ঢাকা ০৯:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

শাহজাদপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য-শেষ : অলী আউলিয়া দরবেশের শহর শাহজাদপুর

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:৩৯:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪৭৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শামছুর রহমান শিশিরঃ
অলী আউলিয়া সূফী সাধক ও দরবেশের শহর শাহজাদপুর। এটি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা । এখানে রয়েছে ইসলামী ঐতিহ্যের অপূর্ব ও অনুপম নিদর্শন। ইয়ামেনের শাসনকর্তা মোয়াজ-ইব্নে জাবাল এর বংশধর হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১২৯২-৯৬ ইং সালের মধ্যে সুদূর ইয়ামেন থেকে নিজ দেশ ত্যাগ করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ভাগ্নে খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) ,খাজা নূর (রহ:), খাজা আনওয়ার (রহ:), তাদের মাতা (মখদুম রহ: এর বোন),বারোজন প্রসিদ্ধ দরবেশ এবং কিছু সংখ্যক সহচরবৃন্দ্র। তাঁরা সবাই ৭ টি মতান্তরে ৪০ টি জাহাজ যোগে নদীপথে রওয়ানা হয়ে বোখারায় পৌঁছে তথাকার সাধক সুফী জালালউদ্দিন বোখারী (রহ:) এর সাথে সাক্ষাত করে কিছু সময় অতিবাহিত করে বাংলার এই অঞ্চলে আগমন করেন। হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ:) তাঁকে একজোড়া কবুতর উপহার দেন যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রমের পর অভিযাত্রী দলটির জাহাজ একস্থানে এসে ঠেকে যায়। যার বর্তমান নাম পোতাজিয়া (পোত আউজিয়া গিয়েছিল জন্য স্থানটির নামকরন করা হযেছে পোতাজিয়া)। স্থানটি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:)’র মাজার ও মসজিদের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমগ্র স্থানটি তখন ছিল পানির নীচে। কোনদিকেই স্থলভাগের চিহ্ন ছিল না। বোখারী কবুতরগুলি সকালে জাহাজ ত্যাগ করে সন্ধায় ফিরে আসতো। কয়েকদিন পরে জাহাজের লোকজন কবুতরের পায়ে পলিমাটি ও বালির সন্ধান পেয়ে অদূরে কোথাও চর জেগেছে ধারনায় কয়েকজন একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে কবুতরকে অনুসরণ করে একটি চরে পৌছান। পানি ক্রমশ: সরে যেতে থাকায় চরটি প্রশস্ত হতে থাকে এবং সেই চর এলাকাটিই পরবর্তীতে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর নামানুসারে শাহজাদপুর নাম ধারণ করে।

কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এতদ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুরে বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী তাঁর আগমনে শংকিত হয়ে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। রাজা বিক্রম কেশরী পরপর বেশ কয়েকবার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন কিন্তু প্রতি বারই তার সৈন্যবাহিনী পরাস্ত হয়ে ফেরত যায়। শেষ যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের একজন গুপ্তচর হিসাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর অত্যন্ত নিকটে স্থানলাভ করেন। একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) আছরের নামাজ আদায়কালে সিজদারত অবস্থায় ওই গুপ্তচর তাঁর মস্তক মোবারক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে সুরে বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোট মতান্তরে মহলকোটে রাজার নিকট নিয়ে যায়। তাঁর মস্তক মোবারক রাজার সামনে উপস্থিত করার পর দেখা যায় যে তাঁর ওষ্ঠাধর হতে অলৌকিকভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ উচ্চারিত হচ্ছে। এ ঘটনা দেখার পর রাজা ভীত সন্তস্থ হয়ে স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে তাঁর মস্তক মোবারক সমাহিত করার নির্দেশ দেন। রাজার প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তক মোবারক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তকবিহীন দেহ মোবারক শাহজাদপুর মসজিদের দশরশি দক্ষিণে তাঁর জীবিত ভাগ্নে শাহ নূর (রহ:) এবং অন্যান্য অনুচরগণকে দাফন করা হয় পাথরের কফিনের মধ্যে। পরে কফিনটি সরিয়ে বর্তমান স্থানে সমাহিত করা হয়।

হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) ও তাঁর ভাগ্নেদের মাজার ছাড়াও শাহজাদপুরে আরও দরবেশগণের ১৮ টি মাজার রয়েছে। তাঁরা হলেন, হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ.) ও মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমির মহান ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:), হযরত শাহ ইউসুফ (রহ:), হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ:), হযরত শাহ আজমত (রহ:), হযরত হাসিলা পীর (রহ:), হযরত শাহ বাদলা (রহ:)হযরত শাহ আহমেদ (রহ:), হযরত শাহ মাহমুদ (রহ:) এবং অপর চারজনের নাম জানা যায়নি। এ মাজারগুলি ছাড়াও আরও ৬ জন আবেদের মাজার দেখা যায় যারা সেখানে বেশ কিছুকাল বসবাসের পর মারা যান। তাঁরা হচ্ছেন, শাহ মাস্তান (রহ:), শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ:) (এই মাজারটি করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত) ,শাহ মাফাত (রহ:), হাদী সাহেব ও অপর দুই জনের নাম জানা যায়নি। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর এক ভাগ্নে শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) এর মাজার তাঁর মাজারের মাজারের ডান পাশে ,অপর ভাগ্নে এবং দরবেশগণের মাজার নিকটেই। হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:), শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) এবং দরবেশ শাহ ইউসুফ (রহ:) এর মাজার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যার উপরে অষ্টভূজাকৃতির টিনের চালা (বর্তমানে পাকা সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে)। জগৎ বরেণ্য অলী ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:) ছিলেন মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:) এর ওস্তাদ। হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:) এর ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি দেয়াল বেষ্টিত মাজার মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত (এর ওপরেও সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে)। হযরত শাহ ইউসুফ (রহ:) একজন সাহাবা ছিলেন। হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ:) এর আস্তানায় বাতি দেওয়া এবং তত্বাবধানের জন্য একজন বেতনভূক্ত খাদেম আছেন। উপরোক্ত মাজারসমূহ ছাড়া এখানে আরও ২টি করবস্থান আছে, একটি মসজিদ সংলগ্ন এবং অপরটি মসজিদ থেকে দশরশি দক্ষিণে যেখানে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কে প্রথম দাফন করা হয়েছিল। এই কবরস্থান দুটি ’গঞ্জে শহিদ’ নামে খ্যাত ছিল। এ সকল কবরের কোন ফলক নেই। মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি জলাশয় ছিল যা ’সতী বিবির খাল’ নামে পরিচিত। এই জলাশয়েই হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর বোন শত্রæর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে ঝাঁপ দেন এবং মারা যান। অনেকে তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য এখানে চিনি, বাতাসা নিক্ষেপ করতো (করতোয়া নদী গ্রাস করায় জলাশয়টির এখন চিহ্ন নেই)।

হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর নির্দেশে মখদুমিয়া জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ওই মসজিদের ভিতরের মাপ দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি ও উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি এবং বাইরের মাপ দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা প্রতিটির উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি। মসজিদটির মোট গুম্বুজের সংখ্যা ১৫ টি। মেঝে হতে গুম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ইট এবং চুনা দ্বারা মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি ধারণ করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪ টি স্তম্ভ। মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়াল সংলগ্ন রয়েছে ৭ টি ধাপসহ ছাদ বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের সামনে একটি পাকা চত্বর যা মসজিদের মেজের চাইতে এক ইঞ্চি নীচে। মসজিদের বাইরে এবং ভিতরে কারুকার্য আছে যা প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার। মখদুমিয়া জামে মসজিদটি এলাকায় গায়েবী মসজিদ নামে পরিচিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পাদন সম্পর্কে নানা জনশ্রæতি রয়েছে। শোনা যায়, মসজিদের বৃহত পাথরের স্তম্ভগুলি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:)’র নির্দেশে আরবদেশ থেকে পানির উপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়। এইরূপ জনশ্রতি অবাস্তব মনে হলেও মসজিদটি নির্মাণে অলৌকিকতার বেশ ছাপ পাওয়া যায়। যে ২৪ টি স্তম্ভের উপর মসজিদটি দন্ডায়মান ওই স্তম্ভের এক একটি পাথরের ওজন আনুমানিক ৫০ হতে ১০০ মণ। স্তম্ভগুলোর অধিকাংশই গোলাকার নকশা বিশিষ্ট। এই পাথরের স্তম্ভগুলি কোথা হতে কিভাবে আনা হলো, কেমন করে পাহাড় হতে এত বড় পাথরের স্তম্ভ বের করা হলো, তা ধারণাতীত। আমাদের দেশে এরূপ পাথরের পাহাড় নেই যেখান থেকে ওই স্তম্ভগুলি জোগাড় করা সম্ভব। দ্বিতীয়তঃ স্তম্ভগুলি মাপ মতো তৈরি, যথাস্থানে স্থাপন এবং একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর মতো যন্ত্রপাতি এবং উন্নত প্রযুক্তির তখন বেশ অভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি মসজিদকে অক্ষত রাখার মালমশলা যোগাড় করাও তখন অত্যন্ত দূরহ ছিল। রাজা বাদশাগণের পক্ষে এটা সম্ভব হলেও কতিপয় ধর্ম প্রচারক যাদের ধর্ম প্রচার ছাড়া কোন কারিগরী যোগ্যতা, দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা বা অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, তাঁদের দ্বারা এইরূপ একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন মোটেও সম্ভব নয়। এতএব, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কর্তৃক একটি উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ শহস্রাব্দী প্রাচীন এই মসজিদ নির্মাণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে বিশেষ গায়েবী সাহায্য ছিল তা অনস্বীকার্য! অনেকে মনে করেন মসজিদটির স্তম্ভগুলি কোন মন্দির হতে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এবং বৈরী ভাবাপন্ন একজন হিন্দু শাষকের (রাজা বিক্রম কেশরী)’র আমলে কতিপয় বহিরাগত মুসলমানদের পক্ষে হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে স্তম্ভগুলি যোগাড় করেছিলেন এমন ধারণাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই মসজিদটি নির্মানে মহান আল্লাহ্ সুবহানু তায়ালার যে বিশেষ গায়েবী মদদ ছিল এটা অনস্বীকার্য বলে মনে করেন বংশ পরম্পরায় চলে আসা শাহজাদপুরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ।

নিউজটি শেয়ার করুন

শাহজাদপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য-শেষ : অলী আউলিয়া দরবেশের শহর শাহজাদপুর

আপডেট সময় : ০৭:৩৯:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২

শামছুর রহমান শিশিরঃ
অলী আউলিয়া সূফী সাধক ও দরবেশের শহর শাহজাদপুর। এটি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা । এখানে রয়েছে ইসলামী ঐতিহ্যের অপূর্ব ও অনুপম নিদর্শন। ইয়ামেনের শাসনকর্তা মোয়াজ-ইব্নে জাবাল এর বংশধর হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১২৯২-৯৬ ইং সালের মধ্যে সুদূর ইয়ামেন থেকে নিজ দেশ ত্যাগ করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ভাগ্নে খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) ,খাজা নূর (রহ:), খাজা আনওয়ার (রহ:), তাদের মাতা (মখদুম রহ: এর বোন),বারোজন প্রসিদ্ধ দরবেশ এবং কিছু সংখ্যক সহচরবৃন্দ্র। তাঁরা সবাই ৭ টি মতান্তরে ৪০ টি জাহাজ যোগে নদীপথে রওয়ানা হয়ে বোখারায় পৌঁছে তথাকার সাধক সুফী জালালউদ্দিন বোখারী (রহ:) এর সাথে সাক্ষাত করে কিছু সময় অতিবাহিত করে বাংলার এই অঞ্চলে আগমন করেন। হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ:) তাঁকে একজোড়া কবুতর উপহার দেন যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রমের পর অভিযাত্রী দলটির জাহাজ একস্থানে এসে ঠেকে যায়। যার বর্তমান নাম পোতাজিয়া (পোত আউজিয়া গিয়েছিল জন্য স্থানটির নামকরন করা হযেছে পোতাজিয়া)। স্থানটি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:)’র মাজার ও মসজিদের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমগ্র স্থানটি তখন ছিল পানির নীচে। কোনদিকেই স্থলভাগের চিহ্ন ছিল না। বোখারী কবুতরগুলি সকালে জাহাজ ত্যাগ করে সন্ধায় ফিরে আসতো। কয়েকদিন পরে জাহাজের লোকজন কবুতরের পায়ে পলিমাটি ও বালির সন্ধান পেয়ে অদূরে কোথাও চর জেগেছে ধারনায় কয়েকজন একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে কবুতরকে অনুসরণ করে একটি চরে পৌছান। পানি ক্রমশ: সরে যেতে থাকায় চরটি প্রশস্ত হতে থাকে এবং সেই চর এলাকাটিই পরবর্তীতে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর নামানুসারে শাহজাদপুর নাম ধারণ করে।

কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এতদ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুরে বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী তাঁর আগমনে শংকিত হয়ে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। রাজা বিক্রম কেশরী পরপর বেশ কয়েকবার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন কিন্তু প্রতি বারই তার সৈন্যবাহিনী পরাস্ত হয়ে ফেরত যায়। শেষ যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের একজন গুপ্তচর হিসাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর অত্যন্ত নিকটে স্থানলাভ করেন। একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) আছরের নামাজ আদায়কালে সিজদারত অবস্থায় ওই গুপ্তচর তাঁর মস্তক মোবারক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে সুরে বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোট মতান্তরে মহলকোটে রাজার নিকট নিয়ে যায়। তাঁর মস্তক মোবারক রাজার সামনে উপস্থিত করার পর দেখা যায় যে তাঁর ওষ্ঠাধর হতে অলৌকিকভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ উচ্চারিত হচ্ছে। এ ঘটনা দেখার পর রাজা ভীত সন্তস্থ হয়ে স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে তাঁর মস্তক মোবারক সমাহিত করার নির্দেশ দেন। রাজার প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তক মোবারক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর মস্তকবিহীন দেহ মোবারক শাহজাদপুর মসজিদের দশরশি দক্ষিণে তাঁর জীবিত ভাগ্নে শাহ নূর (রহ:) এবং অন্যান্য অনুচরগণকে দাফন করা হয় পাথরের কফিনের মধ্যে। পরে কফিনটি সরিয়ে বর্তমান স্থানে সমাহিত করা হয়।

হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) ও তাঁর ভাগ্নেদের মাজার ছাড়াও শাহজাদপুরে আরও দরবেশগণের ১৮ টি মাজার রয়েছে। তাঁরা হলেন, হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ.) ও মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমির মহান ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:), হযরত শাহ ইউসুফ (রহ:), হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ:), হযরত শাহ আজমত (রহ:), হযরত হাসিলা পীর (রহ:), হযরত শাহ বাদলা (রহ:)হযরত শাহ আহমেদ (রহ:), হযরত শাহ মাহমুদ (রহ:) এবং অপর চারজনের নাম জানা যায়নি। এ মাজারগুলি ছাড়াও আরও ৬ জন আবেদের মাজার দেখা যায় যারা সেখানে বেশ কিছুকাল বসবাসের পর মারা যান। তাঁরা হচ্ছেন, শাহ মাস্তান (রহ:), শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ:) (এই মাজারটি করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত) ,শাহ মাফাত (রহ:), হাদী সাহেব ও অপর দুই জনের নাম জানা যায়নি। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর এক ভাগ্নে শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) এর মাজার তাঁর মাজারের মাজারের ডান পাশে ,অপর ভাগ্নে এবং দরবেশগণের মাজার নিকটেই। হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:), শহিদ খাজা কালীন দানিশ মন্দ (রহ:) এবং দরবেশ শাহ ইউসুফ (রহ:) এর মাজার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যার উপরে অষ্টভূজাকৃতির টিনের চালা (বর্তমানে পাকা সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে)। জগৎ বরেণ্য অলী ওস্তাদজী হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:) ছিলেন মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনী (রহ:) এর ওস্তাদ। হযরত শামসুদ্দীন তাবরিজী (রহ:) এর ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি দেয়াল বেষ্টিত মাজার মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত (এর ওপরেও সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে)। হযরত শাহ ইউসুফ (রহ:) একজন সাহাবা ছিলেন। হযরত শাহ কিং সওয়ার (রহ:) এর আস্তানায় বাতি দেওয়া এবং তত্বাবধানের জন্য একজন বেতনভূক্ত খাদেম আছেন। উপরোক্ত মাজারসমূহ ছাড়া এখানে আরও ২টি করবস্থান আছে, একটি মসজিদ সংলগ্ন এবং অপরটি মসজিদ থেকে দশরশি দক্ষিণে যেখানে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কে প্রথম দাফন করা হয়েছিল। এই কবরস্থান দুটি ’গঞ্জে শহিদ’ নামে খ্যাত ছিল। এ সকল কবরের কোন ফলক নেই। মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি জলাশয় ছিল যা ’সতী বিবির খাল’ নামে পরিচিত। এই জলাশয়েই হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর বোন শত্রæর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে ঝাঁপ দেন এবং মারা যান। অনেকে তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য এখানে চিনি, বাতাসা নিক্ষেপ করতো (করতোয়া নদী গ্রাস করায় জলাশয়টির এখন চিহ্ন নেই)।

হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) এর নির্দেশে মখদুমিয়া জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ওই মসজিদের ভিতরের মাপ দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি ও উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি এবং বাইরের মাপ দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা প্রতিটির উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি। মসজিদটির মোট গুম্বুজের সংখ্যা ১৫ টি। মেঝে হতে গুম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ইট এবং চুনা দ্বারা মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি ধারণ করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪ টি স্তম্ভ। মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়াল সংলগ্ন রয়েছে ৭ টি ধাপসহ ছাদ বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের সামনে একটি পাকা চত্বর যা মসজিদের মেজের চাইতে এক ইঞ্চি নীচে। মসজিদের বাইরে এবং ভিতরে কারুকার্য আছে যা প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার। মখদুমিয়া জামে মসজিদটি এলাকায় গায়েবী মসজিদ নামে পরিচিত। হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পাদন সম্পর্কে নানা জনশ্রæতি রয়েছে। শোনা যায়, মসজিদের বৃহত পাথরের স্তম্ভগুলি হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:)’র নির্দেশে আরবদেশ থেকে পানির উপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়। এইরূপ জনশ্রতি অবাস্তব মনে হলেও মসজিদটি নির্মাণে অলৌকিকতার বেশ ছাপ পাওয়া যায়। যে ২৪ টি স্তম্ভের উপর মসজিদটি দন্ডায়মান ওই স্তম্ভের এক একটি পাথরের ওজন আনুমানিক ৫০ হতে ১০০ মণ। স্তম্ভগুলোর অধিকাংশই গোলাকার নকশা বিশিষ্ট। এই পাথরের স্তম্ভগুলি কোথা হতে কিভাবে আনা হলো, কেমন করে পাহাড় হতে এত বড় পাথরের স্তম্ভ বের করা হলো, তা ধারণাতীত। আমাদের দেশে এরূপ পাথরের পাহাড় নেই যেখান থেকে ওই স্তম্ভগুলি জোগাড় করা সম্ভব। দ্বিতীয়তঃ স্তম্ভগুলি মাপ মতো তৈরি, যথাস্থানে স্থাপন এবং একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর মতো যন্ত্রপাতি এবং উন্নত প্রযুক্তির তখন বেশ অভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি মসজিদকে অক্ষত রাখার মালমশলা যোগাড় করাও তখন অত্যন্ত দূরহ ছিল। রাজা বাদশাগণের পক্ষে এটা সম্ভব হলেও কতিপয় ধর্ম প্রচারক যাদের ধর্ম প্রচার ছাড়া কোন কারিগরী যোগ্যতা, দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা বা অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, তাঁদের দ্বারা এইরূপ একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন মোটেও সম্ভব নয়। এতএব, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ:) কর্তৃক একটি উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ শহস্রাব্দী প্রাচীন এই মসজিদ নির্মাণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে বিশেষ গায়েবী সাহায্য ছিল তা অনস্বীকার্য! অনেকে মনে করেন মসজিদটির স্তম্ভগুলি কোন মন্দির হতে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এবং বৈরী ভাবাপন্ন একজন হিন্দু শাষকের (রাজা বিক্রম কেশরী)’র আমলে কতিপয় বহিরাগত মুসলমানদের পক্ষে হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে স্তম্ভগুলি যোগাড় করেছিলেন এমন ধারণাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই মসজিদটি নির্মানে মহান আল্লাহ্ সুবহানু তায়ালার যে বিশেষ গায়েবী মদদ ছিল এটা অনস্বীকার্য বলে মনে করেন বংশ পরম্পরায় চলে আসা শাহজাদপুরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ।