত্যাগী এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা 

আপডেট সময় : ০৮:৫৬:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক :

পশ্চিমা শাষকদের যাতাকলে নিরীহ বাঙালি যখন নিঃষ্পেষিত, নির্যাতিত হচ্ছে ঠিক তখনই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মোঃ আব্দুল হাই। তখন তার বয়স ২০ বছর। তিনি তার পরিবারকে না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তার বাবার নাম মৃত হাজী আব্দুল গফুর। গ্রামের বাড়ি শাহজাদপুরের উল্টাডাব গ্রামে। তিনি তখন শাহজাদপুর কলেজে মাধ্যমিকের ছাত্র।

১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ ১৫ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি পোরজনায় যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু করেন। পরবর্তীতে আরও ১৫ জন যোদ্ধাসহ মোট ৩০ জন যুবকদের নিয়ে শাহজাদপুর গার্লস হাইস্কুলের ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এ ট্রেনিংয়ে সাবেক গণপরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. আব্দুর রহমান তাকে সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করেন এবং ২৩ শে মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার নগরবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্রথমে পাকবাহিনী আকাশ থেকে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে ইপিআর, আনসার সদস্য ও সহযোদ্ধারা পালিয়ে যায়। পাকবাহিনী আরিচা ঘাট থেকে বাঘাবাড়িকে লক্ষ্য করে ব্যাপক মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। ফলে পুরো এলাকা জনশূণ্য হয়ে পড়ে। পরের দিন পাকবাহিনীর একটি বিশাল দল ফেরিতে করে বাঘাবাড়ী অবস্থান করে এবং প্রবল বেগে আক্রমন করে। বাঘাবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আব্দুল হাইসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা একটি আধাপাকা ঘরে অল্প সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান করে আক্রমন করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সামনে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে, সুযোগ বুঝে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমন চালালে পাকিস্তানিরা পিছু হটে অনেক আধুনিক অস্ত্রসন্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। কিন্তু, এসব আধুনিক অস্ত্র সেসময় সবাই চালাতে পারতো না। তখন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এ অস্ত্র চালানোর দায়িত্ব আব্দুল হাইকে দেন। ৯ মাসে মুলাডুলি, ধানাইদহ, বিড়ালদহ ও নাটোরসহ ১২ স্থানে পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন আব্দুল হাই এবং তিনি মর্টারশেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন।
১৯৭১ সালে আব্দুল হাই ভারতের বালুরঘাটে চলে যান। সেখান থেকে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার কেয়াডাঙ্গা হাইস্কুল ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ওই ক্যাম্পে অবস্থানকালে তার শরীরে থাকা মর্টারশেলের স্প্লিন্টার বের করা হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি কোলকাতা থেকে শিলিগুঁড়ি এবং সেখান থেকে বিমানে করে উত্তর প্রদেশ ও দেরাদুনে চলে এসে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে চলে আসেন এবং ১০ জনের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তিনি ধীতপুরে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করেন। তাদের সাথে জামায়াতি রাজাকারেরাও পরাজিত হয় এবং তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে একটি ক্যাম্পে রাখা হয়।

তিনি স্মৃতিচারণে বলেন, জামায়াতি রাজাকারেরা গ্রামে গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য সর্বদাই তারা ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি আক্ষেপ করেন বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বহু রাজাকারের বাড়িঘর অক্ষত থাকলেও আমার বাড়িতে ২ বার অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে আমাকে সর্বশান্ত করা হয়। তিনি স্মৃতিচারণের সময় আবেগত্বারিত হয়ে বলেন, ১৯৭০ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের একটি মিটিংয়ে তিনি নিজ হাতে ফুলের মালা পড়িয়ে দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই দেশ মাতৃকার কথা চিন্তা করে সরকারিভাবে কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহন করেননি। উপরন্তু, ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেয়ার কথা চিন্তা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি আয়কর আইনজীবী পেশাকেই বেছে নেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে বহু মুক্তিযোদ্ধা নানাভাবে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও তিনি দেশের জন্য জীবন যৌবন শেষ করে দিয়েছেন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্ট করে যাবেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়েও তিনি সংশয় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বা/খ: এসআর।