বিষ্ময়কর এক ফুল ও ফল ‘চালতা’!
- আপডেট সময় : ০৯:৩০:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ অক্টোবর ২০২২
- / ৪৪৩ বার পড়া হয়েছে

মো : শামছুর রহমান শিশির :
এক বিষ্ময়কর ফুল ও ফলের নাম হচ্ছে চালতা! বহুবিধ ঔসধিগুণ সম্পন্ন ওই চালতা ফুল ও ফলের বিকাশ ও পরিপূর্ণতা বড়ই সৌন্দর্যময় ও বৈচিত্রময় ! এমন ফল বড়ই দূরহ যাতে প্রথমে গুঁটি এবং পরে ফুল ও পরে পরিপূর্ণ ফলে পরিণত হয়। চালতা ফুল দেখতে বড়ই দৃষ্টিনন্দন যা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না ! এ ফল বহুবিধ ঔসধিগুণ সম্পন্ন হলেও মূলত এর ফল থেকে প্রস্তুত আচার দেশের নারীদের জন্য লোভনীয় ও মুখরোচক খাবার হিসাবে আজও ব্যাপক সমাদৃত। কিন্তু কালের আবর্তে সময়ের পরিধিতে অতি পরিচিত ওই ফল চালতা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে দেশপট থেকে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, চালতা’র বৈজ্ঞানিক নাম ডিলিনিয়া ইনডিকা (উরষষবহরধ ওহফরপধ)। এটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। চালতা ডিলিনিয়াসি (উরষষবহরধপবধব) গোত্রের। চালতার গুঁটিটা বড় আকৃতির হবার কারণে প্রাথমিক অবস্থায় অনেকে একে ফল মনে করেন, যা সঠিক নয়। ওই গুঁটির মধ্যেই চালতা ফুলের দলগুলো লুকায়িত থাকে।গুঁটি থেকে ফুল ফোঁটার পর মৌমাছির আনাগোনা ঘটে। মৌমাছিরা চালতা ফুল থেকে মধু আহরণের সময় চালতার ফুলের দল থেকে দলে বিচরণের ফলে পরাগায়ন ঘটে এবং গুঁটির ভিতরে থাকা দলগুলি বিকশিত হয় ও পুনরায় গুঁটিয়ে পরিপূর্ণ ফলে পরিণত হয়।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর এলাকার মণিরামপুর গ্রামের শফিকুর রহমান চপলের বাড়িতে রয়েছে চালতার গাছ। তিনি জানান, চালতা গাছে বছরে একবারই ফল ধরে। আষাঢ় মাসে সাধারণত চালতার ফল ধরে। প্রতিটি চালতা ফল ২৫০ গ্রাম থেকে প্রায় ১ কেজি ওজন হয়ে থাকে। চালতা গাছে প্রথমে গুঁটি ধরে। গুঁটির আকার যখন ডিমবল আকৃতি ধারন করে তখন ওই গুঁটির মধ্য থেকে ফুল ফোটে। চালতার ফুল সাধারণত রাতে ফোটে। ফুল ফোটার পর মৌমাছিরা ফুলে বসতে শুরু করে। অতি আশ্চার্যের বিষয় হলো রাতে ফুল ফোটার পর পরদিন বেলা বাড়ার সাথে সাথে ফুলের পাপড়ি নিস্তেজ হয়ে ঝড়ে পড়ে। একটি ফলে একদিনের জন্যই পরিপূর্ণ একটি ফুল ফুটে ঝড়ে যায়। চালতার ফুল ফোটার পরে ফুলে মৌমাছির আগমন ঘটতে থাকে। মৌমাছিরা চালতার ফুল থেকে মধু আহরণ করতে গিয়ে একফুল থেকে অন্য ফুলে বসে। এভাবেই চালতার পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়নের পর চালতার গুঁটির মধ্যে থাকা দলগুলি ধীরে ধীরে গুঁটিয়ে (চুপসে) আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সেটি পরিপূর্ণ ফলে পরিণত হয়। সাধারনত ফলটি পাকার আগেই গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা চালতার ফল দিয়ে মুখরোচক আচার তৈরি করা হয় যা নারীদের নিকট ব্যাপক সমাদৃত। চালতা ফলের ভিতরের আঠালো জাতীয় যে অংশ ফেলে দিতে হয় তা দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো সূতা টেকসই করা ও নৌকা বাইচের সময় নৌকার তলদেশে পানি না ধরার জন্য সেখানে ব্যাবহার করা হয়। বিশেষত ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগীতায় প্রতিযোগী-প্রতিযোগিনীরা কাচের গুড়ার সাথে ওই আঠালো জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে সূতায় মাঞ্জা দিয়ে থাকে সূতাকে টেকসই ও ধারালো করার জন্য।
বিভিন্ন সূত্র হয়ে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চালতা ফল খুব কমই খাওয়া হয়। তবে ভালভাবে ফল পাকলে থেঁতলে নরম করে লবন-মরিচ মেখে আচার বানালে খুব লোভনীয় ও রুচিকর খাবারে পরিণত হয়। তাই আচার, চাটনি, জেলি প্রস্তুতে চালতা ফল ব্যবহৃত হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা ফলের ২০.৭ গ্রাম খাবার উপযোগী এবং প্রতি ১০০ ভাগ ফলে শাঁসে ৭৪.৯ গ্রাম জলীয় রস, ১২.২ গ্রাম আঁশ, ১.৯ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক এসিড, ০.৮ গ্রাম আমিষ, ১৩.৪ শ্বেতসার, ০.২ গ্রাম চর্বি, ০.৮ গ্রাম খনিজ লবন, ১৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৫৯ কিলো ক্যালোরী খাদ্যশক্তি আছে। চালতা গাছের কাঠ মধ্যম শক্ত এবং পানিতে টেকসই। তাই নৌকার তলদেশ, যন্ত্রপাতির হাতল তৈরিতে চালতা গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। চালতার বাকল উন্নতমানের ট্যানিন। ফল তরকারি ও পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফলের আঠালো মুন্ড চুল পরিষ্কারক হিসাবেও অনেকে ব্যবহার করতো। চালতার ফল বায়ু ও কফনাশক এবং পাঁকা অবস্থায় রুচিকর। কচি ফল বাতের ব্যথা নিরাময়ে বেশ উপকারী। চালতার পাঁকা ফলের রস চিনি মিশিয়ে সর্দিজ্বরের প্রতিষেধক ও পানীয় হিসাবে খাওয়া যায়। বিদেশে পাঁকা চালতার জ্যাম, জেলির বিশেষ চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে টক বা মিষ্টি আচার বা চাটনি করে এবং ফল শুঁকিয়ে গুঁড়ো করে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি বছর একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে প্রায় সহস্রাধিক চালতা ফল পাওয়া যায়। চালতার ফুল বড়ই মনোমুগ্ধকর ও দৃষ্টিনন্দন।