ঢাকা ০৭:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

বর্ষাকাল ও কিছু কথা

লেখক-মোঃ হায়দার আলী
  • আপডেট সময় : ১১:৪৪:০৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৪৪৬ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। আর মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বর্ষাকালের বৃষ্টি আল্লাহর তলার পক্ষ থেকেই বর্ষিত হয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যখন প্রকৃতি জ্বলেপুড়ে একাকার, তখনই প্রকৃতিতে শীতল পরশ নিয়ে আসে বর্ষা। বর্ষাকালে প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নবজীবন। বর্ষা আমাদের মনেও প্রশান্তি নিয়ে হাজির হয়। বর্ষার ছোঁয়ায় আমাদের মন উদাস হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে গ্রামবাংলার প্রকৃতি গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে বর্ষাকালে। আকাশে কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ যে কাউকে উদাস করে। আবার রাতের অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার ডাক। কখনো ঝুম বৃষ্টি, আবার কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এ ধরনের আবহাওয়া মানব মনে যেন তৈরি করে অপূর্ব এক রোমাঞ্চ।

যখন বর্ষাকালে বৃষ্টি নামে তখন শুধু ছোটবেলার স্মৃতি গুলোই মনে পড়ে, আমরা ছোটবেলায় কত না বৃষ্টিতে ভিজেছি। বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে মায়ের হাতে সেই চাল ভাজা দিয়ে নারকেল খাওয়ার অনুভূতি শহরের মানুষগুলো কখনোই বুঝবে না। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরে সবসময় ভালো কিছু সবার জন্য অপেক্ষা করে, তাইতো আমরা বৃষ্টিকে এত ভালবাসি। আমি বর্ষাকালের বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে করে আমার অশ্রু ভেজা চোখ দুটি কেউ দেখতে না পারে।

বাংলাদেশ হচ্ছে ছয় ঋতুর একটি দেশ এই ছয় ঋতুর মধ্যে একটি হচ্ছে বর্ষাকাল। তাই বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হয় এবং নদী খাল বিল পানিতে ভরে ওঠে, বর্ষাকালে যখন নদ-নদী খাল-বিল পানিতে ভরে ওঠে তখন দেখতে কি যে সুন্দর লাগে শুধুমাত্র এই দেশের মানুষই বলতে পারবে। বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় এই দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত মাছ, আর মাছটি যদি জাতীয় মাছ ইলিশ হয় তবে কোন কথায় নেই। তাই এই দেশের মানুষের বর্ষাকাল খুব ভালো লাগে।

বর্ষাকাল আসলেই চারদিকে পানি থৈ থৈ করে বর্ষাকালে প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে ওঠে। বর্ষাকালে সারাদিন বৃষ্টি নেমে থাকে বর্ষাকালে আকাশে ভেসে বেড়ায় কালো মেঘ যে মেঘগুলো দেখলে দুই নয়ন ভরে উঠে আনন্দে। বাংলা বছরের ছয়টি ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল হচ্ছে সবচাইতে সুন্দর ঋতু, এই বর্ষাকালে আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢেকে থাকে কালো মেঘ গুলো বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ে যখন বৃষ্টিগুলো পড়ে তখন কি যে ভালো লাগে বুঝানো বড় দায়।

বর্ষাকালে বৃষ্টি কৃষিকাজের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। গ্রীষ্মের শুষ্ক মাটি বৃষ্টির পানিতে নরম হয়ে ফসল উৎপাদনে উপযোগী হয়ে ওঠে। তখন কৃষকেরা জমিতে কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। আবার কখনো দিনের কাজ শেষে তাঁরা গ্রামের বৈঠকঘরে অলস আড্ডায় মেতে ওঠে। গ্রামের মেয়েদের এ সময় কোনো কাজ থাকে না। তাই তাঁরা সবাই একসঙ্গে বসে সুই–সুতা দিয়ে নকশিকাঁথায় হরেক রকমের নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা বানিয়ে বর্ষার পানিতে খেলায় মেতে ওঠে।

শহরের জীবনে বর্ষা কিছুটা ভোগান্তি তৈরি করে। শহরে খাল-বিলের সংখ্যা কম, তাই তীব্র বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবুও গ্রীষ্মের উত্তপ্ত শহরে বৃষ্টির ফোঁটা মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে। উত্তপ্ত শহর আস্তে আস্তে শীতল হয়ে ওঠে। শহরের যান্ত্রিকতায় গ্রামের মতো বর্ষাকাল উপভোগ করা না গেলেও বর্ষাকাল ঠিকই সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়। শহরের উঁচু কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা অসাধারণ মনে হয়। এ সময় শহরের খাল ও লেকগুলো পানিতে ভরে যায়। পার্কগুলো সবুজে ছেয়ে যায়। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য।

