সমুদ্রের রানি মালদ্বীপে ক’য়েকটা দিন
- আপডেট সময় : ১১:৪৭:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ৭৭৫ বার পড়া হয়েছে
পৃথিবী অন্যতম নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমন্ডিত নীল জলরাশিতে অবস্থিত সার্কের অন্যতম দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ। সমুদ্রের বুক চিরে জেগে ওঠা সাদা বালুময় এক হাজারেরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। ৬ থেকে ৭ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিয়েছে।
কথিত রয়েছে বিশ্বের বুকে যতগুলো সুন্দর দেশ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি দেশ হলো এ মালদ্বীপ। আরও বলা হয়, সমুদ্রের রানি হলো মালদ্বীপ। মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহর একেবারেই ধুলাবালিমুক্ত। হোটেলে আসতে আসতে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র আকাশ চোখে আরামের পরশ বুলিয়ে দেয়। শহরে প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। নির্দিষ্ট রাস্তায় গাড়িগুলো দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। হোটেল থেকে ১৫-২০ মিনিটের রাস্তায় কোনো গাড়িতে হর্ণ বাজানোর দৃশ্যে চোখে পড়েনি। শুধু তাই নয়, রাস্তাঘাটে ধুলোবালির কনাও চোখে পড়লো না।
হুলহুমালে এলাকার হোটেলে পৌঁছে লাঞ্চ (দুপুরের খাবার) করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বাইরে বের হতেই প্রতিটি রাস্তা ও হোটেলে অসংখ্য বাংলাদেশি চোখে পড়ে। সামনে এগিয়ে যেতেই একজন বাংলাদেশি জানালেন সামনে হুলহুমালে নাইট মেলা বসেছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ঢুঁ মারতে পারেন। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ে মেলার দোকানপাটের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি। কেউ মালিক কেউবা কর্মচারী। মালদ্বীপে বসবাসরত বাংলাদেশিরাই এ মেলার প্রধান ক্রেতা।
একাধিক বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা কেউ পাঁচ বছর কেউবা ১০ বছর ধরে মালদ্বীপে এসেছেন। অধিকাংশই হোটেলে চাকরি করেন। খেয়ে পরে বেশ ভালেই আছেন। যারা হোটেলে ছোট চাকরি করেন তারাও সব খরচ মিটিয়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন।
জাকির হোসেন নামের এক প্রবাসী জানান, মালদ্বীপ খুবই এক্সপেনসিভ শহর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধনীরা এখানে বেড়াতে এসে বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ করেন। এখানে সবকিছুরই দাম বেশি। করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেলেও বর্তমানে পর্যটকের আগমন বেড়েছে। মালদ্বীপে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি দ্বীপ রয়েছে। যাদের প্রচুর অর্থবিত্ত রয়েছে, তারা বিমানবন্দরে নেমেই সরাসরি বিভিন্ন দ্বীপের রিসোর্ট ও হোটেলে চলে যান। মালদ্বীপে রাস্তার পাশে অসংখ্য প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। দেশটিতে অধিকাংশ মালদ্বীপিয়ান নারীদের বোরকা ও হিজাব পরে শালীনভাবে রাস্তায় বের হতে দেখা যায়।
রাজধানী মালের লোকাল মার্কেটটিতে প্রায় এক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন। ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিরামহীন গতিতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যান বাংলাদেশের প্রবাসীরা। এখানে বাজার করতে আসা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করে নিয়েছেন এ সব প্রবাসী ব্যাবসায়ীরা। তারা বিক্রি করছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফল-ফলাদি। সেইসঙ্গে মালদ্বীপের লোকাল মার্কেট এবং ফিশ মার্কেটগুলোতে কর্মস্থান দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশিদের আনাগোনার কারণেই রাজধানী মালের এই স্থানটিকে দেখলে মনে হয় ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাতেই নয়, মালদ্বীপের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন বাংলাদেশিরা।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৩ তারিখে আমিসহ একটি গ্রুপ ট্যুরে মালদ্বিপে গিয়েছিলাম আমরা। মালদ্বীপ যাব শুনে বন্ধুদের অনেকেই চোখ বড় করে তাকিয়েছিলেন। একজন তো দুষ্টামি করে বলেই ফেললেন, ওখানে তো শুনেছি বলিউড তারকারা একান্তে সময় কাটাতে যায়। আমাদের মতো লোকের সেখানে কী! মালদ্বীপ যাব বা যেতে পারব, এমন ভাবনা আমাদের মাথাতেও ছিল না। বলা যায় অনেকটা বাধ্য হয়েই আমাদের মালদ্বীপ যাওয়া। কোথাও যাই না কত দিন, দম বন্ধ হওয়ার দশা। করোনায় কারণে অনেকদিন বিরতি। এই সুযোগে কাছাকাছি কোথায় যাওয়া যায়, তার তত্ত¡-তালাশ করতে গিয়ে মালদ্বীপকেই বেছে নিতে হলো। নতুন গন্তব্য হিসেবে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
