ঢাকা ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

শেখ হাসিনার কৃষি দর্শন

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৩৫:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৪৩৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এক দীর্ঘ অনিশ্চিত সময় পার করে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নতুন নির্বাচিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণের একমাস পর ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন জিল্লুর রহমান। দেশের সব শীর্ষ ব্যক্তিদের সমাগম বঙ্গভবনে। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ শেষে অতিথি অ্যাপ্যায়ন পর্ব। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তখন ভিভিআইপি বেষ্টিত। নিরাপত্তা ও অভ্যাগত সুধীবৃন্দদের ডিঙিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সামনে চলে গেলাম। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, মাঘের শেষ দিন আজ। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। মাইক্রোফোনটি এগিয়ে দিলাম প্রধানমন্ত্রীর সামনে। স্মরণ করিয়ে দিলাম জনপ্রিয় খনার বচন। “যদি বর্ষে মাঘের শেষ” কানে যেতেই প্রধানমন্ত্রী পুরো দুই পংক্তি সমস্বরে উচ্চারণ করলেন। “যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পূণ্য দেশ”। দরবার হলের অভ্যাগতদের মনোযোগ তখন সেদিকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রকৃতি বলছে ফসল এবার ভালো হবে, আপনি কী বলেন?’ তিনি ওই মহিমান্বিত সভায় দেশের আগামী কর্মপরিকল্পনায় কৃষি সমৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখলেন।

আমি খুব বিশ্বাস নিয়ে চলি। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে কৃষি ও কৃষকের অবদানকে সবচেয়ে বড় করে দেখি। গভীরভাবে বিশ্বাস করি এই খাতের গোড়ায় পানি না দিলে দেশকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এগিয়ে নেয়া যাবে না। আমাদের সোনার খনি যদি থেকে থাকে তা কৃষির মধ্যেই আছে। যা হোক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে করতেই মন্ত্রিসভার প্রথম সভায় কৃষকের জন্য প্রধামন্ত্রীর প্রথম উপহারের ঘোষণা এলো। সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী। ৯০ টাকার ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি)-এর মূল্য কেজি প্রতি ২২ টাকা ও ৭০ টাকার মিউরেট অব পটাস (এমওপি)-এর মূল্য কেজি প্রতি ১৫ টাকায় নামিয়ে এনে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিলেন। এটি ছিল দেশের বিপুল কৃষি সম্ভাবনাকে সত্যিকারের সমৃদ্ধির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার এক অসাধারণ ব্যবস্থাপত্র। তার আগের কয়েক বছর আমি কৃষির বহুমুখি সংকট নিয়ে টেলিভিশনে একের পর এক চিত্র তুলে ধরছি। কখনো সার নেই, কখনো লাখ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি, কখনো কৃষকের বঞ্চনা, সরকারি ভর্তুকির অর্থ হাতে না পাওয়ার সরেজমিন গল্পগুলো। এর সঙ্গে ছিল প্রকৃতিক বিপর্যয়, অনিশ্চয়তা ও কৃষির প্রতি ব্যক্তিখাতের টানা উপেক্ষা। আমার কাছে মনে হলো টেলিভিশনে বা পত্রপত্রিকায় আমার তুলে ধরা বার্তাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কখনোই চোখ এড়ায় না। তার আগের সাত আটটি বছর তিনি যখন রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, কারা নির্যাতিত হচ্ছেন, রাজনৈতিকভাবে চরম উৎকন্ঠার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তখনও যে তিনি কৃষির দিকে তার গভীর মনোযোগ রেখেছিলেন, তা তার সঙ্গে পরবর্তীকালের আলাপচারিতায় বুঝতে পারি। বলতে দ্বিধা নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অনিশ্চিত সময়ে যখন আমার কাছে নীতি নির্ধারনী পর্যায় থেকে কৃষি প্রসঙ্গে পরামর্শ চাওয়া হতো তখন আমার একটাই বক্তব্য ছিল, কৃষি ও কৃষকের দিকে দৃষ্টি না দিলে দেশের সুরক্ষা হবে না। নীতি নির্ধারককে কৃষকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি আমার জায়গা থেকে যতটুকু টেনে আনা সম্ভব, নীতি নির্ধারকদের মাঠের দিকে আনতে চেয়েছি। সংকটের দিনে কৃষকের পক্ষে একাট্টা থাকার চেষ্টা করে গেছি। এখনও সেই জায়গাতেই আছি।