বর্ষাকালে ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে বিমোহিত। বর্ষার যে ফুলগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে, তা হলো—শাপলা, কদম, কেয়া, কৃষ্ণচূড়া, কলাবতী, পদ্ম, দোলনচাঁপা, চন্দ্রপ্রভা, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমি ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানিমরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাঁটা, কেন্দার, কামিনী, রঙ্গন, অলকানন্দ, বকুল এবং এ ছাড়া নানা রঙের অর্কিড। বর্ষা ঋতু যেন ফুলের জননী।

আবহমানকাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে উদারতায়। বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের মন রাঙিয়ে আসছে। কাজ শেষে সন্ধ্যায় প্রিয়জনের জন্য একগুচ্ছ কদমফুল হাতে বাসায় ফেরা। প্রিয়জনের মন রাঙাতে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই! অনেক বিখ্যাত মানুষ বর্ষা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। অনেক কবিতা, গল্প লিখেছেন।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বর্ষাকাল ছিল অত্যন্ত প্রিয়। তার অসংখ্য গান ও গল্পে বর্ষার প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। তিনি তার প্রিয়তমাকে অন্য কোনো ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন—
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
শেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই—
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর। সোনার তরী কবিতা দিয়ে
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে’ আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হ’ল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খর-পরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত আমি একেলা,
চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা।
এ পারেতে ছোট ক্ষেত আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু’ধারে,
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে!
ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুসি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!

যত চাও তত লও তরণী পরে।
আর আছে?—আর নাই, দিয়েছি ভরে’।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
প্রেম নেই কোথাও -মুহতাসিম তকী
আপনার চোখে বর্ষা এলে,
কবিতার শহরে নামে বিরহ।
আজকাল ভালো থাকবার চেষ্টা
বড্ড ছেলেমানুষী মনে হয়!
প্রেমিকার শহরে বৃষ্টি নামে,
কিশোরী লজ্জায় নতজানু শহর
আমাকে জানায়,
এই শহরের প্রেম কাব্যে
আমি এখন মৃত প্রজাপতি।

আমার প্রেমিকা চলে গেছে।
আমার কবিতা চলে গেছে
মন খারাপের খাতায়।
আমি এখন আর প্রেম লিখি না।

আপনার শুভ্রতায়
বুক ব্যাথা হয় খুব।
কেমন যেন আজকাল
কেউ নেই-
কেউ নেই লাগে।
আমি জানি
আমি আপনার প্রেমিক
ছিলাম না কখনোই!
প্রেমিকা নতুন শাড়ি পড়ে,
প্রেমিককে দেখাবে বলে।
প্রাক্তন হবার অজুহাতে,
আমার আর ব্যক্তিগত
পাঠিকা নেই কোনো।

আপনার চোখে বর্ষা এলে,
কবিতার শহরে নামে বিরহ।
আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলে
মনে হয়,
আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে
প্রিয়তমার সবচেয়ে প্রিয়তম কবিতা।

“কিছু মানুষ আছে যারা বৃষ্টিকে অনুভব করে বাকিরা শুধু শরীর ভেজায়” – রজার মিলার
“যখন মেঘের দল আর বোঝা সহ্য করতে পারে না তখনই স্বর্গের কান্নায় ভেঙে পড়ে বৃষ্টি” – আর কে
“জীবনের কতগুলো মূল্যবান মুহূর্ত আমরা পার করি রংধনুর অপেক্ষায় স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানানোর আগে” – ডিয়েটার এফ
“জীবন ঝড় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মধ্য নয়, জীবনের মূল অপবাদ বৃষ্টিতে ভিজতে উপভোগ করার মাধ্যম” – ভিভিয়ান গ্রিন
“বৃষ্টির উপর তোমরা রাগ করোনা! কেননা সে এটা জানে না উপরের দিকে কিভাবে পড়তে হয়! ”

