Deprecated: Optional parameter $avatar declared before required parameter $id_or_email is implicitly treated as a required parameter in /home/banglakhaborbd/public_html/wp-content/themes/Newspaper pro/lib/metabox/user-function.php on line 55
প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ॥ শ্রদ্ধাঞ্জলি - বাংলা খবর
ঢাকা ০৭:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ॥ শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৩:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২
  • / ৫০৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

প্রফেসর আবদুল খালেক :

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, দেশবরেণ্য গবেষক, খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রফেসর মযহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, বৃহত্তর পাবনা (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) জেলার চর নবীপুর গ্রামে। পিতার নাম ডাঃ মোহাম্মদ আলী। মযহারুল ইসলাম মেট্রিক পাস করেন তালগাছী আবু ইসহাক উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে। আইএ পাস করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে। এরপর রাজশাহী কলেজে বংলা বিষয়ে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে অনার্স পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলা এমএ প্রিভিয়াস পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এমএ ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই সঙ্গে তিনি গোল্ড মেডেলিস্ট এবং কালীনারায়ণ স্কলারের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে মেধার ভিত্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে মযহারুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন আমেকিার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডিগ্রী অর্জনের পর এক বছর তিনি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের প্রফেসর এবং বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে প্রফেসর ইসলাম কলা অনুষদের ডীন নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রফেসর মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশপাশি দেশে-বিদেশে অসংখ্য সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা মযহারুল ইসলাম ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর দেশে যে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়, সে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম একাত্ম হয়ে ওঠেন। ৬ দফা আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ড. মযহারুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শাহজাদপুর থেকে হেঁটে গোপনে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বহু কষ্টে তিনি হেঁটে বাঘা লালপুর হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশে রেখেই তাঁকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। নিজের পরিবারের সুখ-শান্তির চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে তিনি বড় করে দেখেছিলেন। পরিবার পরিজনকে এতসব বিপদের মধ্যে রেখেও ড. মযহারুল ইসলাম স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রে প্রতিদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কলম দিয়ে এবং অস্ত্র হাতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কালবিলম্ব না করে ১৯ ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে যাঁদের কলকাতা থেকে ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের একজন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে ড. মযহারুল ইসলামকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি ২২ মার্চ ১৯৭২ থেকে ১৮ আগস্ট ১৯৭৪ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমি পরিচালনায় মযহারুল ইসলাম অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি দ্রুত বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এরমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। সেসব জটিলতা নিরসনকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ড. মযহারুল ইসলামকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ আগস্ট মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর মযহারুল ইসলামকে উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বিবেচনায় রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ তিন বছর তাঁকে কারারুদ্ধ রাখা হয়। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি তাঁর স্থায়ী পদ বাংলা বিভাগের প্রফেসর পদে যোগদানপত্র জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে বাংলা বিভাগে তাঁর নিজ পদে যোগদান করতে দেয়া হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ড. মুহম্মদ আবদুল বারী। এই পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ভারতীয় ইউজিসির আমন্ত্রণে তিনি চলে যান ভারতে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাবিদ থেকে শিল্পপতি পরিবার পরিজনের জীবিকার স্বার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে প্রাপ্ত পেনশনের টাকা এবং বনানীর নিজ নির্মিত বাড়িটি জনতা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ১৯৮৭ সালে জ্যেষ্ঠপুত্র চয়ন ইসলামের মাধ্যমে মযহারুল ইসলাম ঢাকায় পোশাক শিল্পের একটি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন শিক্ষাবিদ হয়েও শিল্পপতি হিসেবে তিনি অসাধারণ সফলতা অর্জন করেন। সাহিত্য চর্চা মযহারুল ইসলাম নদী বিধৌত অঞ্চলের মানুষ। শৈশব থেকেই তিনি নদী, বর্ষা, বৃষ্টি এবং প্রকৃতির নানা লীলা-খেলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করেন। মযহারুল ইসলামের জন্মভূমি চর নবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে বহমান করতোয়া নদী। তিনি নিবিষ্ট চিত্তে করতোয়া নদীর গতিবিধি লক্ষ্য করতেন, লক্ষ্য করতেন করতোয়া নদীপাড়ের গতিশীল প্রকৃতি ও মানুষকে। রবীন্দ্রনাথের ওপর পদ্মা নদীর যে প্রভাব, অনুরূপভাবে মযহারুল ইসলামের কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে করতোয়া নদীর প্রকৃতি এবং নদীপাড়ের মানুষগুলো জীবন্ত রূপলাভ করেছে। জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে রোগশয্যাতেও তিনি করতোয়া নদীর কথা ভুলতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ তার একটি উদ্ধৃতি স্মরণ করা যেতে পারে-‘রোগশয্যা পিছে ফেলে কবিতার হাত ধরে চলে যাই কখন যে কৈশরের করতোয়া পারে। সেই তিল ক্ষেত জ্যৈষ্ঠ শেষের জল নতুন জোয়ার। পাতি কাকদের ভিড়। সেই খেয়া পারাপার। গামছায় মাছ ধরা। সবকিছু সামনে দাঁড়ায় সবই কবিতা।’ মযহারুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক। প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ২৫-এর অধিক। ফোকলোর গবেষণায় তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭০ সালে তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তানের উচ্চতম সাহিত্য পুরস্কার ‘দাউদ পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। তিনি উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে আছেন। বাংলাদেশ ফোকলোর সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় চার নেতা পরিষদে আজীবন তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শিল্প-সাহিত্যের জগত ছাড়াও শিক্ষা, জনসেবা এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি রেখে গেছেন। তাঁর নিজ এলাকা শাহজাদপুরে ব্যক্তিগত অর্থে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন। এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর পোশাক তৈরির কারখানায় তিনি এলাকার অসহায় বেকার মানুষদের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে শেষ করেছেন শিল্পপতি হিসেবে। শিল্পপতি হলেও তাঁর জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে কোনরকম ভাটা পড়েনি। সাফল্যের কোথাও ঘাটতি নেই। পিতা হিসেবেও তিনি সার্থক। কন্যা মেরিনা জাহান এবং পুত্র চয়ন ইসলাম তাঁর সফল রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। শিক্ষাবিদ মযহারুল ইসলামের সফল উত্তরাধিকার অপর কন্যা প্রফেসর ড. ছন্দা ইসলাম এবং শিল্পপতি মযহারুল ইসলামের সার্থক উত্তরাধিকার কনিষ্ঠ পুত্র শোভন ইসলাম। দেশবরেণ্য এই মহান কবি, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, গবেষক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফোকলোর বিশারদ, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল ৮.১১ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮ নভেম্বর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মোট ৪টি স্থানে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার শোক বিহ্বল মানুষ তাঁর জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৮ নভেম্বর বাদ মাগরিব প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে শাহজাদপুরে তাঁর ’নূরজাহান’ নামের নিজ বাসভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিলেন, তিনিও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। এখানেই তাঁর জীবনের বড় সাফল্য।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (তথ্যসূত্র : দৈনিক জনকন্ঠ)