আমার জীবনের বড় এক অর্জন হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার কর্মবিশ্বাসের জায়গাটি উপলব্ধি করেছেন ও বারবার মূল্যায়ণ করেছেন। ২০০৯ এ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যেদিন তার কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাত পাই, সেদিন তিনি আমার অনুষ্ঠান নিয়েই দীর্ঘ সময় আলোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ১/১১ সরকারের কারাগারে থাকাকালীন তিনি নির্জন কারাকক্ষে বসে চ্যানেল আইতে নিয়মিত আমার অনুষ্ঠান দেখতেন। বিশেষ করে তার মাতৃ-পিতৃভূমি গোপালগঞ্জের ঘাঘর নদীর নৌকা বাইচের আয়োজনটি দেখে তিনি স্মৃতিকাতর হয়েছেন। বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী ওই নৌকা বাইচ আয়োজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্মৃতি রয়েছে। তার গোটা পরিবারেরই স্মৃতি রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাল্যস্মৃতিতে তা এখনও জ্বলজ্বল করে। ঘাঘর নদীর ব্রীজের ওপর তৈরি মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু নৌকা বাইচের বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার স্বরূপ তুলে দিতেন পিতলের কলস।

গত এক যুগের বেশি সময়ের পথ পরিক্রমায় বহুবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার এককভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। দীর্ঘক্ষণের বৈঠক হয়েছে। তিনি শুধু তার দায়িত্বের জায়গা থেকেই কৃষির ব্যাপারে তার নীতিদর্শন বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করেছেন তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে তার অসাধারণ কৃষিপ্রেমেরও প্রমাণ রেখেছেন বারবার। প্রচলিত অপ্রচলিত ফল ফসল ফুলের গাছ থেকে শুরু করে উদ্ভিদের অংকুরোদগম, পরাগায়ন কিংবা শংকরায়ণ সবকিছুই তার কাছে পরিস্কার। গণভবনের ভেতর তার নিজের কৃষি অনুশীলন নিয়েও কথা হয়েছে একাধিকবার। আমি সুযোগ খুঁজেছি প্রধামমন্ত্রীর কৃষি দর্শন ও অনুশীলন নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করার। নানা ব্যস্ততায় তিনি সময় সুযোগ করে উঠতে পারেননি। তবে স্বপ্ন আছে, একদিন সেই সুযোগটি আসবে। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন ও পদক্ষেপগুলো নিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান তথা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার সুযোগ পেয়েছি। জাতির জনকের গ্রামীন জীবন ভাবনা নিয়ে তৃণমূল কৃষকের প্রাণের কথা তুলে আনতে গিয়ে এমন কিছু বিষয় আমার সামনে এসেছে, যার ভেতর দিয়ে আমি বাংলার কৃষি সভ্যতা থেকে উঠে আসা একজন রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীনতার স্থপতি তথা রাষ্ট্রনায়কের পারিবারিক জীবনের গভীরতা দেখতে পেয়েছি। যেখানে বঙ্গবন্ধু নয় শুধু তার মা বাবা থেকে শুরু করে পূর্বপ্রজন্মের গ্রামের তৃণমূল কৃষক শ্রেণির প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের প্রতিচ্ছবি দেখেছি। কৃষির সেই দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা দর্শন যাই বলি না কেন তার প্রতিফলন প্রধানমন্ত্রীর মাঝেও পেয়েছি।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। এক প্রবীণ কৃষক মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। ডেকে বললাম, বঙ্গবন্ধুর কোনো স্মৃতি মনে আছে? কথা শুনেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে তার বাড়ির দিকে চল্লেন; স্মৃতি হাতড়ে বাল্যবেলার এক গল্প তুলে ধরলেন। “এক শবেবরাতে ঘরে কোনো খাবার নেই। চলে গেলাম মুজিব ভাইয়ের বাড়ি। মুজিব ভাইয়ের মার কাছে গিয়ে বললাম, শবে বরাতের শিন্নি করার কিছু নেই। তিনি মায়ের মতো ধমক দিয়ে বললেন, কিছু নেই তো আমি কি করবো? তারপর কিছু পরিমাণ আতপ চাল ও দুটি নারকেল দিলেন। একটা নারকেল খাওয়া হলো। অন্যটাতে গেঁজ হয়ে যাওয়ায় মা বল্লো মাটিতে পুঁতে দে। ৬০-৭০ বছরের বেশি সময়ের সে নারিকেল গাছটি এখনো আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।” আমরা সেই নারকেল গাছটি দেখতে পেলাম। এমন জীবন্ত স্মৃতি টুঙ্গিপাড়ার ঘরে ঘরে আছে। শেখ পরিবারের মহানুভবতার স্মৃতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই পরিবারেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি। বলা বাহুল্য বঙ্গবন্ধু কৃষি দর্শন বাস্তবায়নের সুনিপুন কারিগর। ওই পরিবারের আরেক প্রতিনিধি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা। তিনি গ্রাম বাংলার তথা তার নিজ গ্রামের সব ঐতিহ্যগুলো গভীরভাবে লালন করেন। ছোট আপার সঙ্গে বহুবার গ্রামীন জীবন ও কৃষির নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। সত্যিই দেশের জীবন ব্যবস্থার সকল স্তরেই তাদের দৃষ্টি আছে।