অন্য সাধারন একটি দিনের থেকে বর্ষাকালের একটি দিন অনেকটা আলাদা কারণ শুধুমাত্র এই বর্ষাকালে আমাদের মনের ভিতরে রোমান্টিক মুড চলে আসে এবং ভালোবাসা বেড়ে যায় প্রকৃতির প্রতি। বর্ষাকালের সময় চারদিকে প্রাকৃতিক ভাবে নদ-নদী খাল-বিল পানিতে ভরে যায় তখন আমাদের এই বর্ষাকাল ঘিরে মনের ভিতরে সুখ দুঃখ চলে আসে এবং বর্ষাকালকে আমরা আপন করে নিয়ে থাকি।

বর্ষা নামলে শহর ভিজে ভিজতে পারিনা আমি, শরীর ভেজানো ভীষণ সহজ মন ভেজানো দামী। রিমঝিম এই বৃষ্টির দিনে তোমার আবার মনে পড়ছে, তুমি আসবে বলে চলে গেলে হৃদয় আঙিনা শূন্য করে। আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর পায়ে দিয়ে সোনার নুপুর আঁকাবাঁকা মেঠো পথে কোন রূপসী হেটে যায়? অঝোর ধারায় বৃষ্টি আমার ভীষণ পছন্দ চারদিকে যেন একটা সাদা কোলাহল যাতে নীরবতা আছে কিন্তু শূন্যতা নেই – মার্ক হেডন।

বৃষ্টি মানে একলা দুপুর তোমার ভেজা চুল, বৃষ্টি মানে রোদের ছুটি ভেসে আসে তোমার সুর। বৃষ্টির জন্য চেয়ে আছি নীল আকাশের পানে, ওগো বৃষ্টি তুমি ঝড়ে পড় আমার এই ক্লান্ত গায়ে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বৃষ্টিকে অনুভব করে, বাকি মানুষগুলো শুধু বৃষ্টিতে শরীর ভিজায়। অন্য সাধারন একটি দিনের থেকে বর্ষাকালের একটি দিন অনেকটা আলাদা কারণ শুধুমাত্র এই বর্ষাকালে আমাদের মনের ভিতরে রোমান্টিক মুড চলে আসে এবং ভালোবাসা বেড়ে যায় প্রকৃতির প্রতি। বৃষ্টি শেষে সূর্য আবার উঠবেই তাই ব্যর্থতার পরে সফলতা আবার আসবেই।

[লেখক : মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী ও সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নিউজটি শেয়ার করুন

বর্ষাকাল ও কিছু কথা

আপডেট সময় : ১১:৪৪:০৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। আর মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বর্ষাকালের বৃষ্টি আল্লাহর তলার পক্ষ থেকেই বর্ষিত হয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যখন প্রকৃতি জ্বলেপুড়ে একাকার, তখনই প্রকৃতিতে শীতল পরশ নিয়ে আসে বর্ষা। বর্ষাকালে প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নবজীবন। বর্ষা আমাদের মনেও প্রশান্তি নিয়ে হাজির হয়। বর্ষার ছোঁয়ায় আমাদের মন উদাস হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে গ্রামবাংলার প্রকৃতি গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে বর্ষাকালে। আকাশে কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ যে কাউকে উদাস করে। আবার রাতের অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার ডাক। কখনো ঝুম বৃষ্টি, আবার কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এ ধরনের আবহাওয়া মানব মনে যেন তৈরি করে অপূর্ব এক রোমাঞ্চ।

যখন বর্ষাকালে বৃষ্টি নামে তখন শুধু ছোটবেলার স্মৃতি গুলোই মনে পড়ে, আমরা ছোটবেলায় কত না বৃষ্টিতে ভিজেছি। বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে মায়ের হাতে সেই চাল ভাজা দিয়ে নারকেল খাওয়ার অনুভূতি শহরের মানুষগুলো কখনোই বুঝবে না। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরে সবসময় ভালো কিছু সবার জন্য অপেক্ষা করে, তাইতো আমরা বৃষ্টিকে এত ভালবাসি। আমি বর্ষাকালের বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে করে আমার অশ্রু ভেজা চোখ দুটি কেউ দেখতে না পারে।

বাংলাদেশ হচ্ছে ছয় ঋতুর একটি দেশ এই ছয় ঋতুর মধ্যে একটি হচ্ছে বর্ষাকাল। তাই বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হয় এবং নদী খাল বিল পানিতে ভরে ওঠে, বর্ষাকালে যখন নদ-নদী খাল-বিল পানিতে ভরে ওঠে তখন দেখতে কি যে সুন্দর লাগে শুধুমাত্র এই দেশের মানুষই বলতে পারবে। বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় এই দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত মাছ, আর মাছটি যদি জাতীয় মাছ ইলিশ হয় তবে কোন কথায় নেই। তাই এই দেশের মানুষের বর্ষাকাল খুব ভালো লাগে।