ভিসার ঝুকি সেখানে নেই। প্লেনের টিকিট কাটা ও হোটেল বুকিং দেওয়া, সময়মতো রওনা দিলেই হলো। দুপুর আড়াইটায় প্লেন, সে হিসেবে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। করোনার টিকার সনদ, ইমোগা প্রিন্ট কপি, ইমোগার প্রিন্ট আউট না থাকলে মালেতে যাওয়া তো পরের কথা, ঢাকা বিমানবন্দরই ছাড়া যাবে না।
আমাদের ৩ রাতের সফর। প্রথম দুই দিন মালের বাইরে কোনো দ্বীপে, আর আসার আগে এক রাত মালেতে কাটানোর পরিকল্পনা।
জানি মালদ্বীপ অনেক দ্বীপ নিয়ে তৈরি একটি দেশ। কিন্তু দেশটি আসলে কেমন সেই ধারণা প্রথম কিছুটা পেলাম রিসোর্ট/হোটেলের রুম বুক করতে গিয়ে। ম্যাপ দেখে বুঝলাম কোথায় প্লেন থেকে নামব। ভারত মহাসাগরে ছোট্ট একটা বিন্দু। ভেলানা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট রাজধানী মালের লাগোয়া হুলহুলে দ্বীপে। মালে আর হুলহুলে এখন সেতু দিয়ে যুক্ত। আমাদের হোটেল মিলল মালে শহরের কিছুটা দূরে হুলেমালে শহরে। এয়ারপোর্ট থেকে রাতে ১০ টায় হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে সৈকতে গিয়ে বসা। মন চাইলে সমুদ্রে নামা, না হলে বই পড়া, অথবা শুধুই বসে থাকা। টলটলে পানির নীল সমুদ্র। এমন জায়গায় আলস্য করে সারা দিন পার করে দেওয়া কোনো ব্যাপার না। চাইলে পানিতে নেমে স্নরকেলিং করা যায়, ডুব দিলেই দেখবেন কত রঙের মাছ আপনার চারপাশে। এর অভিজ্ঞতা ছিল না, স্নরকেলিং নেশা ধরিয়ে দিল, পানি থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। দুপুর গড়ালে আমাদের কাজ ছিল দ্বীপে হাঁটতে বের হওয়া।
মালদ্বীপের দ্বীপগুলোকে দুই নামে ডাকা হয়, লোকাল আইল্যান্ড আর রিসোর্ট আইল্যান্ড। লোকাল আইল্যান্ডে স্থানীয় জনগণ থাকে, আর রিসোর্ট আইল্যান্ডে শুধুই রিসোর্ট। আমাদেরটা লোকাল আইল্যান্ড। আগে এ ধরনের দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট করার অনুমতি দেওয়া হতো না, এখন দেওয়া হচ্ছে, তবে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এই দ্বীপে চারটি ছোট রিসোর্ট আছে, আছে একটি ক্যাফে ও দুটি ছোট রেস্তরাঁ। ঘুরতে ঘুরতে কোনো একটিতে বসে যেতাম, দুপুরের খাওয়া হয়ে যেত। লোকাল আইল্যান্ডে মজা হচ্ছে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশতে পারা, তাদের সঙ্গে কথা বলা; রিসোর্ট আইল্যান্ডে যে সুযোগ মিলবে না। রাতে রিসোর্টেই ডিনার। আবার সমুদ্রের পারে গিয়ে বসা। তবে রাতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল হোয়াইট রিফ শার্ক আর স্টিং রে। রিসোটের রেস্তরাঁর সামনের বাতি সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, রাত হলেই সেখানে ঘুরে বেড়ায় হোয়াইট রিফ শার্ক আর স্টিং রে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট অসংখ্য মাছের ঝাঁক। এই প্রকৃতির অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায়।
দুই রাত কেটে গেল এভাবেই। আইন-কানুনে মালদ্বীপ বেশ কড়া মুসলিম দেশ। পরদিন আমাদের ফিরে আসার পালা, গন্তব্য মালে। যাওয়ার সময় মালে দেখা হয়নি। ফেরার পথ এক রাতের জন্য এখানে আসা।
মালে শহর ঘুরে দেখি। ঢাকা নিয়ে আমার আগ্রহের কারণে দেশের বাইরে গেলে যে কোনো শহরকে সব সময় ঢাকার সঙ্গে তুলনা করি। মালে ঘনবসতির শহর, ছোট শহর, জায়গার সংকট আছে, রাস্তা সরু, তবুও শৃঙ্খলা আছে। মানুষ নিয়ম মেনে চলে। শহরটি পরিচ্ছন্ন। তবে শহরের কিছু জায়গায় বখাটে ছিনতাই কারীও আছে বটে। আমাদের মালদ্বীপ থেকে ফিরে আসার শেষ সময়ে একটি দুরঘর্টনার স্বীকার হলাম। আমাদের মালদ্বীপে আসার খবরে আমাদের বন্ধু-বান্ধবসহ নিজ জেলার অনেকে আমার হোটেলে দেখা করতে আসে। পরবর্তী আমরা বিকালে কয়েকজন মালদ্বীপের রাজধানী মালে বের হলাম। উদ্দেশ ছিল মালে শহরটা ঘুরে দেখা। হঠাৎ করে পেছন দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেল আমার হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি দু’জন ছিনতাইকারী নিয়ে যায়। সাথে থাকা মালদ্বীপের প্রবাসী বন্ধুরা পুলিশের হেল্পলাইনে ফোন দিয়ে বিষয়টি অবগত করলে। পুলিশও দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত জেনে আমাকে পুলিশ স্টেশনে আসতে অনুরোধ জানায়। পরে থানায় গেলে কর্তৃব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঘটনার আধা ঘন্টার মধ্যে মোবাইল ছিনতাইকারীকে চিহিৃত করে ফেলে।
তৎকানীক আমি থানায় বসা অবস্থায় ছিনতাইকারীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। কিছুক্ষণ পর আমার মোবাইলটা ফেরত দেওয়া হয়। আমিও তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেই। পরে থানা থেকে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে নৌ-ঘাটের কাছে একটি ফুড কোর্টে আসি। খোলা জায়গা। রাত তখন ১টা। এত রাতেও জমজমাট। ছেলে মেয়েরা সময় কাটাচ্ছে। শহরটি কতটা নিরাপদ সেটা টের পাওয়া যায়। আবারও ভাবি আমাদের বাংলাদেশে কি এমন কল্পনা করা যায়!
বা/খ/রা