অনেকে অনেকভাবে বলেন। আমি বলি আমার মতো করে। যা নিজের মতো করে দেখতে পাই, তা বিশ্বাস করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসামান্য কৃষিদর্শন এ সরকারের কর্ম পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ২০০৯ সাল থেকেই হিসাব করি। প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ টন। তার নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ অনুযায়ী ‘রূপকল্প ২০২১’ অনুযায়ী কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালু করা, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা বাড়ানো, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, আমাদের কৃষি ও কৃষকের সংকটগুলো একটু মনোযোগী বা আন্তরিক হলোই চোখে দেখা যায়। উপলব্ধি করা যায়। কৃষক যুগ যুগ ধরে তার মনের কথা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকের কাছে পৌছতে পারেনি। এই ব্যবধানের জায়গাটি আমরা যখন ঘুঁচাতে গেছি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকুণ্ঠ আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। বিশ্ব মোড়লেরা যখন জাতীয় বাজেটে কৃষি ও কৃষকের জন্য ভর্তুকিসুবিধা তুলে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সরকার তখন তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রমাণ করেছে কৃষকের সংকটটি ওপর থেকে দেখা যায় না, বরং নীচ থেকে বা কৃষকের জায়গা থেকেই উপলব্ধি করতে হয়। আর তাই খাদ্য ঘাটতির হতাশা মুক্ত হতে পেরেছে দেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে সরকারি হিসেব অনুযায়ী খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন।

এর বাইরেও গত কয়েক বছরে পৃথিবীর চিন্তকদের কাছে বাংলাদেশ এক বিস্ময় হয়ে উঠেছে। এই বিস্ময়ের কারণ কী? কারণ হচ্ছে, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার দর্শন। সত্যি এটি এক বিস্ময়কর কর্মপরিকল্পনা। কোভিড ১৯ অতিমারি যখন পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে তখন বাংলাদেশ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল স্তরে উন্নীত হওয়ার শুভ পর্যায় উদযাপন করছে। আমরা দেখলাম, কোভিডের শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়লেন সারাদেশে। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যদিন তৃণমূলের খোঁজ রাখাই প্রধান কাজ হয়ে উঠলো তার। একদিকে আপদকালীন প্রণোদনা সহায়তা আরেকদিকে মাঠের উৎপাদন ব্যবস্থার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ঘরের খাদ্য নিশ্চিত রাখার ক্ষেত্রে এক যাদুকরি অবস্থান নিলেন। ফলত পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আতংক আর মন্দার ভেতরও আমরা রইলাম কোমর সোজা করে। মানতেই হবে কোভিড কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু কিন্তু তারপরও আমাদের কাছ সবচেয়ে বড় শিক্ষা রেখে গেছে, বিপর্যয়ে সাহস রাখাই নেতৃত্বের কাজ। যেটি রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সাহসেই সাহসী থেকেছে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষ।

আজ বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন তথা কৃষি সাফল্যে পৃথিবীতে অসাধারণ এক জায়গা করে নিয়েছে। দেশ তার অর্জনের হিসেব করছে এভাবে যে, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, পাট উৎপাদনে ২য়, অভ্যন্তরীণ মুক্তজলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে অবস্থান করে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমাদৃত। বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আমি এসব হিসাবকে বড় করে দেখতে চাই না। বড় করে দেখতে চাই, দেশের তৃণমূল মানুষের সাধ্য, ক্রয় ক্ষমতা, পোশাক পরিচ্ছদ, অধিকার বুঝে নেয়ার সাহস ইত্যাদি। এই জায়গা থেকে দেখলে অবশ্যই নেতৃত্বের দৃঢ়তার কথা উচ্চারণ করতে হবে। সরকার ও সরকার প্রধানের দূরদর্শী ও বিরামহীন কর্মসাফল্যের কথা তুলে আনতে হবে।

তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সারা পৃথিবীই খাদ্য সংকট তথা অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি। আগামীতে আমরা খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরণের ধাক্কার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী যে এসব পরিস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, তা বোঝা যায়।

আমি বলতে চাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি আমরা দেখছি তার চেয়ে বেশি অগ্রগতি থাকা দরকার ছিল। যতদূর স্বপ্ন কৃষক দেখেন বা যতদূর স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দেখেন ততদূর সফলতা আমরা এখনও পাইনি। পাইনি বলেই প্রধানমন্ত্রী এখনও দৃঢ়চিত্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্ষুধা দারিদ্র দূর করা আর নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে গোটা পৃথিবীর সামনেই নতুন নতুন ব্যবস্থাপত্র তুলে ধরেন। বর্তমান ও আগামীর কর্মপরিকল্পনার ভেতর কৃষি গবেষণাকে রাখেন বিশেষ গুরুত্বের জায়গায়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নে কৃষকের অসন্তুষ্টির বিষয়টি তিনিও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। গত কয়েক বছর প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনগুলোতে আমার হাজির থাকার সুযোগ হয়। কৃষির অনেক বিষয়েই আমি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করি। দেখেছি প্রশ্ন যত গভীর হোক, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি, উপলব্ধি বা চিন্তা সেখানে আছে। বারবার আশান্বিত হই, একটি সংকট সরকারপ্রধানের দৃষ্টিতে থাকা মানেই, সমাধানের পথটিও নিশ্চয়ই তার মাথায় রয়েছে। এই তো কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, আশ্রায়ণ প্রকল্পে আবাসনপ্রাপ্ত মানুষের আঙ্গিনায় কৃষি অনুশীলনের কথা। বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প এক অসাধারণ উদ্ভাবনী উদ্যোগ। তৃণমূলের গৃহহীন জনগোষ্ঠীকে জীবন জীবিকার নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্যে আনার মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পুরণে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

আমি কৃষি নিয়ে কাজ করি বলে, এ বিষয়কে সামনে রেখেই সবকিছু মূল্যায়ন করি। প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতি সবসময় রাখেন তার গভীর দৃষ্টি। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আমার মাঝে কথা হয়। তার কাছে জেনেছি, দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে যেকোনো প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর সামনে গেলে তিনি সেই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন।

আমি বারবার অভিভূত হই, প্রধানমন্ত্রী আমার অনুষ্ঠানে তুলে ধরা বিষয়গুলোতে আন্তরিক দৃষ্টি রাখছেন দেখে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পর গত কয়েক বছর দ্বিতীয় দফায় চ্যানেল আইতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক অনুষ্ঠানে ছাদকৃষি শুরু করার পর প্রধানমন্ত্রী বহু জায়গায় ছাদকৃষি তথা নগরকৃষির কথা তুলে ধরেছেন। করোনাকালে গৃহবন্দী মানুষকে ছাদকৃষিতে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন, তারও আগে তিনি নাগরিক শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার আয়োজন দেখে বিভিন্ন শিক্ষার্থী তথা শ্রেণিপেশার মানুষকে গ্রামে গিয়ে কৃষি অনুশীলনের তাগিদ দিয়েছেন। আর আমাকে তো সারাজীবনের তরে কৃতজ্ঞ করেছেন, এই কথা বলে যে, ‘আপনার অনুষ্ঠান থেকে আমরাও অনেক কিছু শিখি’। আমি বলবো, মাটির শিক্ষায় শিক্ষিত একজন প্রকৃত নেতাই এমন কথা বলতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