বর্ষাকাল আসলেই চারদিকে পানি থৈ থৈ করে বর্ষাকালে প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে ওঠে। বর্ষাকালে সারাদিন বৃষ্টি নেমে থাকে বর্ষাকালে আকাশে ভেসে বেড়ায় কালো মেঘ যে মেঘগুলো দেখলে দুই নয়ন ভরে উঠে আনন্দে। বাংলা বছরের ছয়টি ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল হচ্ছে সবচাইতে সুন্দর ঋতু, এই বর্ষাকালে আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢেকে থাকে কালো মেঘ গুলো বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ে যখন বৃষ্টিগুলো পড়ে তখন কি যে ভালো লাগে বুঝানো বড় দায়।

বর্ষাকালে বৃষ্টি কৃষিকাজের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। গ্রীষ্মের শুষ্ক মাটি বৃষ্টির পানিতে নরম হয়ে ফসল উৎপাদনে উপযোগী হয়ে ওঠে। তখন কৃষকেরা জমিতে কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। আবার কখনো দিনের কাজ শেষে তাঁরা গ্রামের বৈঠকঘরে অলস আড্ডায় মেতে ওঠে। গ্রামের মেয়েদের এ সময় কোনো কাজ থাকে না। তাই তাঁরা সবাই একসঙ্গে বসে সুই–সুতা দিয়ে নকশিকাঁথায় হরেক রকমের নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা বানিয়ে বর্ষার পানিতে খেলায় মেতে ওঠে।

শহরের জীবনে বর্ষা কিছুটা ভোগান্তি তৈরি করে। শহরে খাল-বিলের সংখ্যা কম, তাই তীব্র বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবুও গ্রীষ্মের উত্তপ্ত শহরে বৃষ্টির ফোঁটা মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে। উত্তপ্ত শহর আস্তে আস্তে শীতল হয়ে ওঠে। শহরের যান্ত্রিকতায় গ্রামের মতো বর্ষাকাল উপভোগ করা না গেলেও বর্ষাকাল ঠিকই সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়। শহরের উঁচু কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা অসাধারণ মনে হয়। এ সময় শহরের খাল ও লেকগুলো পানিতে ভরে যায়। পার্কগুলো সবুজে ছেয়ে যায়। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য।

বর্ষাকালে ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে বিমোহিত। বর্ষার যে ফুলগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে, তা হলো—শাপলা, কদম, কেয়া, কৃষ্ণচূড়া, কলাবতী, পদ্ম, দোলনচাঁপা, চন্দ্রপ্রভা, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমি ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানিমরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাঁটা, কেন্দার, কামিনী, রঙ্গন, অলকানন্দ, বকুল এবং এ ছাড়া নানা রঙের অর্কিড। বর্ষা ঋতু যেন ফুলের জননী।

আবহমানকাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে উদারতায়। বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের মন রাঙিয়ে আসছে। কাজ শেষে সন্ধ্যায় প্রিয়জনের জন্য একগুচ্ছ কদমফুল হাতে বাসায় ফেরা। প্রিয়জনের মন রাঙাতে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই! অনেক বিখ্যাত মানুষ বর্ষা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। অনেক কবিতা, গল্প লিখেছেন।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বর্ষাকাল ছিল অত্যন্ত প্রিয়। তার অসংখ্য গান ও গল্পে বর্ষার প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। তিনি তার প্রিয়তমাকে অন্য কোনো ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন—
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
শেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই—
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর। সোনার তরী কবিতা দিয়ে
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে’ আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হ’ল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খর-পরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত আমি একেলা,
চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা।
এ পারেতে ছোট ক্ষেত আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু’ধারে,
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে!
ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুসি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!

যত চাও তত লও তরণী পরে।
আর আছে?—আর নাই, দিয়েছি ভরে’।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
প্রেম নেই কোথাও -মুহতাসিম তকী
আপনার চোখে বর্ষা এলে,
কবিতার শহরে নামে বিরহ।
আজকাল ভালো থাকবার চেষ্টা
বড্ড ছেলেমানুষী মনে হয়!
প্রেমিকার শহরে বৃষ্টি নামে,
কিশোরী লজ্জায় নতজানু শহর
আমাকে জানায়,
এই শহরের প্রেম কাব্যে
আমি এখন মৃত প্রজাপতি।

আমার প্রেমিকা চলে গেছে।
আমার কবিতা চলে গেছে
মন খারাপের খাতায়।
আমি এখন আর প্রেম লিখি না।

আপনার শুভ্রতায়
বুক ব্যাথা হয় খুব।
কেমন যেন আজকাল
কেউ নেই-
কেউ নেই লাগে।
আমি জানি
আমি আপনার প্রেমিক
ছিলাম না কখনোই!
প্রেমিকা নতুন শাড়ি পড়ে,
প্রেমিককে দেখাবে বলে।
প্রাক্তন হবার অজুহাতে,
আমার আর ব্যক্তিগত
পাঠিকা নেই কোনো।

আপনার চোখে বর্ষা এলে,
কবিতার শহরে নামে বিরহ।
আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলে
মনে হয়,
আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে
প্রিয়তমার সবচেয়ে প্রিয়তম কবিতা।

“কিছু মানুষ আছে যারা বৃষ্টিকে অনুভব করে বাকিরা শুধু শরীর ভেজায়” – রজার মিলার
“যখন মেঘের দল আর বোঝা সহ্য করতে পারে না তখনই স্বর্গের কান্নায় ভেঙে পড়ে বৃষ্টি” – আর কে
“জীবনের কতগুলো মূল্যবান মুহূর্ত আমরা পার করি রংধনুর অপেক্ষায় স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানানোর আগে” – ডিয়েটার এফ
“জীবন ঝড় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মধ্য নয়, জীবনের মূল অপবাদ বৃষ্টিতে ভিজতে উপভোগ করার মাধ্যম” – ভিভিয়ান গ্রিন
“বৃষ্টির উপর তোমরা রাগ করোনা! কেননা সে এটা জানে না উপরের দিকে কিভাবে পড়তে হয়! ”

অন্য সাধারন একটি দিনের থেকে বর্ষাকালের একটি দিন অনেকটা আলাদা কারণ শুধুমাত্র এই বর্ষাকালে আমাদের মনের ভিতরে রোমান্টিক মুড চলে আসে এবং ভালোবাসা বেড়ে যায় প্রকৃতির প্রতি। বর্ষাকালের সময় চারদিকে প্রাকৃতিক ভাবে নদ-নদী খাল-বিল পানিতে ভরে যায় তখন আমাদের এই বর্ষাকাল ঘিরে মনের ভিতরে সুখ দুঃখ চলে আসে এবং বর্ষাকালকে আমরা আপন করে নিয়ে থাকি।

বর্ষা নামলে শহর ভিজে ভিজতে পারিনা আমি, শরীর ভেজানো ভীষণ সহজ মন ভেজানো দামী। রিমঝিম এই বৃষ্টির দিনে তোমার আবার মনে পড়ছে, তুমি আসবে বলে চলে গেলে হৃদয় আঙিনা শূন্য করে। আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর পায়ে দিয়ে সোনার নুপুর আঁকাবাঁকা মেঠো পথে কোন রূপসী হেটে যায়? অঝোর ধারায় বৃষ্টি আমার ভীষণ পছন্দ চারদিকে যেন একটা সাদা কোলাহল যাতে নীরবতা আছে কিন্তু শূন্যতা নেই – মার্ক হেডন।

বৃষ্টি মানে একলা দুপুর তোমার ভেজা চুল, বৃষ্টি মানে রোদের ছুটি ভেসে আসে তোমার সুর। বৃষ্টির জন্য চেয়ে আছি নীল আকাশের পানে, ওগো বৃষ্টি তুমি ঝড়ে পড় আমার এই ক্লান্ত গায়ে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বৃষ্টিকে অনুভব করে, বাকি মানুষগুলো শুধু বৃষ্টিতে শরীর ভিজায়। অন্য সাধারন একটি দিনের থেকে বর্ষাকালের একটি দিন অনেকটা আলাদা কারণ শুধুমাত্র এই বর্ষাকালে আমাদের মনের ভিতরে রোমান্টিক মুড চলে আসে এবং ভালোবাসা বেড়ে যায় প্রকৃতির প্রতি। বৃষ্টি শেষে সূর্য আবার উঠবেই তাই ব্যর্থতার পরে সফলতা আবার আসবেই।

[লেখক : মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী ও সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা ]

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলা খবর বিডি-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)