নিউজটি শেয়ার করুন

প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ॥ শ্রদ্ধাঞ্জলি

আপডেট সময় : ০৮:৫৩:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২

প্রফেসর আবদুল খালেক :

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, দেশবরেণ্য গবেষক, খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রফেসর মযহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, বৃহত্তর পাবনা (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) জেলার চর নবীপুর গ্রামে। পিতার নাম ডাঃ মোহাম্মদ আলী। মযহারুল ইসলাম মেট্রিক পাস করেন তালগাছী আবু ইসহাক উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে। আইএ পাস করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে। এরপর রাজশাহী কলেজে বংলা বিষয়ে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে অনার্স পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলা এমএ প্রিভিয়াস পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এমএ ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই সঙ্গে তিনি গোল্ড মেডেলিস্ট এবং কালীনারায়ণ স্কলারের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে মেধার ভিত্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে মযহারুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন আমেকিার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডিগ্রী অর্জনের পর এক বছর তিনি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের প্রফেসর এবং বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে প্রফেসর ইসলাম কলা অনুষদের ডীন নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রফেসর মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশপাশি দেশে-বিদেশে অসংখ্য সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা মযহারুল ইসলাম ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর দেশে যে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়, সে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম একাত্ম হয়ে ওঠেন। ৬ দফা আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ড. মযহারুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শাহজাদপুর থেকে হেঁটে গোপনে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বহু কষ্টে তিনি হেঁটে বাঘা লালপুর হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশে রেখেই তাঁকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। নিজের পরিবারের সুখ-শান্তির চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে তিনি বড় করে দেখেছিলেন। পরিবার পরিজনকে এতসব বিপদের মধ্যে রেখেও ড. মযহারুল ইসলাম স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রে প্রতিদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কলম দিয়ে এবং অস্ত্র হাতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কালবিলম্ব না করে ১৯ ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে যাঁদের কলকাতা থেকে ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের একজন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে ড. মযহারুল ইসলামকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি ২২ মার্চ ১৯৭২ থেকে ১৮ আগস্ট ১৯৭৪ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমি পরিচালনায় মযহারুল ইসলাম অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি দ্রুত বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এরমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। সেসব জটিলতা নিরসনকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ড. মযহারুল ইসলামকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ আগস্ট মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর মযহারুল ইসলামকে উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বিবেচনায় রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ তিন বছর তাঁকে কারারুদ্ধ রাখা হয়। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি তাঁর স্থায়ী পদ বাংলা বিভাগের প্রফেসর পদে যোগদানপত্র জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে বাংলা বিভাগে তাঁর নিজ পদে যোগদান করতে দেয়া হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ড. মুহম্মদ আবদুল বারী। এই পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ভারতীয় ইউজিসির আমন্ত্রণে তিনি চলে যান ভারতে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাবিদ থেকে শিল্পপতি পরিবার পরিজনের জীবিকার স্বার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে প্রাপ্ত পেনশনের টাকা এবং বনানীর নিজ নির্মিত বাড়িটি জনতা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ১৯৮৭ সালে জ্যেষ্ঠপুত্র চয়ন ইসলামের মাধ্যমে মযহারুল ইসলাম ঢাকায় পোশাক শিল্পের একটি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন শিক্ষাবিদ হয়েও শিল্পপতি হিসেবে তিনি অসাধারণ সফলতা অর্জন করেন। সাহিত্য চর্চা মযহারুল ইসলাম নদী বিধৌত অঞ্চলের মানুষ। শৈশব থেকেই তিনি নদী, বর্ষা, বৃষ্টি এবং প্রকৃতির নানা লীলা-খেলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করেন। মযহারুল ইসলামের জন্মভূমি চর নবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে বহমান করতোয়া নদী। তিনি নিবিষ্ট চিত্তে করতোয়া নদীর গতিবিধি লক্ষ্য করতেন, লক্ষ্য করতেন করতোয়া নদীপাড়ের গতিশীল প্রকৃতি ও মানুষকে। রবীন্দ্রনাথের ওপর পদ্মা নদীর যে প্রভাব, অনুরূপভাবে মযহারুল ইসলামের কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে করতোয়া নদীর প্রকৃতি এবং নদীপাড়ের মানুষগুলো জীবন্ত রূপলাভ করেছে। জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে রোগশয্যাতেও তিনি করতোয়া নদীর কথা ভুলতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ তার একটি উদ্ধৃতি স্মরণ করা যেতে পারে-‘রোগশয্যা পিছে ফেলে কবিতার হাত ধরে চলে যাই কখন যে কৈশরের করতোয়া পারে। সেই তিল ক্ষেত জ্যৈষ্ঠ শেষের জল নতুন জোয়ার। পাতি কাকদের ভিড়। সেই খেয়া পারাপার। গামছায় মাছ ধরা। সবকিছু সামনে দাঁড়ায় সবই কবিতা।’ মযহারুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক। প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ২৫-এর অধিক। ফোকলোর গবেষণায় তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭০ সালে তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তানের উচ্চতম সাহিত্য পুরস্কার ‘দাউদ পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। তিনি উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে আছেন। বাংলাদেশ ফোকলোর সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় চার নেতা পরিষদে আজীবন তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শিল্প-সাহিত্যের জগত ছাড়াও শিক্ষা, জনসেবা এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি রেখে গেছেন। তাঁর নিজ এলাকা শাহজাদপুরে ব্যক্তিগত অর্থে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন। এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর পোশাক তৈরির কারখানায় তিনি এলাকার অসহায় বেকার মানুষদের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে শেষ করেছেন শিল্পপতি হিসেবে। শিল্পপতি হলেও তাঁর জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে কোনরকম ভাটা পড়েনি। সাফল্যের কোথাও ঘাটতি নেই। পিতা হিসেবেও তিনি সার্থক। কন্যা মেরিনা জাহান এবং পুত্র চয়ন ইসলাম তাঁর সফল রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। শিক্ষাবিদ মযহারুল ইসলামের সফল উত্তরাধিকার অপর কন্যা প্রফেসর ড. ছন্দা ইসলাম এবং শিল্পপতি মযহারুল ইসলামের সার্থক উত্তরাধিকার কনিষ্ঠ পুত্র শোভন ইসলাম। দেশবরেণ্য এই মহান কবি, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, গবেষক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফোকলোর বিশারদ, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল ৮.১১ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮ নভেম্বর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মোট ৪টি স্থানে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার শোক বিহ্বল মানুষ তাঁর জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৮ নভেম্বর বাদ মাগরিব প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে শাহজাদপুরে তাঁর ’নূরজাহান’ নামের নিজ বাসভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিলেন, তিনিও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। এখানেই তাঁর জীবনের বড় সাফল্য।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (তথ্যসূত্র : দৈনিক জনকন্ঠ)