শেখ হাসিনার কৃষি দর্শন

আপডেট সময় : ১০:৩৫:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

এক দীর্ঘ অনিশ্চিত সময় পার করে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নতুন নির্বাচিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণের একমাস পর ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন জিল্লুর রহমান। দেশের সব শীর্ষ ব্যক্তিদের সমাগম বঙ্গভবনে। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ শেষে অতিথি অ্যাপ্যায়ন পর্ব। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তখন ভিভিআইপি বেষ্টিত। নিরাপত্তা ও অভ্যাগত সুধীবৃন্দদের ডিঙিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সামনে চলে গেলাম। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, মাঘের শেষ দিন আজ। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। মাইক্রোফোনটি এগিয়ে দিলাম প্রধানমন্ত্রীর সামনে। স্মরণ করিয়ে দিলাম জনপ্রিয় খনার বচন। “যদি বর্ষে মাঘের শেষ” কানে যেতেই প্রধানমন্ত্রী পুরো দুই পংক্তি সমস্বরে উচ্চারণ করলেন। “যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পূণ্য দেশ”। দরবার হলের অভ্যাগতদের মনোযোগ তখন সেদিকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রকৃতি বলছে ফসল এবার ভালো হবে, আপনি কী বলেন?’ তিনি ওই মহিমান্বিত সভায় দেশের আগামী কর্মপরিকল্পনায় কৃষি সমৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখলেন।

আমি খুব বিশ্বাস নিয়ে চলি। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে কৃষি ও কৃষকের অবদানকে সবচেয়ে বড় করে দেখি। গভীরভাবে বিশ্বাস করি এই খাতের গোড়ায় পানি না দিলে দেশকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এগিয়ে নেয়া যাবে না। আমাদের সোনার খনি যদি থেকে থাকে তা কৃষির মধ্যেই আছে। যা হোক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে করতেই মন্ত্রিসভার প্রথম সভায় কৃষকের জন্য প্রধামন্ত্রীর প্রথম উপহারের ঘোষণা এলো। সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী। ৯০ টাকার ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি)-এর মূল্য কেজি প্রতি ২২ টাকা ও ৭০ টাকার মিউরেট অব পটাস (এমওপি)-এর মূল্য কেজি প্রতি ১৫ টাকায় নামিয়ে এনে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিলেন। এটি ছিল দেশের বিপুল কৃষি সম্ভাবনাকে সত্যিকারের সমৃদ্ধির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার এক অসাধারণ ব্যবস্থাপত্র। তার আগের কয়েক বছর আমি কৃষির বহুমুখি সংকট নিয়ে টেলিভিশনে একের পর এক চিত্র তুলে ধরছি। কখনো সার নেই, কখনো লাখ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি, কখনো কৃষকের বঞ্চনা, সরকারি ভর্তুকির অর্থ হাতে না পাওয়ার সরেজমিন গল্পগুলো। এর সঙ্গে ছিল প্রকৃতিক বিপর্যয়, অনিশ্চয়তা ও কৃষির প্রতি ব্যক্তিখাতের টানা উপেক্ষা। আমার কাছে মনে হলো টেলিভিশনে বা পত্রপত্রিকায় আমার তুলে ধরা বার্তাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কখনোই চোখ এড়ায় না। তার আগের সাত আটটি বছর তিনি যখন রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, কারা নির্যাতিত হচ্ছেন, রাজনৈতিকভাবে চরম উৎকন্ঠার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তখনও যে তিনি কৃষির দিকে তার গভীর মনোযোগ রেখেছিলেন, তা তার সঙ্গে পরবর্তীকালের আলাপচারিতায় বুঝতে পারি। বলতে দ্বিধা নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অনিশ্চিত সময়ে যখন আমার কাছে নীতি নির্ধারনী পর্যায় থেকে কৃষি প্রসঙ্গে পরামর্শ চাওয়া হতো তখন আমার একটাই বক্তব্য ছিল, কৃষি ও কৃষকের দিকে দৃষ্টি না দিলে দেশের সুরক্ষা হবে না। নীতি নির্ধারককে কৃষকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি আমার জায়গা থেকে যতটুকু টেনে আনা সম্ভব, নীতি নির্ধারকদের মাঠের দিকে আনতে চেয়েছি। সংকটের দিনে কৃষকের পক্ষে একাট্টা থাকার চেষ্টা করে গেছি। এখনও সেই জায়গাতেই আছি।

আমার জীবনের বড় এক অর্জন হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার কর্মবিশ্বাসের জায়গাটি উপলব্ধি করেছেন ও বারবার মূল্যায়ণ করেছেন। ২০০৯ এ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যেদিন তার কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাত পাই, সেদিন তিনি আমার অনুষ্ঠান নিয়েই দীর্ঘ সময় আলোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ১/১১ সরকারের কারাগারে থাকাকালীন তিনি নির্জন কারাকক্ষে বসে চ্যানেল আইতে নিয়মিত আমার অনুষ্ঠান দেখতেন। বিশেষ করে তার মাতৃ-পিতৃভূমি গোপালগঞ্জের ঘাঘর নদীর নৌকা বাইচের আয়োজনটি দেখে তিনি স্মৃতিকাতর হয়েছেন। বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী ওই নৌকা বাইচ আয়োজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্মৃতি রয়েছে। তার গোটা পরিবারেরই স্মৃতি রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাল্যস্মৃতিতে তা এখনও জ্বলজ্বল করে। ঘাঘর নদীর ব্রীজের ওপর তৈরি মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু নৌকা বাইচের বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার স্বরূপ তুলে দিতেন পিতলের কলস।

গত এক যুগের বেশি সময়ের পথ পরিক্রমায় বহুবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার এককভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। দীর্ঘক্ষণের বৈঠক হয়েছে। তিনি শুধু তার দায়িত্বের জায়গা থেকেই কৃষির ব্যাপারে তার নীতিদর্শন বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করেছেন তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে তার অসাধারণ কৃষিপ্রেমেরও প্রমাণ রেখেছেন বারবার। প্রচলিত অপ্রচলিত ফল ফসল ফুলের গাছ থেকে শুরু করে উদ্ভিদের অংকুরোদগম, পরাগায়ন কিংবা শংকরায়ণ সবকিছুই তার কাছে পরিস্কার। গণভবনের ভেতর তার নিজের কৃষি অনুশীলন নিয়েও কথা হয়েছে একাধিকবার। আমি সুযোগ খুঁজেছি প্রধামমন্ত্রীর কৃষি দর্শন ও অনুশীলন নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করার। নানা ব্যস্ততায় তিনি সময় সুযোগ করে উঠতে পারেননি। তবে স্বপ্ন আছে, একদিন সেই সুযোগটি আসবে। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন ও পদক্ষেপগুলো নিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান তথা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার সুযোগ পেয়েছি। জাতির জনকের গ্রামীন জীবন ভাবনা নিয়ে তৃণমূল কৃষকের প্রাণের কথা তুলে আনতে গিয়ে এমন কিছু বিষয় আমার সামনে এসেছে, যার ভেতর দিয়ে আমি বাংলার কৃষি সভ্যতা থেকে উঠে আসা একজন রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীনতার স্থপতি তথা রাষ্ট্রনায়কের পারিবারিক জীবনের গভীরতা দেখতে পেয়েছি। যেখানে বঙ্গবন্ধু নয় শুধু তার মা বাবা থেকে শুরু করে পূর্বপ্রজন্মের গ্রামের তৃণমূল কৃষক শ্রেণির প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের প্রতিচ্ছবি দেখেছি। কৃষির সেই দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা দর্শন যাই বলি না কেন তার প্রতিফলন প্রধানমন্ত্রীর মাঝেও পেয়েছি।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। এক প্রবীণ কৃষক মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। ডেকে বললাম, বঙ্গবন্ধুর কোনো স্মৃতি মনে আছে? কথা শুনেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে তার বাড়ির দিকে চল্লেন; স্মৃতি হাতড়ে বাল্যবেলার এক গল্প তুলে ধরলেন। “এক শবেবরাতে ঘরে কোনো খাবার নেই। চলে গেলাম মুজিব ভাইয়ের বাড়ি। মুজিব ভাইয়ের মার কাছে গিয়ে বললাম, শবে বরাতের শিন্নি করার কিছু নেই। তিনি মায়ের মতো ধমক দিয়ে বললেন, কিছু নেই তো আমি কি করবো? তারপর কিছু পরিমাণ আতপ চাল ও দুটি নারকেল দিলেন। একটা নারকেল খাওয়া হলো। অন্যটাতে গেঁজ হয়ে যাওয়ায় মা বল্লো মাটিতে পুঁতে দে। ৬০-৭০ বছরের বেশি সময়ের সে নারিকেল গাছটি এখনো আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।” আমরা সেই নারকেল গাছটি দেখতে পেলাম। এমন জীবন্ত স্মৃতি টুঙ্গিপাড়ার ঘরে ঘরে আছে। শেখ পরিবারের মহানুভবতার স্মৃতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই পরিবারেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি। বলা বাহুল্য বঙ্গবন্ধু কৃষি দর্শন বাস্তবায়নের সুনিপুন কারিগর। ওই পরিবারের আরেক প্রতিনিধি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা। তিনি গ্রাম বাংলার তথা তার নিজ গ্রামের সব ঐতিহ্যগুলো গভীরভাবে লালন করেন। ছোট আপার সঙ্গে বহুবার গ্রামীন জীবন ও কৃষির নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। সত্যিই দেশের জীবন ব্যবস্থার সকল স্তরেই তাদের দৃষ্টি আছে।

