ঢাকা ০৪:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

নকল দুধ ও ভেজাল ঘিয়ে বাজার সয়লাব

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:০৪:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ অক্টোবর ২০২২
  • / ৬০২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা খবর বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শফিউল আযম : গবাদিপশু সমৃদ্ধ পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ কমেছে। এদিকে বাজারে দুধের দাম বেড়েছে,

চাহিদা আগের মতোই আছে। এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল দুধ ও ঘি তৈরি করে বাজারজাত করছে। এই নকল দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর ছানার পানি, স্কিমমিল্ক, ডিটারজেন পাউডারসহ নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য। ঘি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে দুধের ননী, বাটার অয়েল, সয়াবিন ও কালার ফ্লেভার। দুধ তাজা রাখার জন্য দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। ভোক্তারা এই দুধ ও ঘি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এদিকে নকল দুধ ও ঘিয়ের ব্যবসা করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি বেড়া উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি রিজু তামান্না উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের
পেঁচাকোলা গ্রামে সঞ্জয় ঘোষের বাড়ীতে অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমান নকল দুধ ও দুধ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করেন। পরে ভ্রাম্যমান আদালত গঠণ করে সহকারি কমিশনার ভূমি রিজু তামান্না সঞ্জয় ঘোষকে নকল দুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে দেড় বছরের কারাদন্ডসহ এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

স্থানীয় হাট-বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ অঞ্চলে দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ কমেছে। প্রতি লিটার দুধ ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিল্কভিটা ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম বাড়িয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো খামারি পর্যায়ে দুধের দাম না বাড়িয়ে আগের দামে প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৩ টাকা দরে কিনছে। এদিকে গো-খাদ্যের উচ্চমূল্য ও দুধের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় খামারিরা বাধ্য হয়ে খোলা বাজারে বেশি দামে দুধ বিক্রি করছে। দুধ ঘাটতির এ সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল দুধ তৈরি করে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ৪০ কেজি নকল দুধ তৈরিতে প্রায় ৪০০ টাকা খরচ হয়। এই দুধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করছে এক হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ প্রক্রিয়াজাতের পর নিজস্ব ব্রান্ডের প্যাকেট ভরে দেশের বিভিন্ন শহরে বাজারজাত করে আসছে।

সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বেড়া, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় শতাধিক দুধ ব্যবসায়ী ও ঘোষ নকল দুধ তৈরির সাথে জড়িত। এছাড়া ১৫ জন ভেজাল ঘি তৈরির সাথে জড়িত রয়েছে। গ্রামগুলোতে নকল দুধ ও ঘি তৈরির কাজ চলে সাধারণত ভোর থেকে সকাল আট-নয়টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। নকল দুধ তৈরি সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা প্রথমে খাঁটি দুধের সব ননি (ফ্যাট) তুলে নেয়। পরে ননিবিহীন দুধে সয়াবিন তেল, ডিটারজেন পাউডারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মন) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমান ছানা তৈরিতে প্রায় এক হাজার ৪০০ মন দুধের প্রযোজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করে রাখেন। পরে ওই ছানার পানির সাথে ক্ষতিকর নানা উপকরন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল দুধ। প্রতিটি কারখানায় সব সময় ৫০০ লিটার থেকে দুই হাজার লিটার ছানার পানি মজুদ রাখা হয়। এই ছানার পানিই ভেজাল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ।

জানা যায়, ঘি তৈরি হয় গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার দুধের ফ্যাট (ননী) দিয়ে। অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে খাঁটি ননীর সাথে নানা উপকরন মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করছে। প্রায় ১৫ কেজি ডালডা অথবা ভেজিটেবল অয়েলের সাথে পাঁচ কেজি খাঁটি ননী, কালার ফ্লেবার ভালভাবে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এই ঘি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। ভেজাল ঘি বাহ্যিকভাবে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বসাকুল্যে ব্যয় হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর এই ঘি বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দরে। এক শ্রেনীর অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ী ভেজাল দুধ ও ঘিয়ের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতিতে পরিনত হচ্ছে। ঘি ও দুধের জন্য বাঘাবাড়ী নামটি সারা দেশে পরিচিত। বাঘাবাড়ীর খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত ও বিক্রি করছে।

এ অঞ্চলের শতাধিক ছানা কারখানার ছানার পানিই নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরন। কতিপয় আসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষ প্রতি মন ছানার পানিতে আধা কেজি ননী, আধা কেজি মিল্ক পাউডার সামান্য পরিমান লবন, খাবার সোডা, এক কেজি চিনি ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে অবিকল দুধ তৈরি করছে, যা রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। ঘোষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই নকল ও ভেজাল দুধ সংগ্রহ করে বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরন প্রতিষ্ঠান। পরে প্রক্রিয়াজাত করার সময় ভেজাল দুধের সাথে আসল দুধ মিশে সব দুধই ভেজালে পরিণত হয়। প্রক্রিয়াজাতকরনের সময় আসল দুধ থেকে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ফ্যাট (ননী) বের করে নেয়া হয়। এতে দুধের পুষ্টিমান কমে যায়। এ দুধ কিনে ক্রেতা সাধারন প্রতারিত হচ্ছেন। ছানার পানি ছাড়াও অন্য এক পদ্ধতিতে অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক মন ফুটন্ত পানিতে এক কেজি দুধের ননী, আধা কেজি স্কিমমিল্ক পাউডার, ২৫০ গ্রাম হাইড্রোজ সমপরিমান লবন, ১০০ গ্রাম সয়াবিন তেল ও এক ফোঁটা ফরমালিন মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়। ক্ষতিকর স্কিমমিল্ক পাউডার ভারত থেকে সীমান্ত পথে দেশে প্রবেশ করছে।

সূত্র আরও জানায়, দুধের ল্যাকটো ও ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায়। সে জন্য ভেজাল দুধে চিনি, লবন, হাইড্রোজ ও সয়াবিন তেল ব্যবহার করে। এতে দুধের ঘনত্ব ও ল্যাকটো বেড়ে যায়। দুধ তাজা রাখার জন্য দেয়া হয় ফরমালিন। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনাকালে
ল্যাকটোমিটার দিয়ে এই সুক্ষ প্রতারনা ধরা সম্ভব হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষেরা অবাধে ভেজাল দুধ, ঘি তৈরি করে বিক্রি করছে। এদের দেখাদেখি অনেকেই ভেজাল দুধ ও ঘি তৈরির কারবারে উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। ভেজাল কারবারীদের সাথে প্রশাসনের কিছু কর্মচারির গোপন যোগাযোগ থাকায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের খবর তারা আগেভাগেই পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান কোন কাজেই আসছে না বলে বিভিন্ন মহল থেকে আভিযোগ উঠেছে।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সবুর আলী বলেন, শিশুর মানষিক বিকাশসহ মানব স্বস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নকল দুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। এ সংক্রান্ত কোন খবর পেলে দ্রুততম সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে এবং প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভেজাল বা নকলের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্সে আছে। সম্প্রতি পেঁচাকোলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে নকল দুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে সঞ্জয় ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে দেড় বছরের কারাদন্ডসহ এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

নকল দুধ ও ভেজাল ঘিয়ে বাজার সয়লাব

আপডেট সময় : ০৭:০৪:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ অক্টোবর ২০২২

শফিউল আযম : গবাদিপশু সমৃদ্ধ পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ কমেছে। এদিকে বাজারে দুধের দাম বেড়েছে,

চাহিদা আগের মতোই আছে। এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল দুধ ও ঘি তৈরি করে বাজারজাত করছে। এই নকল দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর ছানার পানি, স্কিমমিল্ক, ডিটারজেন পাউডারসহ নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য। ঘি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে দুধের ননী, বাটার অয়েল, সয়াবিন ও কালার ফ্লেভার। দুধ তাজা রাখার জন্য দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। ভোক্তারা এই দুধ ও ঘি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এদিকে নকল দুধ ও ঘিয়ের ব্যবসা করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি বেড়া উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি রিজু তামান্না উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের
পেঁচাকোলা গ্রামে সঞ্জয় ঘোষের বাড়ীতে অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমান নকল দুধ ও দুধ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করেন। পরে ভ্রাম্যমান আদালত গঠণ করে সহকারি কমিশনার ভূমি রিজু তামান্না সঞ্জয় ঘোষকে নকল দুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে দেড় বছরের কারাদন্ডসহ এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

স্থানীয় হাট-বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ অঞ্চলে দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ কমেছে। প্রতি লিটার দুধ ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিল্কভিটা ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম বাড়িয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো খামারি পর্যায়ে দুধের দাম না বাড়িয়ে আগের দামে প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৩ টাকা দরে কিনছে। এদিকে গো-খাদ্যের উচ্চমূল্য ও দুধের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় খামারিরা বাধ্য হয়ে খোলা বাজারে বেশি দামে দুধ বিক্রি করছে। দুধ ঘাটতির এ সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল দুধ তৈরি করে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ৪০ কেজি নকল দুধ তৈরিতে প্রায় ৪০০ টাকা খরচ হয়। এই দুধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করছে এক হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ প্রক্রিয়াজাতের পর নিজস্ব ব্রান্ডের প্যাকেট ভরে দেশের বিভিন্ন শহরে বাজারজাত করে আসছে।

সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বেড়া, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় শতাধিক দুধ ব্যবসায়ী ও ঘোষ নকল দুধ তৈরির সাথে জড়িত। এছাড়া ১৫ জন ভেজাল ঘি তৈরির সাথে জড়িত রয়েছে। গ্রামগুলোতে নকল দুধ ও ঘি তৈরির কাজ চলে সাধারণত ভোর থেকে সকাল আট-নয়টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। নকল দুধ তৈরি সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা প্রথমে খাঁটি দুধের সব ননি (ফ্যাট) তুলে নেয়। পরে ননিবিহীন দুধে সয়াবিন তেল, ডিটারজেন পাউডারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মন) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমান ছানা তৈরিতে প্রায় এক হাজার ৪০০ মন দুধের প্রযোজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করে রাখেন। পরে ওই ছানার পানির সাথে ক্ষতিকর নানা উপকরন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল দুধ। প্রতিটি কারখানায় সব সময় ৫০০ লিটার থেকে দুই হাজার লিটার ছানার পানি মজুদ রাখা হয়। এই ছানার পানিই ভেজাল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ।

জানা যায়, ঘি তৈরি হয় গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার দুধের ফ্যাট (ননী) দিয়ে। অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে খাঁটি ননীর সাথে নানা উপকরন মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করছে। প্রায় ১৫ কেজি ডালডা অথবা ভেজিটেবল অয়েলের সাথে পাঁচ কেজি খাঁটি ননী, কালার ফ্লেবার ভালভাবে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এই ঘি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। ভেজাল ঘি বাহ্যিকভাবে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বসাকুল্যে ব্যয় হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর এই ঘি বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দরে। এক শ্রেনীর অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ী ভেজাল দুধ ও ঘিয়ের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতিতে পরিনত হচ্ছে। ঘি ও দুধের জন্য বাঘাবাড়ী নামটি সারা দেশে পরিচিত। বাঘাবাড়ীর খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত ও বিক্রি করছে।

এ অঞ্চলের শতাধিক ছানা কারখানার ছানার পানিই নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরন। কতিপয় আসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষ প্রতি মন ছানার পানিতে আধা কেজি ননী, আধা কেজি মিল্ক পাউডার সামান্য পরিমান লবন, খাবার সোডা, এক কেজি চিনি ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে অবিকল দুধ তৈরি করছে, যা রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। ঘোষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই নকল ও ভেজাল দুধ সংগ্রহ করে বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরন প্রতিষ্ঠান। পরে প্রক্রিয়াজাত করার সময় ভেজাল দুধের সাথে আসল দুধ মিশে সব দুধই ভেজালে পরিণত হয়। প্রক্রিয়াজাতকরনের সময় আসল দুধ থেকে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ফ্যাট (ননী) বের করে নেয়া হয়। এতে দুধের পুষ্টিমান কমে যায়। এ দুধ কিনে ক্রেতা সাধারন প্রতারিত হচ্ছেন। ছানার পানি ছাড়াও অন্য এক পদ্ধতিতে অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক মন ফুটন্ত পানিতে এক কেজি দুধের ননী, আধা কেজি স্কিমমিল্ক পাউডার, ২৫০ গ্রাম হাইড্রোজ সমপরিমান লবন, ১০০ গ্রাম সয়াবিন তেল ও এক ফোঁটা ফরমালিন মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়। ক্ষতিকর স্কিমমিল্ক পাউডার ভারত থেকে সীমান্ত পথে দেশে প্রবেশ করছে।

সূত্র আরও জানায়, দুধের ল্যাকটো ও ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায়। সে জন্য ভেজাল দুধে চিনি, লবন, হাইড্রোজ ও সয়াবিন তেল ব্যবহার করে। এতে দুধের ঘনত্ব ও ল্যাকটো বেড়ে যায়। দুধ তাজা রাখার জন্য দেয়া হয় ফরমালিন। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনাকালে
ল্যাকটোমিটার দিয়ে এই সুক্ষ প্রতারনা ধরা সম্ভব হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষেরা অবাধে ভেজাল দুধ, ঘি তৈরি করে বিক্রি করছে। এদের দেখাদেখি অনেকেই ভেজাল দুধ ও ঘি তৈরির কারবারে উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। ভেজাল কারবারীদের সাথে প্রশাসনের কিছু কর্মচারির গোপন যোগাযোগ থাকায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের খবর তারা আগেভাগেই পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান কোন কাজেই আসছে না বলে বিভিন্ন মহল থেকে আভিযোগ উঠেছে।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সবুর আলী বলেন, শিশুর মানষিক বিকাশসহ মানব স্বস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নকল দুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। এ সংক্রান্ত কোন খবর পেলে দ্রুততম সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে এবং প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভেজাল বা নকলের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্সে আছে। সম্প্রতি পেঁচাকোলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে নকল দুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে সঞ্জয় ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে দেড় বছরের কারাদন্ডসহ এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।