অনেকে অনেকভাবে বলেন। আমি বলি আমার মতো করে। যা নিজের মতো করে দেখতে পাই, তা বিশ্বাস করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসামান্য কৃষিদর্শন এ সরকারের কর্ম পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ২০০৯ সাল থেকেই হিসাব করি। প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ টন। তার নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ অনুযায়ী ‘রূপকল্প ২০২১’ অনুযায়ী কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালু করা, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা বাড়ানো, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, আমাদের কৃষি ও কৃষকের সংকটগুলো একটু মনোযোগী বা আন্তরিক হলোই চোখে দেখা যায়। উপলব্ধি করা যায়। কৃষক যুগ যুগ ধরে তার মনের কথা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকের কাছে পৌছতে পারেনি। এই ব্যবধানের জায়গাটি আমরা যখন ঘুঁচাতে গেছি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকুণ্ঠ আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। বিশ্ব মোড়লেরা যখন জাতীয় বাজেটে কৃষি ও কৃষকের জন্য ভর্তুকিসুবিধা তুলে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সরকার তখন তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রমাণ করেছে কৃষকের সংকটটি ওপর থেকে দেখা যায় না, বরং নীচ থেকে বা কৃষকের জায়গা থেকেই উপলব্ধি করতে হয়। আর তাই খাদ্য ঘাটতির হতাশা মুক্ত হতে পেরেছে দেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে সরকারি হিসেব অনুযায়ী খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন।

এর বাইরেও গত কয়েক বছরে পৃথিবীর চিন্তকদের কাছে বাংলাদেশ এক বিস্ময় হয়ে উঠেছে। এই বিস্ময়ের কারণ কী? কারণ হচ্ছে, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার দর্শন। সত্যি এটি এক বিস্ময়কর কর্মপরিকল্পনা। কোভিড ১৯ অতিমারি যখন পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে তখন বাংলাদেশ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল স্তরে উন্নীত হওয়ার শুভ পর্যায় উদযাপন করছে। আমরা দেখলাম, কোভিডের শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়লেন সারাদেশে। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যদিন তৃণমূলের খোঁজ রাখাই প্রধান কাজ হয়ে উঠলো তার। একদিকে আপদকালীন প্রণোদনা সহায়তা আরেকদিকে মাঠের উৎপাদন ব্যবস্থার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ঘরের খাদ্য নিশ্চিত রাখার ক্ষেত্রে এক যাদুকরি অবস্থান নিলেন। ফলত পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আতংক আর মন্দার ভেতরও আমরা রইলাম কোমর সোজা করে। মানতেই হবে কোভিড কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু কিন্তু তারপরও আমাদের কাছ সবচেয়ে বড় শিক্ষা রেখে গেছে, বিপর্যয়ে সাহস রাখাই নেতৃত্বের কাজ। যেটি রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সাহসেই সাহসী থেকেছে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষ।

আজ বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন তথা কৃষি সাফল্যে পৃথিবীতে অসাধারণ এক জায়গা করে নিয়েছে। দেশ তার অর্জনের হিসেব করছে এভাবে যে, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, পাট উৎপাদনে ২য়, অভ্যন্তরীণ মুক্তজলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে অবস্থান করে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমাদৃত। বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আমি এসব হিসাবকে বড় করে দেখতে চাই না। বড় করে দেখতে চাই, দেশের তৃণমূল মানুষের সাধ্য, ক্রয় ক্ষমতা, পোশাক পরিচ্ছদ, অধিকার বুঝে নেয়ার সাহস ইত্যাদি। এই জায়গা থেকে দেখলে অবশ্যই নেতৃত্বের দৃঢ়তার কথা উচ্চারণ করতে হবে। সরকার ও সরকার প্রধানের দূরদর্শী ও বিরামহীন কর্মসাফল্যের কথা তুলে আনতে হবে।

তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সারা পৃথিবীই খাদ্য সংকট তথা অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি। আগামীতে আমরা খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরণের ধাক্কার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী যে এসব পরিস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, তা বোঝা যায়।

আমি বলতে চাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি আমরা দেখছি তার চেয়ে বেশি অগ্রগতি থাকা দরকার ছিল। যতদূর স্বপ্ন কৃষক দেখেন বা যতদূর স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দেখেন ততদূর সফলতা আমরা এখনও পাইনি। পাইনি বলেই প্রধানমন্ত্রী এখনও দৃঢ়চিত্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্ষুধা দারিদ্র দূর করা আর নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে গোটা পৃথিবীর সামনেই নতুন নতুন ব্যবস্থাপত্র তুলে ধরেন। বর্তমান ও আগামীর কর্মপরিকল্পনার ভেতর কৃষি গবেষণাকে রাখেন বিশেষ গুরুত্বের জায়গায়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নে কৃষকের অসন্তুষ্টির বিষয়টি তিনিও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। গত কয়েক বছর প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনগুলোতে আমার হাজির থাকার সুযোগ হয়। কৃষির অনেক বিষয়েই আমি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করি। দেখেছি প্রশ্ন যত গভীর হোক, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি, উপলব্ধি বা চিন্তা সেখানে আছে। বারবার আশান্বিত হই, একটি সংকট সরকারপ্রধানের দৃষ্টিতে থাকা মানেই, সমাধানের পথটিও নিশ্চয়ই তার মাথায় রয়েছে। এই তো কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, আশ্রায়ণ প্রকল্পে আবাসনপ্রাপ্ত মানুষের আঙ্গিনায় কৃষি অনুশীলনের কথা। বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প এক অসাধারণ উদ্ভাবনী উদ্যোগ। তৃণমূলের গৃহহীন জনগোষ্ঠীকে জীবন জীবিকার নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্যে আনার মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পুরণে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

আমি কৃষি নিয়ে কাজ করি বলে, এ বিষয়কে সামনে রেখেই সবকিছু মূল্যায়ন করি। প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতি সবসময় রাখেন তার গভীর দৃষ্টি। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আমার মাঝে কথা হয়। তার কাছে জেনেছি, দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে যেকোনো প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর সামনে গেলে তিনি সেই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন।

আমি বারবার অভিভূত হই, প্রধানমন্ত্রী আমার অনুষ্ঠানে তুলে ধরা বিষয়গুলোতে আন্তরিক দৃষ্টি রাখছেন দেখে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পর গত কয়েক বছর দ্বিতীয় দফায় চ্যানেল আইতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক অনুষ্ঠানে ছাদকৃষি শুরু করার পর প্রধানমন্ত্রী বহু জায়গায় ছাদকৃষি তথা নগরকৃষির কথা তুলে ধরেছেন। করোনাকালে গৃহবন্দী মানুষকে ছাদকৃষিতে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন, তারও আগে তিনি নাগরিক শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার আয়োজন দেখে বিভিন্ন শিক্ষার্থী তথা শ্রেণিপেশার মানুষকে গ্রামে গিয়ে কৃষি অনুশীলনের তাগিদ দিয়েছেন। আর আমাকে তো সারাজীবনের তরে কৃতজ্ঞ করেছেন, এই কথা বলে যে, ‘আপনার অনুষ্ঠান থেকে আমরাও অনেক কিছু শিখি’। আমি বলবো, মাটির শিক্ষায় শিক্ষিত একজন প্রকৃত নেতাই এমন কথা বলতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। সশ্রদ্ধ অভিবাদন।